‘ARBEIT MACHT FREI’ , সেই বিখ্যাত গেটটি; যার অর্থ কর্ম তোমাকে মুক্তি দেবে।
জীবন এই দিক দিয়ে ঢুকত, বের হতো ক্রিমেটোরিয়ামের চিমনি দিয়ে।
অক্টোবরের এক কুয়াশাময় ভোরে আমরা চার সহকর্মী ব্রস্লো-ক্রাকাঊ হাইওয়ে ধরে ছুটে যাচ্ছি অশউইৎসে, গাড়ি চালাচ্ছে পোলিশ সহকর্মী গ্রেগজ। আরেক গাড়িতে আছে গ্রেগজ এর বন্ধু চ্যামেক আর ওর স্ত্রী গ্রাশা । দুইপাশে কুয়াশা-রোদে মাখানো পোলিশ কান্ট্রিসাইড, মাঝে মাঝে সবুজ-কমলায় মেশানো বনভূমি, মনে করিয়ে দিচ্ছে শীত সমাগত। কিন্তু আগের সপ্তাহের কার্পাজ ভ্রমণের মত কোন দৃশ্যই মন কাড়ছে না। বরং মাঝে মাঝেই কুঁকড়ে যাচ্ছি কি দেখতে হবে এই ভেবে। আগের রাতে ইউটিউবে ‘Auswitz’ সার্চ দিয়ে দেখা ভিডিও ক্লিপগুলোই যে কাউকে অসুস্থ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
জায়গাটা অশউইৎস- বিরকেনিঊ , পোলিশ উচ্চারণে অসভিয়েচিম এর একটা অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাজী কনসেনস্ট্রেশান ক্যাম্প , গ্যাস চেম্বার নামেই সমাধিক পরিচিত। পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যাগুলোর একটি এখানেই হয়েছিলো, ঠান্ডামাথায়,সুশৃঙ্খল পদ্ধতিগতভাবে ।
বিরকেনিঊ হচ্ছে অশউইৎস এর দ্বিতীয় ক্যাম্প, প্রশান্তিতে হারিয়ে যাবার মত জায়গা। প্রচুর বার্চ গাছে ঘেরা শির শির শব্দে বয়ে যাওয়া ভিস্তুলা নদীর স্পর্শমাখা বাতাস দেখেই পোলিশ কৃষকরা নাম দিয়েছিলো বিরকেনিঊ। এখন সেই একই বাতাস কোনো প্রশান্তি জাগায়ই তো না, জেগে থাকলে স্পর্শে গা শির শির করে; চোখ বন্ধ করলেই দুঃস্বপ্ন।
তৃতীয় ক্যাম্পটি মনোভিটজ, যেটা মূলত ছিলো ফ্যাক্টরি এলাকা। সিন্থেটিক রাবার , ফুয়েল প্ল্যান্ট ছিলো, শেষদিকে বন্দীদের চুল দিয়ে তৈরি হত কার্পেট, দেহভস্ম দিয়ে সার। কি নিদারুণ নৃশংসতা। এই ক্যাম্পটি এখন আর সংরক্ষিত নেই।
এখানেই হত্যা করা হয়েছিলো ১৫ লক্ষ মানবসন্তান, অধিকাংশই ইহুদী , তার সাথে ছিলো হাঙ্গেরিয়ান, রুমানিয়ান , জিপসী, পোলিশ, সেভিয়েত, কিছু নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ।
‘কর্ম তোমাকে মুক্তি দেবে’ লেখা গেটটি পার হলাম সকাল দশটার দিকে, তার আগে ছিলো শিউরে উঠার একটা সংক্ষিপ্ত মুভি প্রদর্শনী। ওয়্যারলেস অডিও কিট নিয়ে আমাদের গাইড মার্চিনের সাথে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। গ্রুপটা মিক্সড, আমরা তিন বঙ্গসন্তান ছাড়া আছে পোলিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, তিনজ়ন স্প্যানিশ,আমেরিকান।পরে বুঝেছিলাম দুইজন জার্মান আর কয়েকজন ইসরায়েলি ও ছিলো।
অশউইৎস এর কাঁটাতারঘেরা ক্যাম্প, ১৫০০০০০ মানবসন্তানের উপর নৃশংসতার স্বাক্ষী।
