
১৭২৫ এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে বলা হয় ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বিলেত থেকে তাঁকে মাদ্রাজে পাঠানো হয়েছিল ১৭৪২ এ। ১৭৪৮-এ সৈন্য বিভাগের কর্মচারি হয়েছিলেন তিনি। সেই সময় ফরাসিদেরও ভারতে প্রভাব ছিল যথেষ্ট। ইংরেজ ও ফরাসিদের মূল লক্ষ্য ছিল একই। আর্কটের মুসলিম নবাবের মৃত্যু হলে ফরাসীরা প্রতিনিধি বানান চাঁদ সাহেবকে, অন্যদিকে ইংরেজদের মনোনীত প্রতিনিধি ছিলেন মহম্মদ আলী।এঁদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড লড়াই। মিঃ ক্লাইভ মহম্মদ আলীর পক্ষে লড়তে বৃটিশ সৈন্য নিয়ে আর্কটে আক্রমণ করলেন এবং পরাজিত করলেন ফরাসিদের। ভারতে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পতন ওখানেই শুরু। আর্কটবাসী মনে করলেন মুসলমান নবাবের আর্কট ইংলন্ডের হাতেই চলে গেল। সারা ভারতের রাজনৈতিক নেতারাও ভাবছিলেন ঐ এক-ই কথা। চতুর ক্লাইভ আর্কট দখল করে মহম্মদ আলীকে সিংহাসনে বসিয়ে চমক লাগিয়ে অবাক করেন সবাইকে। বিশেষ করে ভারতের মুসলিম জাতি অভিভূত হয়ে গিয়েছিল ক্লাইভের উদারতায়। তখন কারও পক্ষে টের করা সম্ভব হয়নি যে ওটা ছিল কৌশল মাত্র। এরপরে আর কিছু ক্ষেত্রে ক্লাইভ ফরাসিদের পরাজিত করে ফ্রান্সের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেন একেবারে।
এইবার ক্লাইভ নজর দিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার দিকে। তিনি ঘাঁটি গাড়লেন চন্দনগরে। সময়টা ঠিক এমন ছিল যখন বড় রকমের একট ষড়যন্ত্র চলছিল সিরাজকে পদচ্যুত করার। এই দুর্যোগকে ক্লাইভ সুযোগ মনে করে যোগ দিয়ে দিলেন ষড়যন্ত্রে। সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তারা হচ্ছেন রাজা কৃষ্ণচন্ত্র, ধনকুবের জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রাধাবল্লভ, উর্মিচাঁদ, গোবিন্দসিংহ, নন্দনকুমার প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ। আর মুসলমান নেতাদের মধ্যে ছিল মীর জাফর আলী ও ইয়ার লতিফ। সামরিক ক্ষমতার জোরে ক্লাইভ সিরাজকে পরাজিত করতে পারবেন না তা ভালই জানতেন তিনি। কারণ পূর্বের কলকাতার যুদ্ধে সিরাজের জয়লাভ এবং ইংরেজদের পরাজয়ের বা সেই আলি নগরের সন্ধির কথা তাঁর স্মরণ ছিল। সুতরাং ষড়যন্ত্র ছাড়া সিরাজকে পরাজিত করা যাবে না ভেবেই পূর্বে উল্লিখিত বঙ্গীয় নেতাদের সঙ্গে শর্ত দেয়া নেয়ার কাজ শেষ করে ফেললেন অর্থাৎ সিরাজের পদচ্যুতির পর কাকে কী দেওয়া হবে, কে কীভাবে কী পরিমাণ লাভবান হবেন সব জানিয়ে দেওয়া হল তাঁদের। ১৮৫৭ সালের ২৩শে জুলাই পলাশীতে যে যুদ্ধ[?] হয়েছিল সেটা ছিল একটা পুতুলখেলা মাত্র। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রচারের জোরে এটাকে বিশ্বের বিরাট যুদ্ধ বলে চালালেও তা ছিল ভাঁওতা, কারণ সিরাজের সৈন্য যেখানে এক লাখের উপর আর সেই পরিমাণ কামান গোলাবারুদ, ক্লাইভ সেখানে হাজির হচ্ছেন মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে। ক্লাইভ হলেন বিজয়ী আর ভারত প্রতিনিধি সিরাজউদ্দৌলা হলেন বন্দী। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্ঠুরভাবে নিহত হতে হলো সিরাজকে আর ইংলণ্ড প্রাপ্য ‘লর্ড’ উপাধিতে ভূষিত করলো ক্লাইভকে। সেইসঙ্গে চরম বেইমানির পরম পুরস্কার ‘ব্যারন’ টাইটেল।

