"পাশের বাসার ইদ্রিস ভাবীরাও কালকে বুকিং দিয়ে আসলো। এই বিল্ডিং এ এখন আমরা ছাড়া আর আর সবারই নিজের জমি হয়ে গেলো। দুদিন পর বাড়িও হয়ে যাবে।আচ্ছা, তুমি কী চাও বলতো? তোমার কি সত্যি সত্যি ইচ্ছা আছে নিজের বাড়িতে উঠার? নাকি সারাজীবন এই বাড়িওয়ালার ধাঁতানী খেয়েই চালিয়ে দিবে?"
দেখো দেখি! কি কথা!
জমির বুকিং দেয়ার সাথে বাড়ি হয়ে যাবার সম্পর্কটা কোথায়?!
হাসান সাহেব নির্বিরোধ মানুষ, একটা বেসরকারী ব্যাংকে মোটামুটি ভালো পোস্টে চাকুরী করছেন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে; সারাজীবন হয় সরকারের কলোনী, না হয় কোয়াটারে থেকেছেন। অবসরের পর, তার বাবা মা দুজনেই দেশ গ্রামে ফিরে গেছিলেন। শেষ জীবনটা সেখানেই ছিলেন বুড়োবুড়িতে মিলে; এবং হাসান সাহেবের ধারণা বেশ ভালোই ছিলেন। মুক্ত বায়ু, খাঁটি খাবার আর জটিলতা ছাড়া জীবনটা- শেষ বিন্দু পর্যন্ত টেনশন ছাড়াই কাটিয়ে গিয়েছেন তারা।
হাল জমানার হালচাল দেখে, তিনি অবশ্য বুঝে গেছেন এই তরিকায় এখন চলবে না। এখন শহুরে যুগ! শেষ দম ছাড়ার আগেও, তার বৌ টিভিতে উঁকি মেরে দেখে যেতে চাবেন, বেচারী সাদাসিধে বৌটা দজ্জাল 'শাস্' এর হাত থেকে রেহাই পেলো কি পেলোনা!
ভুলটা অবশ্য তিনিই করেছেন। যারা এই ব্যাংকের চাকুরীর ১৫ বছর পার করেছেন, তাদের যে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়া হচ্ছে, এই খবরটা তো তিনিই আগ বাড়িয়ে বৌকে দিয়েছিলেন। নামমাত্র সুদে যে লোনটুকু পাওয়া যাচ্ছে, আর সেটা দিয়ে যে ঢাকার কাছাকাছি জমি কেনার স্বপ্ন দেখা যায়- এটুক হিসেব নিকেশ শেষ করা মাত্রই, নীলিমা বিজ্ঞাপন ঘাটতে বসে গেছে। এর উপরে যোগ হয়েছে, প্রতিবেশীদের জমি কেনার নানান ইর্ষনীয় মুখরোচক গল্প। বাচ্চারাও আজকাল বাসায় বসে বসে বিরক্ত হয়ে গেছে। জমি কেনা হলে অন্তত সপ্তাহে সপ্তাহে পিকনিক করার মতো একটা স্পট হবে, এটা ভেবেই তাদের খুব ফু্র্তি!
গোদের উপর বিযফোড়ার মতো বাড়ীওয়ালাও আজকাল নানা তাল বাহানা শুরু করেছে। শান্তিনগরের এদিকটায় এখন নানা অফিস গড়ে উঠছে। হাসান সাহেবরা চুক্তি ভেঙে বাসাটা ছেড়ে দিলে তিনি মোটা টাকায় অফিসকে ভাড়া দিতে পারেন। এই কারণে নানা খুঁটি নাটি সমস্যা তৈরী করছেন আজকাল।
ছুটির দিনের ভোরবেলাতেই আবার সেই একই প্রসঙ্গ কানে ঢুকাতে, তিনি খুব একটা প্রসন্ন বোধ করলেন না।
বিরক্তি আটকে জবাব দিলেন-
" দেখো, তোমাকে তো বলেছি সময় করে যাবো ড্রিমল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অফিসে। ওদের অ্যাডের পেপার কাটিং ও তো রেখে দিয়েছি। মানিব্যাগেই আছে।"
নীলিমা আজকে নাছোর বান্দা! আলসে লোকটাকে চেপে না ধরলে কখনোই হবে না কিছু!
"মানিব্যাগে না, পেপার কাটিং আমার হাতেই আছে! এই যে দেখো!"