প্রথম ক্যাম্পটিই বিশাল, সবগুলো মিলিয়ে চল্লিশ বর্গকিলোমিটার। সুতরাং নির্দিষ্ট কিছু ব্লকই আমাদের দেখতে হবে। সব মিলিয়ে সতেরোটা ব্লক দেখা হবে, কুখ্যাত ব্লক-১১ (ডেথ ব্লক),২৪ ,১০ সহ। প্রত্যেকটি ব্লক একেকটি বিষয়বস্তুর উপর সাজানো হয়েছে । দেখছিলাম আর বিস্ময়ে কেঁপে ঊঠার অনুভূতি হচ্ছিলো। কারণ যুদ্ধে লাখ লাখ সৈন্য মারা যাওয়া এক ব্যাপার , সেটা অস্তিত্বের লড়াই, কেউই নিরস্ত্র নয়। আর এখানে ঠান্ডা মাথায় একেবারে নির্দিষ্ট নিয়মে লাখ লাখ লোক মেরে ফেলার একটা সিস্টেম মানুষই তৈরি করতে পারে, অকল্পনীয়। জার্মানরা মেথডিক্যাল জানতাম, জার্মানদের সাথে কাজ করে সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু গনহত্যার মত একটা কাজকেও জার্মান এসএসরা যেভাবে সুশৃংখল নিয়মে নিয়ে এসেছিলো দেখলে কেমন জানি হতবাক লাগে।
অশউইৎসের ব্লকগুলো
ছায়াময় পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে ঘৃণা আর শোকের অভিব্যাক্তি অনুভূতিটাকে চিনতে পারছিলাম।
ব্লক ব্লকে আমরা যাচ্ছি দেখছি, আর একটু একটু করে ভার বাড়ছে। প্রথমে আমার কাছে আমাদের গাইডের বর্ণনা অতি আবেগী মনে হচ্ছিলো, কিন্তু এইসব দেখার পর সেটাই মনে হচ্ছিলো স্বাভাবিক।
একটা ব্লকে দেখলাম দুই টনের বেশী মাথার চুল রাখা আছে - স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে হলো কি সংখ্যার মানুষ হতে এই পরিমাণ চুল আসতে পারে! সাইক্লোন বি এর ব্যাবহার করা ক্যানগুলো দেখলাম, প্রথম গ্যাসিং এর পর হেনরিক হিমলারের লেখা শংসাবাচন দেখলাম।
স্তুপ করে রাখা হাজার হাজার (নাকি লক্ষ লক্ষ) জুতা , চশমার ডাঁটি দেখলাম। একটা ব্লকে বাচ্চাদের জামাকাপড় জুতা রাখা আছে । অনেককেই দেখলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিশেষত বৃদ্ধরা । যুদ্ধের ক্ষত
অনেকেই বয়ে চলেছেন এখনো। এই রুমটাতে আসলে আবেগ সংবরন অসম্ভব । ছোট ছোট বাচ্চাদের , যাদের অনেকে তাদের প্রথম জন্মদিনটিও পার করেনি, জীবন মিলিয়ে গিয়েছিলো গ্যাস চেম্বার বা ক্রিমেটোরিয়ামের ফ্যাকাসে অন্ধকারে। ইলেক্ট্রিফায়েড কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে মুক্ত জীবন দেখেনি অনেক কিশোর-কিশোরী। তার বদলে তাদের যেতে হয়েছে নাজী বিকৃত ডাক্তার মেঙ্গেল এর ছুরির নিচে,জীবন্ত । এই এসএস ডাক্তারদের অনেকেই (বিশেষত ডাঃ মেঙ্গেল) বাচ্চাদের কেটে কেটে নানা পরীক্ষা চালাতো, বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য! ব্লক-২৪ এর নারীদের উপর চলতো আরো ভয়াবহ পরীক্ষা, গর্ভধারণ আর বাচ্চার বৃদ্ধি নিয়ে। এসএস দের কাছে বন্দীর মর্যাদা পশুর কাছাকাছি ও ছিলো না, ছিলো কীটপতঙ্গের সমান (সভ্যতার ‘কীট’ বলেই সম্বোধন করা হত তাদের)। সুতরাং, এইসব কাজে তারা ছিলো চরম নির্বিকার।
দুই টনের বেশী মাথার চুল রাখা আছে - স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে হলো কি সংখ্যার মানুষ হতে এই পরিমাণ চুল আসতে পারে!
