নব্য চাকুরীতে যোগদান করিয়া প্রথম জোড়া জুতা যথেষ্ট মুদ্রাপ্রদান বাবত বাটা হইতে কিনিয়াছিলাম বেশ খেয়াল আছে। তিনমাসাধিক পরে সোলভাঙ্গা সেই জুতাজোড়া যখন কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে পরিত্যাগ করিয়া স্যান্ডেল পরিয়া ঢাকায় প্রস্থান করিলাম , সেই হইতে বাটাকে তালাক প্রদান করিলাম। পরবর্তীবার দেশীয় পণ্য কিনে হও ধন্য বলিয়া এপেক্স এর একজোড়া জুতা দুই-সহস্রাধিক মুদ্রা দ্বারা ক্রয় করিলাম।
কিন্তু বিধিবাম। ২০০৭ অগাষ্টের এক প্রত্যুষবেলায় তস্করবাবাজী পুরো ব্যাচেলর নিবাসের পাদুকারাজী সাফা করিয়া দিলেন, নগ্নপদে তৃতীয়তলার সুন্দরী 'আফা'ত্রয়ের পিতার নিকট প্রথম পরিচয়েই জুতাভিক্ষা করিয়া মান বাঁচাইলাম।

অতপর ক্ষুব্দ বিক্ষুব্দ হইয়া চারিটি শোরুম খুঁজিয়া একইজোড়া জুতা পুনঃবার ক্রয় করিলাম।হৃদয় শান্ত হইলো। কাহিনী এই জুতাজোড়াকেই লইয়া।
মাসতিনেক পার হইয়া গেলো, আমার একমাত্র পাদুকাযুগল ও তার বরণকালীন কমনীয়তা ও ঔজ্জ্বল্য হারাইতে লাগিলো। ইহাকে পালিশ করানো জরুরী বোধ করিলাম। সেই সময় আমি ও বন্ধুবর রানা বহুলাংশে দুষ্টামি আর কিয়দংশে তাড়িত হইয়া প্রতিদ্বন্দী
আরেকটি প্রতিষ্ঠানে কামলা খাটিবার জন্য আবেদন করিয়াছিলাম, আচম্বিত সেইখান হইতে আমন্ত্রণ আসিলো ‘যোগ্যতা নিরুপন’ এর নিমিত্ত।
সপ্তাহখানিক আগে হইতেই চিন্তামগ্ন হইলাম , প্যান্টের বেল্ট
খানা জীর্ণ হইয়াছে, উহা নতুন খরিদ করা দরকার, পরিধেয় যাহা আছে তাহা দিয়া চালাইয়া দেওয়া যাইবে কিন্তু এইবার জুতা পালিশ নিমিত্ত মুচিবাবাজীর কাছে গমন অবশ্যকর্তব্য প্রতিপন্ন।
দেখিতে দেখিতে সেই দিন আসিয়া পড়িলো। দোনোমোনোভাব নিয়া সিদ্ধান্ত নিয়াছিলাম কর্মস্থল পরিবর্তন করিব না, তাই কোনরূপ প্রস্তুতিগ্রহঅণ করি নাই। কিন্তু শেষ মূহুর্তে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচিত একজন ফোন করিয়া বলিলেন, জার্মান ও থাই নিবাসী দুই উচ্চকর্তা এই দিনমজুর এর জন্য অপেক্ষমান ! কি আর করিবো, তৎকালীন বসকে বলিলাম, তিনি কহিলেন তাহাদের অসম্মান হইবে, যাইয়া একটু দর্শন দিয়া আসো। সেই নিস্পেষিত জুতাজোড়া, সেই জীর্ন বেল্ট আর মাসকয়েক ইস্ত্রী না করা শার্ট পরিয়াই গেলাম।
যাহা হোক, এই যাত্রা শেষ। মাসখানিক পরে অন্তুর্জাল-বার্তা আসিলো, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও দলপ্রধান সম্মিলিতভাবে আমি নামক 'পদার্থ'টিকে দর্শন করিতে ইচ্ছুক। পুলক জাগিলো মনে, এইখান হইতে যাওয়া হোক বা না হোক, সাফল্যের সুঘ্রাণ পাইতেছি। এইবার
নিজেকে কিছুটা ঘষিয়া মাজিয়ে উপস্থাপন অনেকটাই অবশ্য অবশ্য কর্তব্য। নিজে ব্রাত্যজন , তাহা বলিয়া কাকের কি পেখম মেলার স্বাদ থাকিতে নাই?
হা হুতোম্মি! অতঃপর সেই একই অগতি