সে স্বামীর দিকে এগিয়ে ধরলো টুকরো কাগজটা।
"ওদের শুক্রবারেও অফিস খোলা থাকে। এখনি চলো। সকাল সকাল গিয়ে বুকিং দিয়ে আসি।"
প্ল্যানটা আসলে কদিন ধরেই করেছে নীলিমা। হিসেব করে বুকিং এর টাকাটাও তুলে রেখেছে ব্যাংক থেকে। এতো কথা অবশ্য জানায়নি হাসান সাহেব কে। আবার দেখা যাবে, তিনি অন্য কোন অযুহাত খাড়া করে ফেলেছেন। স্বামীটাকে তার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে এই আঠারো বছরে!
ড্রাইভার আসবেনা বলে একবার ক্ষীণ আপত্তি জানাতে চেয়েছিলেন হাসান সাহেব; দেখা গেলো সেও হাজির! বেগম সাহেবা নাকি দুদিন আগেই জানিয়ে রেখেছিল।
যাবার পথে পুরো রাস্তাই, ব্যাংকার সাহেব তার হিসেব নিকেশের জট খুলতে খুলতেই গেলেন। কতো টাকা মাসিক কিস্তি, আর খরচ কোথায় কোথায় কতো কমাতে হবে; এটার হিসেব শেষ হবার আগেই তারা পোঁছে গেলেন বারিধারার রিয়েল এস্টেটের আলীশান অফিসে।
ড্রিম ল্যান্ডের অফিসটা যেন স্বপ্নপুরীর মতোই। ঝা চকচকে মার্বেল বিছানো রিসেপশন; ডেস্কের পেছনের মডেল মার্কা মেয়েটার পলিশড হাসি! ( এটা যে অবশ্য নীলিমার তেমন একটা পছন্দ যে হয়নি তা তার বাঁকা নজর দেখেই তিনি টের পেয়েছেন) তুলতুলে গদির মখমলের আবরণের সোফায় বসা থেকে উঠে দাড়ানোতেও কসরত করতে হয়। ওয়েটিং রুমে এসির হিমেল পরশে দশ মিনিট বসে, কফি কাপে চুমুক দেয়ার পাশাপাশি নজর বুলিয়ে গেলেন দেয়ালে ঝোলানো ভবিষ্যতের শহরের নানা চিত্রের উপর। একেবারে কল্পলোকের কোন সাইন্স্ ফিকশনের শহর যেন! ৮০/১০০ তলার নীচে কোন বিল্ডিংই নেই।
হাসান সাহেব মনে মনে ভাবলেন, ঠাঁটবাটেই না জানি কতো পয়সা খরচ করছে এরা!
বেশী ক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। সুট টাই পরা ফিটফাট এক এক্সিকিউটিভ এসে নিয়ে গেলো মিনি মিটিং রুমে। এরই মধ্যে তাদের মতোন বেশ কজন সম্ভাব্য ক্রেতাকেও আসতে যেতে দেখা যাচ্ছিল।
ঘন্টা দুয়েক পর মিটিং রুম থেকে নীলিমা বেশ প্রসন্ন মুখেই বের হয়ে আসলো। সাথে কিছুটা বিভ্রান্ত বদনে তার সাহেব! তিনি যে বুকিংটা দিয়ে দিলেন সেটা কি জমি পছন্দের কারণে না চতুর সেলসম্যানের মোলায়েম ট্যাকনিকের কারণে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
তবে একটা কাজ তিনি করে এসেছেন। আজকে বিকালেই তাদের জমি দেখাতে নিয়ে যাবে ডেভেলপারের পক্ষ থেকে। তারা ছাড়াও আরো কজন ক্রেতাও নাকি যাবেন। ভালোই হয়েছে।
হাসান সাহেব একটু আস্বস্ত বোধ করলেন। জোরাজুরি করে অ্যাডভান্স প্যামেন্ট টা তিনি চেকেই করেছেন। জমি দেখে পছন্দ না হলে কোন একটা অযুহাত দেখিয়ে বুকিং বাতিল করে দিলেই হবে।
সারা রাস্তায় বাড়ীর স্বপ্ন বুনতে বুনতেই ঘরে ফিরলো নীলিমা। বিকেলে জমি দেখতে যাবার তর সইছে না যেন তার।
কিন্তু বিধি বাম! দুপুরের পরেই কেঁপে জ্বর আসলো নীলিমার। এই অবস্থায় বাইরে বের হবার প্রশ্নই ওঠে না। হাসান সাহেব ও যেতে নীমরাজি ছিলেন; কিন্তু সিদ্ধান্ত এখনই না নিলে রোববারে চেকটা ঠিকই ক্যাশ করে ফেলবে রিয়েল এস্টেটওয়ালারা। কিছুটা বিমর্ষ বদনেই তিনি বেরিয়ে গেলেন আবার বারিধারার দিকে। ওখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে সাইটে।
ঠিক সময়েই তার মতো আরো জনা পনের উৎসাহী ক্রেতাকে নিয়ে রওনা দিলো কোম্পানীর মাইক্রোবাস।