সাইক্লোন বি এর ব্যাবহার করা ক্যানগুলো।
ছায়াময় পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে ঘৃণা আর শোকের অভিব্যাক্তি অনুভূতিটাকে চিনতে পারছিলাম। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে প্রথম যেবার যাই, সেবারও একই অনুভূতি হয়েছিলো। অনেকের সাথে অনেক জাতীয়তার সাথে মিশে আমার মনে হয় মানুষ আসলে একই, মানুষের কান্নাও এক। পার্থক্য শুধু প্রকাশে। ওরা কান্নাকে শোককে শক্তি আর কাজে রুপান্তর করেছে , আমরা করেছি আবেগী কথামালায় ; বাস্তব পদক্ষেপ প্রায় কিছুই নেইনি।
এই ক্যাম্পটিতে বিদ্রোহ হয়েছিলো দুইবার । নেতৃত্বে ছিলো মুলত পোলিশ রাজনৈতিক বন্দীরা। বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পরে সেই বন্দীদের দুইভাবে হত্যা করা হয়। না খাইয়ে মাটির নিচের সেলারে আটকে রেখে , যেটা ছিলো এই ক্যাম্পে অন্যতম জনপ্রিয় একটা পদ্ধতি। গুলি করেও মারা হতো ব্লক-১৭ এর পাশের দেয়ালে, আনুমানিক ৫০ হাজারের মত হত্যা করা হয়েছিলো গুলি করে। বাকীদের ভয়াবহ নির্যাতনের পর ফাঁসি দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে অবশ্য ফাঁসি দেবার দরকার ছিলো না, তারা নির্যাতনে প্রায় মৃতই ছিলো।
একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদাররা আর তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর মিলে হেরে যাবার মূহুর্তে যেরকম আমাদের বুদ্ধিজীবি-সাংবাদিক-শিক্ষকদের মেরে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রক্রিয়ায় ছিলো, সেইরকম নাজীরাও ১৯৪৪ থেকে পোল্যান্ড এ এই প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলো।
ফ্যাকাসে অন্ধকারে ঢাকা ক্রিমেটোরিয়ামে ঢোকার পর খুব চাপ লাগে মনের উপর। চুল্লীগুলো আগের মতই আছে। মাঝে মাঝে জীবন্ত মানুষকেও নাকি ঢুকিয়ে দেয়া হত এখানে! ক্রিমেটোরিয়ামের পাশেই ফাঁসিমঞ্চে ঝুলানো হয়েছিলো রুডলফ হেসকে ১৯৪৭ সালে। হেস ছিলো এই ক্যাম্পের প্রথম কমাণ্ড্যান্ট।
একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম কখনোই এখানে জার্মানদের সরাসরি দায়ী করা হয় না। বলা হয় জার্মান এসএস, নাজী, গেস্টাপোদের কীর্তি এইসব। সাধারণ জার্মান সৈন্যরাও ভয় পেত ঘৃণা করত এসএস দের। যারা এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট’ বা ‘ইন দ্য টাইম অভ ডেথ , ইন দ্য টাইম লাভ’ পড়েছেন তারাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। বার্লিনের গেস্টাপো হেডকোয়ার্টারের ধধংসস্তুপ আর সেখানে সাধারণ জার্মানদের ওপর এসএস, গেস্টাপোর নির্যাতনের বর্ণনা মনে পড়ে গেলো।
ক্রিমেটোরিয়ামের চিমনি, এই ঘরটাতে দেয়া হতো হট শাওয়ার, তারপর চুলাতে...
ক্রিমেটোরিয়ামের চুল্লী...