অতপরঃ আরো দুইবার সেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে যাওয়া হইয়াছিলো। ততদিনেও আমি অপরিবর্তিত বাস্তবতা বহন করিয়া চলিতেছি। মৌলবাদী আচরণসুলভ জুতাজোড়াকে মূল অবস্থায় রাখিয়া দিতে দৃঢ় সংকল্পবন্ধ।
ইত্যবসরে অনেক জল অনেক নাটক ঘটিয়া গিয়াছে, হিসাব নিকাশকে উল্টাইয়া দিয়া নব কর্মস্থলে যোগদান স্থির হইলো। পুরাতন সহকর্মীগনের ভালোবাসার দান নতুন শার্টটি পরিয়া , তাহাদের প্রদানকৃত জিলেট কিট দিয়া শ্রশ্রুমোচন করিয়া এবং তাহাদেরই সুগন্ধি মাখিয়া যোগদান করিলাম , ধ্রুব বাস্তবতা হিসাবে সেই অপালিশকৃত জুতাজোড়া সঙ্গ দিতেছিলো।
তাহার পর আপডেট এইরূপঃ
কার্যাপোলক্ষে মার্চে যাওয়া হইলো জাকার্তা। ভাবিলাম ক্ষীণজীবনের প্রথম বৈদেশভ্রমণ , জুতাজোড়াকে কিঞ্চিৎ চকচকে করিয়া যাই। হইলো না।
আসিয়া সমাবর্তন পাইলাম। জীবনের অন্যতম একখানি অনুষ্ঠান। তীব্র বাসনা থাকিলেও
সময়াভাবে এবং পরে নিরাপত্তার বলয়ে মুচির অভাবহেতু আশা পূর্ণ হইলো না।

ধূলিধুসরিত অযত্নে পদদলনের নিস্পেষনের শিকার জুতাজোড়া তাহার জীবন অতিবাহিত করিতে লাগিলো, ইত্যকালে বিবাহ সম্মেলন কার্যাপোলক্ষে বিভিন্ন আয়োজনে আমার পদযুগলের বস্তুর দিকে মনুষ্যপ্রজাতির ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপন চলিতে লাগিলো।
চারিটি বান্ধব, পঞ্চ সহকর্মীর বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন হইলো। অপরিবর্তেনয় বাস্তবতা বহমান। তদ্দিনে এই বিষয়টি বান্ধবমহলে ব্যাপক রটনা ছড়াইয়াছে। দুষ্ট বালকেরা কহিতে লাগিলো , আমি নাকি কি জানি পণ করিয়াছি। (আফসুস

সেপ্টেম্বর এ আসিয়া একটি বিরল সুযোগ আসিলো । বিশেষ শিক্ষাগ্রহণ ও কামলা খাটিবার নিমিত্ত ইউরোপ মহাদেশ ভ্রমণ। ভাবিলাম , এইবার তো মান রাখিতেই হয়,
জুতাজোড়াকে ইউরোপ উপযোগী না করিলে কেমন দেখায়।
হায়! দোহা’র ঊষর মরু দ্বারা আচ্ছাদিত হইলো, বার্লিনের বৃষ্টি দ্বারা ধৌত হইলো, প্রাগের
দ্বাদশশতাব্দীর পাথুরে রাস্তায় আঘাতপ্রাপ্ত হইলো , তাহার কপালে পালিশ জুটিলো না। পোল্যান্ডের হালকা তুষার ও তাহাকে স্পর্শ দিয়া গেলো, মুচির স্পর্শ জুটিলো না। সহকর্মীদ্বয়ের তীব্র বাক্যবানে আহত পরাহত হইয়া ল্যুভর এর পিছনে পালিশের দোকান দেখিয়া খেপিয়া উঠিয়াছিলাম , কিন্তু বিনিময়বাবদ নয়টি ইউরোপীয় মুদ্রা শুনিয়া কাতর হইয়া নিরস্ত হইলাম ।

আরো একটি ঈদ ও অনেক দিবস রজনী অতিবাহিত করিলো তাহারা, পুনরায় ঈদ সমাগত; ভাবিলাম – অনেক বিলম্ব হইয়াছে । আর দেরী নহে। এইবার তাহার গতি করিতেই হয়, মুচির হস্তে সমর্পণ, প্রৌঢ় বয়সে খানিকট ঔজ্জ্বল্য যদি ফিরিয়া আসে ।

আমার ক্ষ্যাতীয় সঙ্গী ...... মন পুড়িয়া যায়...
পরিতাপের সহিত জানাইতেছি যে , আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী এই পাদুকাযুগল ক্রমাগত নির্যাতন অবহেলা শোষণের পরিনামে, যুগপৎ নিজেদের দেহ কিঞ্চিৎ ছিন্ন করিয়া ভদ্রসমাজে ব্যাবহার অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছে। (



গত সপ্তাহ হইতে তাই আমি প্রবল অনুশোচনা, মনোবেদনা ও পরিতাপের সহিত জীবনটাকে যাপন করিতেছি।
ক্ষ্যাতগিরির এমন বিশ্বস্ত সঙ্গী আর কবে কোথায় পাইবো?