ঢাকার এতো কাছে যে, এরকম খালি জলা আছে সেটা আগে কখনো কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। মাত্র ঘন্টা খানেকের রাস্তা। কোম্পানী থেকে দুজন লোক এসেছিলো। মূল রাস্তা থেকে মিনিট পনেরো হেটে তারা নীচু ধানী জমির এলাকায় আসলেন। অল্প একটু অংশ জুড়ে সদ্য বালু ফেলা হয়েছে। জায়গাটা বেশ পছন্দ হলো হাসান সাহেবের। ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলেন তিনি। রিয়েল এস্টেটের প্রতিনিধি দুজনকে একটু বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। বারবার মোবাইলে কাদের যেন ফোন করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু এখানে যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছেনা সেটা তিনি আগেই খেয়াল করেছিলেন। কেন যেন তার মনে হলো কোথাও একটা বড় ঝামেলা হয়েছে।
তিনি এক্সিকিউটিভ দুজনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই দূর থেকে অনেক লোকের হৈচৈ ভেসে আসতে শুনলেন। খেয়াল করে দেখলেন, পাশের গাছপালা ঘেরা জায়গা থেকে হঠাৎ করেই ৪০/৫০ জনের একটা গ্রুপ বের হয়ে বেশ দ্রুতই তাদের দিকেই আসছে। লোকগুলোর সবারই হাতে লাঠিসোটা! কারো কারো হাতে বর্শা মতোনও মনে হলো।
হাসান সাহেবের শীরদাড়া বেয়ে আতংকের একটা ঢেউ বয়ে যেতে লাগলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা বেড়েই চলছিল। তবু হাসান সাহেবের ফেরার কোন নাম নেই। মোবাইল ও বন্ধ! রিয়েল এস্টেটের অফিসের বাইরে অপেক্ষারত ড্রাইভারও কোন খবর বলতে পারলো না! উদ্বিগ্ন নীলিমা নিজের জ্বরের কথা ভুলে বার বার মোবাইলে চেষ্টা করতে লাগলো।এর ভেতরে ড্রাইভার আবার ফোন দিল-
"আফা, এইখানে অফিসে জানি কি হইছে। এরা তরিঘরি কইরা সব বন্ধ কইরা বাত্তি বুত্তি নিভায়া গ্যাছেগা।হ্যাগো এক ডেরাইভরের কাছে হুনলাম, সাইটে নাকি জমি দখল লইয়া বহুত গ্যান্জাম হইছে। গোলাগুলিও নাকি হইছে! আফা আমি অখন কি করুম?"
নীলিমার অবশ হাত থেকে মোবাইল ফোনটা আলগোছে খসে পড়লো।
অবশেষে হাসান সাহেবদের খবর পাওয়া গেলো রাত ১২টার পর।
স্থানীয় একটা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন।
রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর অবৈধ দখলের বিরোধীতাকারী একদল ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর রোষের শিকার হয়েছিলেন তারা। তার উপর কোম্পানীর স্বার্থ দেখা কিছু মাস্তানরাও এই কোন্দলে যোগ দেয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরেই চলে গিয়েছিল।
কমবেশী সবাই আহত হয়েছেন; তবে গুরুতর কিছু নয় এই রক্ষে।
হাসান সাহেবের কেবিনে যখন নীলিমা পৌঁছালো, কেঁদে কেঁদে ততোক্ষণে তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে।
ডান হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা হাসান সাহেব অভয়ের হাসি হেসে তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলেন।
"ভয় পেয়োনা, আঘাত তেমন কিছুই না। ডাক্তার বলেছে কালকেই ছেড়ে দিবে।"
বুকের উপর আছড়ে পড়লো নীলিমা।
"আমি আর কখনো জমি, বাড়ি কিচ্ছু চাবোনা। প্লিজ তুমি খালি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠো। আমার আর কিচ্ছু চাইনা"- ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো সে।
হাসতে গিয়ে ঠোঁটে ব্যাথা লাগলো হাসান সাহেবের।
যাক, ভালো বাসা নাইবা জুটলো; ভালোবাসা যে আছে- এই ঢের।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:১০