ক্রিমেটোরিয়ামের পাশেই ফাঁসিমঞ্চে ঝুলানো হয়েছিলো রুডলফ হেসকে ১৯৪৭ সালে। হেস ছিলো এই ক্যাম্পের প্রথম কমাণ্ড্যান্ট।
ঠিক যে উদ্দেশ্যে এই ক্যাম্পটি এখন দর্শনীয় স্থান – মানুষ যাতে নৃশংসতাকে চিনতে পারে , ‘এথনিক ক্লিনজিং’ এর মত উম্মাদ ধারণাগুলোকে প্রত্যাখান করতে পারে , আর যাতে এইসব অমানবিকতার পুনরাবৃত্তি না হয়; সেটা ও মনে হয় মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। বিরকেনিঊ যাবার পথে শাটল বাসে কথা বলছিলাম চ্যামেক আর স্প্যানিশ তিন তরুণীর সাথে , গায়ে পড়ে এক প্রৌঢ় লোক তর্ক লাগিয়ে দিলো। আমি বলছিলাম, ইহুদী জাতি নিজেরাই ‘জাতিগত নির্মূল’ ধারণার শিকার , নির্যাতন কাকে বলে তাদের চাইতে আর কেউ বেশী জানে না, আবার তারাই আধিপত্যবাদী দখলবাদী নির্যাতনমুখী একটা রাষ্ট্রীয় চরিত্র কীভাবে তৈরি করে আমি বুঝি না। আমাদের আলোচনার মাঝেই সে লোক বলে বসল , এটা নাকি ’আই ফর আই’। আমি বিস্মিত। তারে বললাম, প্যালেস্টাইনিরা তোমাদের কোন চোখ কি করেছে আমাকে বুঝিয়ে দাও । তুললে তো তোমার অন্য চোখ তোলা উচিত।
অন্যান্য দর্শনার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ওই লোক চুপ হয়ে গেলো । পরে বুঝলাম উনি ছিলো ইসরায়েলি নাগরিক। এর মাঝে রাষ্ট্রের নির্যাতনমুখী ,জাত্যাভিমান ও জাতিবিদ্বেষী আচরণ নিয়ে শুরু হলো আলোচনা। একগাদা শীতকাপড়ের নিচে আমি পরে গিয়েছিলাম এলেন গীন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড’ কবিতা লেখা একটা টি শার্ট। আমাদের গাইডকে ওটা দেখালাম জ্যাকেট খুলে। তারপর শুরু হলো অবিশ্রান্ত প্রশ্ন আর বিস্ময়। অনেকেই জানে না একাত্তরে আমাদের এই ভয়াবহতম গনহত্যার কথা। এটা আমাদের চরম ব্যার্থতা। অনেককেই দেখলাম চরম ক্ষোভ আর বিষন্নতা প্রকাশ করতে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কত বড় অর্জন তা নতুন করে বুঝলাম তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে, আমাদের ক্লীবতা আর ব্যার্থতা কতদূর সেটাও বুঝলাম।
সাড়ে বারোটার দিকে আমরা বের হয়ে শাটল বাসে রওনা দিলাম বিরকেনিঊ এর দিকে।
বিরকেনিঊ পৌঁছে ঠান্ডা বাতাসে ঊড়ে যাবার মত অবস্থা হলো। ঢুকেই দেখলাম মোটামুটি প্রতীকে পরিনত হয়ে যাওয়া সেই রেলস্টেশানটি, স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ মুভিতে অনেকে যেটাকে দেখেছেন। রেললাইনের শেষে দাঁড়িয়ে দেখলাম শেষ ডিসট্যান্ট সিগন্যালটাকে, মনে হলো জীবনের শেষ, মৃত্যুর শুরু। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রায় ষাট বছর আগে এই প্ল্যাটফর্মে নেমে আসা মানুষগুলোর অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করলাম, মনে হলো ব্যার্থ চেষ্টা । সেটা একটা অসংজ্ঞনীয় অবস্থা।
এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই বাছাই হত বন্দীদের। বামে যেতে বলা হত বৃদ্ধদের , শিশুদের। মায়েদের আশ্বাস দেয়া হত, তাদের শিশুদের ফেরত দেয়া হবে , স্কুলে পড়ানো হবে। কিন্তু বাম মানেই ছিলো তাৎক্ষনিক মৃত্যু। বামে সোজা গেলেই সেই নারকীয় গ্যাস চেম্বার, যেখানে এই জাতিসত্ত্বাগুলোকে কীট ঘোষনা করে হত ‘মাস কিলিং’ ।
ঢুকেই দেখলাম মোটামুটি প্রতীকে পরিনত হয়ে যাওয়া সেই রেলস্টেশানটি, স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ মুভিতে অনেকে যেটাকে দেখেছেন।
রেললাইন ধরে বিষন্ন মনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম গ্যাস চেম্বারের ধধংসস্তুপ এর দিকে ।
ডানে যেত শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান বন্দীরা। কিছুক্ষণ পরেই যখন ব্যারাকগুলো দেখা শুরু করলাম , মনে হলো শুরুতেই যারা বামে যেত তারাই বেশী ভাগ্যবান। কাঠের তিনতলা খাঁচায় গাদাগাদি করে রাতের থাকার ব্যাবস্থা, পাঁচ মিনিটের শৌচ সুবিধা, দিনের একবার খাবার, বারো ঘন্টার মত কাজ, নির্যাতন, ছোটখাটো শাস্তি হিসাবে সারাদিন কাজের পর সারারাত শিকল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা বা জোর করে দাঁড়িয়ে রাখা, গুলি করে ফেলে রাখা এইজীবনের চাইতে তাৎক্ষনিক মৃত্যু মনে হয় অনেক বেশী প্রশান্তিকর। সর্বোচ্চ্য যে বন্দীটি টিকে ছিলো , তার মেয়াদ নয় মাস। গড়ে টিকে থাকার বয়স ছিলো তিন মাস।