গলার বস্ত্রখন্ডটি লটকাইবার অপটু দক্ষতাহেতু ক্ষ্যাতগিরি
পাস করিয়া বাহির হওয়া যাবত নিরন্তর কামলা খাটিতেছি। জ্ঞানদান এর সম্মানিত পেশা হইতে শুরু করিয়া আক্ষরিক অর্থেই মাটিতে বসিয়া যন্ত্রপাতি-তার-প্রযুক্তিপণ্য টানাটানির কামলাগিরি ইস্তক।
ইত্যবসরে কর্মসূত্রে বহুৎ স্থানে গমন নির্গমন আহার বিহার হইয়াছে। আমিও যথারীতি নিজস্ব কামলার বেশেই সকল কিছুতেই নির্বিকার অংশগ্রহন করিয়া গিয়াছি, কিছু বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করিলে। যেমন রেডিসন নামক অভিজাত সরাইখানার এক উচ্চমন্য প্রহরী একবার সন্দেহ পোষণ করিয়াছিলো আমি সত্যকারই আমন্ত্রিত অতিথী কিনা জানিতে চাহিয়া। আরেকবার জাকার্তা ম্যারিয়টের অপ্সরী স্বাগতমকন্যা প্রবল সন্দেহের চোখে তাকাইয়া যথারীতি কিন্নরী হাস্যমুখে ফুল না দিয়া ডোর কার্ড চাহিয়াছিলো (অপমান অপমান

কিয়ৎকাল পূর্বে একটি উচ্চমান সরাইখানাতে অনুষ্ঠেয় আয়োজনে আমন্ত্রিত হইয়া দলনেতার অনুরোধে অংশগ্রহন্মুখ হইলাম। নির্দিষ্ট দিনে আমন্ত্রণপত্র পড়িয়া মস্তিস্ক উত্তপ্ত হইলো। তাহার পর গৃহে ফিরিয়া বার্তা দিলাম আমি ব্যাথায় কাতরাইতেছি। কারণ?
কারণ দুঃখের কথা (আমার নিকট সুখের কথা) হইলো তিন বৎসরাধিক অধীন জীবনে নিজের গলায় অধীনতার স্মার্টসুলভ বস্ত্রখন্ডটি লটকাইবার প্রবৃত্তি বা সেই পর্যায়াধিক স্মার্ট হইতে পারি নাই। ‘খুদাপেজ’।
শুধু একবারই ব্যাত্যয় ঘটিয়াছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হইবে , সবারই আশা-আশংকা-শংকার অবশেষ হইতেছে না। জনগণ ব্যাপক আয়োজন করিতেছি, কেউ চুল কাটিতেছি, কেউবা পরিধান ক্রয় করিতেছে, কেউবা জুতা কিনিতেছে। আমিই নির্বিকার বসিয়া বোরকার মত গাউনটি পরিবার কসরত করিতেছি। সমাবর্তনের দিন অধমকে বস্ত্রখন্ডটিবিহীন দেখিয়া আমাদের আব্বুসুলভ রুপম তাহার পিতার ১৯৬৭ সালের একখানা ‘টাই’ তড়িৎগতিতে ফাঁস লাগাইয়া দিলো, আর তাহা সারাদিন আমি দড়ির মত বহিয়া হাঁসফাঁস করিতে লাগিলাম।

দড়ির মত ঝুলিতেছে ক্ষ্যাতের গলায়

ক্রয় , উপহার বা প্রাপ্তির তালিকাতে ও কখনো এই বস্ত্রখন্ডটি আসে নাই। বিধাতার নিকট প্রার্থনা, এই বস্ত্রখন্ডটি আমার মূল্যবান সম্মুখদেশে ঝোলা যত দীর্ঘায়িত ও ঝোলার সময়টুকু যত সংক্ষিপ্ত হয় , তাহাই মঙ্গল। একান্ত বাধ্য না হইলে না ঝুলিলে আরো মঙ্গল। কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হইবে না, মনীষিগণ এমনিতেই বলিয়া যান নাই।

ক্ষ্যাতগিরি দীর্ঘজীবি হউক, বলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
দ্রষ্টব্যঃ কিছুই লিখিতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুবর জাকারিয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধে অপটু বানানে
ইহাই লিখিলাম। কী করিবো, ক্ষ্যাতের যোগ্যতায় যাহা কুলায়।

ফারহান ভাই ও অন্যদিগের প্রতি কাতর অনুরোধঃ নিশ্চিত পর্যাপ্ত পরিমাণ বানান ভুল বিদ্যমান, মাইনাস প্রদানপূর্বক জ্ঞাত করিলে শিক্ষালাভ করিবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১১:৫২