ষড়যন্ত্রের শিকার নবাব সিরাজউদদৌলা
এইবার লর্ড ক্লাইভ হয়ে গেলেন সারা বাংলার গভর্নর। ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উন্নতির গতি এত সুক্ষ্ম ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে চলতে লাগলো যে সাধারণ মানুষ টের করতে পারেনি ভারত স্বদেশীর হাত থেকে চলে গেছে বিদেশীর হাতে। শান্ত অনুগত তাবেদের সেজে ১৭৬৫-তে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের দরবারে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টকা কর দেবার চুক্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী পদ আদায় করলো বৃটিশ। ক্রমে মুসলিম রাজত্ব গতি নেয় ধ্বংসের দিকে আর ইংরেজরাজ প্রতিষ্ঠার গতি বৃদ্ধি হতে থাকে দ্রুত।

তাবেদার সম্রাট দিল্লির শাহ আলম
ক্লাইভ ইংলন্ডবাসীর পক্ষে মহান মানুষ হলেও নিরপেক্ষ বিশ্ববাসীর চোখে তিনি ছিলেন একজন বড় শোষক ধাপ্পাবাজ ও লুণ্ঠক। তিনিই হচ্ছেন ভারতের অর্থনৈতিক পতনের মূল আসামী। পূর্বে বর্ণিত বঙ্গীয় নেতাদের ষড়যন্ত্রে তিনি যোগ দিয়েছিলেন, নাকি ক্লাইভের তৈরি ষড়যন্ত্রে ঐ নেতারা যোগ দিয়েছিলেন তা খানিকটা বিতর্কিত ব্যাপার। তবে উল্লিখিত ভারতীয় নেতারা প্রত্যেকেই যে নিজের নিজের অর্থনৈতিক পার্থিব স্বার্থে ভারতবর্ষকে বৃটিশের হাতে বিক্রি করার রাস্তা খুলে গেছেন, এ বিষয়ে সবাই একমত। নিহত সিরাজের বাড়ি লুঠ করে প্রত্যেক লুণ্ঠকই ভালরকম নগদ মালকড়ি পেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন। তবে একথা সত্য যে ভারতীয় বেইমান দালাল নেতারা যা পেয়েছিলেন তার চেয়ে বহু বেশি ধনরত্ন অর্থ পেয়েছিলেন বৃটিশ নেতারা। নিরপেক্ষ বিচারে ভারতীয় নেতাদের প্রাপ্তিযোগ সাময়িকভাবে হলেও তারা তা বিদেশে নিয়ে চলে যাননি, কিন্তু বিদেশিরা যা পেয়েছিলেন তার সবটুকুই নিয়ে চলে গিয়েছিলেন স্বদেশ ইংলন্ডে। ক্লাইভ সেই বাজারে পেয়েছিলেন দু লক্ষ আশি হাজার টাকা আর মীরজাফর ক্লাইভকে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা। তাছাড়া মেম্বার হিসেবে ক্লাইভ আরো দু লাখ টাকা পেয়েছিলেন আর সেনাপতির যোগ্যতা ও ষড়যন্ত্রের পুরস্কার বাবদ বিশিষ্ট দান পেয়েছিলেন আরো এক লাখ ষাট হাজার। এগুলো সব প্রকাশ্য প্রাপ্তি। কিন্তু গোপনে যা পেয়েছিলেন তার পরিমাণ সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে যখন তিনি ইংলন্ড চলে গিয়েছিলেন তখন তাঁর মালপত্র জাহাজে ওঠাবার সময় যা দেখা গেছে তা হলো- ধনরত্ন, মণি মানিক্য, সোনা ও রূপোর জিনিষপত্রের জন্য বড় সাইজের ত্রিশটি নৌকা ভর্তি সামগ্রী। সেই বিখ্যাত লর্ড ব্যারন কর্ণেল ক্লাইভ দেশে ফিরে গিয়ে হলেন এক বিরাট মামলার আসামী- অপরাধটা শোষণের নয়, যা এনেছিলেন তার থেকে বৃটিশ সরকারকে যা দেবার কথা ছিল তা তিনি দেননি যথাযথ। আসামী হওয়ার অপমানে ও ক্ষোভে এই বীর[?] নেতা ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে আত্মহত্যা করেন।
ওআরেন হেস্টিংস Warren Hastings (6 December 1732 – 22 August 1818)