রেললাইন ধরে বিষন্ন মনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম গ্যাস চেম্বারের ধধংসস্তুপ এর দিকে । ডানে বিশাল ব্যারাকের অবশিষ্ট ফেলে। সেভিয়েতরা মুক্ত করার সময় জার্মান এসএস রা পুরো ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো। গ্যাস চেম্বারের ধধংসস্তুপ এর সামনে দীর্ঘক্ষন আমরা শুনলাম কীভাবে পুরো ব্যাপারটি করা হত, একেকবারে প্রায় ২০০০-১০০০০ জন করে। মুক্তি পাওয়া কিছু বন্দী আর গ্যাস চেম্বারের ওয়ার্ডেনদের সাথে মার্চিনের কথা হয়েছে। সেই ভয়াবহ আর সংজ্ঞাহীন অনুভূতিগুলো আসলে ওই অবস্থায় না পড়লে বোঝাই যাবে না। পাশেই আছে ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট মনুমেন্ট।
গ্যাস চেম্বারের ধধংসস্তুপ ।
ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট মনুমেন্ট।
বেলা প্রায় চারটার দিকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত বিষন্ন আমরা ফিরে আসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসি বিরকেনেঊ থেকে। ঠান্ডা আবারো বাড়তে শুরু করেছ, আমাদের মনের বিষন্নতার সাথে পাল্লা দিয়ে।
অশউইৎস মুক্ত হয় সেভিয়েত সৈন্যদের হাতে পোল্যান্ড পার হয়ে ক্রাকাও হয়ে বার্লিনের পথে। দিনটা ছিলো জানুয়ারীর ২৭ তারিখ, ১৯৪৫ । বেঁচে যাওয়া বন্দীদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই যেটা ছিলো অকল্পনীয় স্বপ্ন।
এটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষিত হয়েছে, জার্মানী ও অশউইৎস মুক্ত দিবসটিকে বিশেষভাবে পালন করে, যাতে এই ভুলের আর কোনো পুনরাবৃত্তি না হয়। জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল ২০০৮ এই অশউইৎস ঘুরে গিয়েছেন, গেরহার্ড শ্রেয়েডার ও ক্ষমা প্রার্থনা করে বক্তব্য দিয়েছেন ২০০৫ এ। রুডলফ হেস (অশউইৎস এর প্রথম পরিচালক) সহ এই ‘এথনিক কিনজিং’ এর হোতাদের বিচার হয়েছে, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ও হয়েছে।
একাত্তরে আমাদের তিরিশ লাখ শহীদের আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নির্মিত যে স্বাধীনতার ছায়ায় আমাদের বসবাস পরিচয়, সেই স্বাধীনতার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আবেগ কতটুকু আসলে? খুব সংক্ষেপে তিনটি প্রশ্ন জেগেছিলো বিরকেনেঊ এর গেট দিয়ে বের হয়ে আসবার সময়-
এক. আমরা কি করেছি আমাদের আত্মদানকারী শহীদদের সম্মান রক্ষায়?
দুই. আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাবিরোধী অপশক্তির উম্মুক্ত কন্ঠ , মতাদর্শ প্রচার কোন যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য?
তিন. পাকিস্তান নামক দেশটিকে একাত্তরের গনহত্যার বিষয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা বা ব্যাখা না দিয়েই বিশ্বের কাছে চুপচাপ থাকবার অধিকার আমরা দিচ্ছি কেন?
ফিরে আসার পথে কালচে আকাশ দেখতে দেখতে আসছিলাম ।
ফিরে আসার পথে কালচে আকাশ দেখতে দেখতে আসছিলাম , মনের উপর চাপ কমছেই না। প্রায় নির্বাক আমরা সবাই, অনেকদিন ধরে ভাবানোর মত একটা জায়গা ফেলে যাচ্ছি।
ব্লগার 'মেন্টাল' এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তীরন্দাজ এর অনেক দিন আগের দুটো সম্পর্কিত পোস্টঃ
মূহুর্ত হলেও, থামুন: কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প, ডাখাউ, জার্মানী
বাস্তবের ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন, জামর্ান নাজী জোসেফ মেঙ্গেলে
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:৫৭