জন্মগ্রহণ করেন ১৭৩২ সালে। তাঁকেও শাসন শোষণের ট্রেনিং দিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কেরানী করে পাঠানো হয়েছিল ভারত বর্ষে। ভারতে এসে দানবীয় পদ্ধতিতে ভারতবাসীর উপর অত্যাচারের রোলার চালিয়ে কোম্পানি তথা বৃটিশ সরকারকে মুগ্ধ করেন তিনি। পাওনা হিসেবে পেয়ে যান সারা ভারতের গভর্নর জেনারেলের পদ। দেশীয় নেতাদের সহযোগিতায় রাজা চৈত সিংয়ের বাড়িতে বিশেষ করে তাঁদের মহিলাদের উপর অশ্লীল ও সীমাহীন অত্যাচার করেছিলেন তিনি। আর অযোধ্যার বেগম ও তাঁর বাড়ির মহিলাদের প্রতিও যথেচ্ছ অত্যাচার করে তিনি চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সরকারকে। তাঁর সময়ে ভারতে সুপ্রীম কোর্ট ও চিফ জাস্টিসের পদ গঠিত হয়। এঁর সময়েই তৈরী হয়েছিল এসিয়াটিক সোসাইটি। যাই হোক, হেস্টিংসের আমলেই মুদ্রণ যন্ত্রেরও প্রচলন হয় এই দেশে। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ভাষায় খৃষ্টান ধর্মের প্রচার ও প্রভাব সৃষ্টি করা। এত করেও হেস্টিংসের দুর্নামে সোচ্চার হয়ে উঠলো ভারতবর্ষ। সদাশয় ইংরেজ সরকার সুবিচারের নামে তাঁকে সসম্মানে ইংলণ্ডে ডেকে নিয়ে আরম্ভ করলো তাঁর অত্যাচারের বিচার। বৃটিশের মহামান্য বিচারকদের সুবিচারে তিনি প্রমাণিত হলেন একেবারে নির্দোষ। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮১৮-তে।
ইলাইজা ইম্পে ( Sir Impay Elijah 1732-1809)

জন্ম নেন ১৭৩২ সালে। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ভারতের সুপ্রীপ কোর্টের বিচারপতি করে। নিম্ন আদালত থেকে আসা বিচারগুলো তাঁর কাছে এসেই শেষ হত অবিলম্বে। সুতরাং ভারতের বৃটিশ বিরোধী ব্যক্তি বা বিপ্লবীদের, বিশেষ করে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে এই রকম আসামীদের, কেমন করে যাবজ্জীবন ও ফাঁসি দেওয়া যায় সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ বিচারক। অনেক ফাঁসির রায়প্রাপ্ত আসামীকে বাহ্যতঃ করুণা প্রদর্শন করে যাবজ্জীবনের কারাদন্ড দিতেন। অবশ্য কারাগারে তাদের মৃত্যুই ঘটানো হতো আর রটিয়ে দেয়া হতো হৃদরোগের মৃত্যু বলে। ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে মহারাজ নন্দকুমারকে জালিয়াতির অভিযোগে ফাঁসির দন্ড দিয়েছিলেন ঐ বিচারপতি মিঃ ইম্পে। অথচ সত্যিকথা এটাই, যে অভিযোগের তাঁর ফাঁসি হয়েছিল সেই অভিযোগটি ছিল মিথ্যা। ঐ ব্রাহ্মণ নন্দকুমারের ফাঁসির পর বহু হিন্দুর ইংরেজ প্রীতিতে ভাটা সৃষ্টি হয়। বিলেত থেকে খবর এল তাঁকে দেশে ফিরে যেতে হবে, তাঁর বিচার হবে সেখানে। আমাদের ভারতের রাজা, মাহারাজা, জমিদার, এমনকি অনেক আশ্রমের সাধুজীরা বিলেতে গাদাগাদা চিঠি লিখলেন যাতে ন্যায়াধিরাজ মহান বিচারপতির শাস্তি না হয়। আর তাই ইংরেজ শাসক মিঃ ইম্পেকে ভূষিত করেছিলেন ‘স্যার’ উপাধিতে। ১৮০৯ খৃষ্টাব্দে তিনি বিদায় নেন পৃথিবী থেকে।
এদের চিনে রাখুন,একদিন এরাই আপনাদের ছিড়ে-খুঁড়ে খেয়েছিল ( প্রথম পর্ব )...
এদের চিনে রাখুন,একদিন এরাই আপনাদের ছিড়ে-খুঁড়ে খেয়েছিল ( দ্বিতীয় পর্ব )
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ১২:৫৭