বিঃ দ্রঃ এই পোস্টের সব ছবিগুলোরই কোন ধরণের কপিরাইট নেই, যেহেতু ছবিগুলো সব আমার তোলা, তাই এগুলোর পুনঃব্যবহার নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই! এমনকি আপনি যদি এইগুলা নিজের নামে জাহির করেন তাহলে তো আমি আরো খুশি...HAPPY FAPPENING…!
সিলেটের দিকে ঘুরবার ব্যাপারে আমার তকদির সবসময়ই বেঈমানী করে আসছিল, কোন না কোন ঝামেলার কারণে যেতে পারছিলাম না-আর একবার তো হবিগঞ্জ থেকেই ফিরে আসলাম!
ভাইয়ের কথামত একখানা লাইফ জ্যাকেট সাথে নিয়ে ক্যামেরাখানা বগল দাবা করে বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিলাম উত্তরা থেকে। সাথে আবার যোগ দিল ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ আর বিজনেসম্যান ওবায়দুল ভাই, দুজনের সাথেই প্রথম পরিচয়। কিছুটা অসামাজিক আমি কিভাবে এই সম্পূর্ণ নতুন দলের সাথে মিশব তাই নিয়েই চিন্তিত ছিলাম কিছুক্ষণ...নাহ পরে দেখলাম সবাই বেশ মিশুক। আমাদের সাথে আরো একটা ডিফেন্স পার্সোনেলদের গ্রুপ যোগ দিলে-এরাও সিলেট যাচ্ছে...রাতারগুল, বিছানাকান্দি, পাংতুমাই ব্লাহ ব্লাহ দেখবে বলে-বুঝলাম সিলেটে বাদ জুম্মা নিশ্চিত মেলা বসবে!
বাস রওনা করল আশুগঞ্জ রুট ধরে, বোধকরি এর চেয়ে পুরান ঢাকার চিপাগলিও অনেক চওড়া, আর বেটা ড্রাইভারগুলাও হতচ্ছাড়া, চালায় ঠিক NFS এর মত! বাস জার্নি টা কখন জানি শেষ জার্নি তে পরিণত হয় এই আতঙ্কেই সময় পার করছিলাম! পিছনের সিটে সিলেটগামী যাত্রী ছিল বেশ কয়েকজন-অস্বাভাবিক মধুর (!) সিলেটি ভাষায় তারা এমন সব দুর্বোধ্য কথা চালাচালি করছিল যে চিন্তায় পড়ে গেলাম-কিছু সিলেটি শব্দও তো শিখে আসা দরকার ছিল! আমার এক সহযাত্রী তো তাদেরকে আবাল উপাধী দিয়ে দিল-কিন্তু আমি যা বুঝলাম তা হল-এরা কতিপয় চালাক প্রাণী-কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলছে বলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করছে-নাহলে তারা বেশ ভালই কথা বলতে পারে শুদ্ধ বাংলায় !
রাস্তায় ভীষণ জ্যাম ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে গেলে বোধকরি এতটা বিশ্রী জ্যামে পড়তে হত না! যাইহোক, কয়েক ঘন্টা বেশি সময় ব্যয় করে সিলেটে সকালে এসে পৌছলাম, উঠলাম গণপূর্তের রেস্টহাউজে! কান ব্রীজের পাশেই, সাথে আছে ঘড়িঘর-কিন্তু কান ব্রীজের নিচের নদীটির নামটিই জানা হয়নি আমার কারো কাছে!
রেস্ট হাউসে আর সময় ব্যয় না করে রওনা হলাম সকালের নাস্তা শেষ করে আসল পাঠ চুকাতে। এক আলিশান রেস্তোরাতে ঢুকলাম-নাম হল পানসী! আলিশান এই অর্থে যে এই পুচকে শহরে যেই তার ডেকোরেশন সেই তার খাবারের মেনু! আমি মনে মনে ভাবলাম শালা টিম মেম্বারের বাচ্চারা! এত দামী জায়গায় আসলা, আমি তো এবার ফকির হয়ে যাব! ভয়ে ভয়ে খেতে শুরু করলাম। আমাদের সাথে এসে যোগ দিল ধ্রুব নামের একটা ছেলে, সিলেটেই বাড়ি ওদের-ক্যাপ্টেব সাজ্জাদ তার বিশাল তেলেসমাতিরগুণে তার সাথে যোগাযোগ করেছিল আগেই-কথা ছিল তারা আমাদের পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। ভাবলাম ভালই তো পড়াশুনার পাশাপাশি ট্রাভেল গাইড হিসেবে যদি কিছু আয় করতে পারে তাহলে অনেক ভাল, দেশ তো আসলেই এগিয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু পরে টাস্কি খেলাম এই শুনে যে এই পোলাপানগুলো নাকি আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে কিন্তু টাকা নিবে না! কেমনে কি!!!? এইগুলা পাগল নাকি! হজম করতেই কষ্ট হল পুরো ব্যাপারগুলো!!! এরা কি ধাতুর তৈরি?! ধ্রুবের বদলে কোন এক কারণের আমাদের গাইড হল ধ্রুবেরই বন্ধু জয়, দুজনেই সিলেট পলিটেকনিকে পড়ে।
যাইহোক উপরের ধাক্কা সামলাতে না সমালাতে আরেকটা ধাক্কা খেলাম-পানসী এমন এক গরুর মাংসের কারি দিল যে আমি এ জীবনে তা প্রথম খেলাম-পুরাই অমৃত! কিন্তু ব্যপার হল একটা দুধ চা দিল যেটা দেখতে ঠিক লাল চায়ের মত!
এতসব পজিটিভির ভেতর দিয়ে সিএনজি করে রওনা হলাম পাংতুমাই যাব বলে, ভাড়া বেশি হলেও গায়ে লাগল না, শেয়ার করছে সবাই। আবারো দীর্ঘ গ্রান্ড থেফট অটো টাইপের সিএনজি জার্নি শেষে হাদারপাড় বাজারে গিয়ে পৌছালাম-এক সিনিয়র মেজর ভাইয়ের সাথে আরেকগ্রুপ এসে আমাদের সাথে যোগ দিল-২৫০০ টাকা দিয়ে বোট ভাড়া করা হল। টানা রোদে যাত্রা শুরু করলাম পাংতুমাই এর উদ্দেশ্যে-নদীর দু পাড়ের দৃশ্য এতটাই দারুণ যে কোন ভাবেই তা প্রকাশ করতে পারব না! মিনিট চল্লিশেক পর গিয়ে পৌছালাম পাংতুমাই-এবার একটা ভিরমি খেলাম-মন্দের! সুন্দর এক ঝর্ণা, এটা নাকি আমাদের ভেতরে না-ভারতের ভেতরে! মনে মনে ভাবলাম হতেই পারে! সাথে জুম লেন্স ছিল না তাই এত দূর থেকে ছবি তুলে মজা পেলাম না! ফটোগ্রাফারদের বলব, জুম না থাকলে পাংতুমাই গিয়ে লাভ নেই-এত দূরে ঝরণা আর সূর্য সবসময়ই একদিকে এভাবে হেলে থাকে যে ওয়াইড লেন্সে কোন কাজে আসে না!
যাই হোক, পরে পাংতুমাই এর পাঠ শেষ করে লক্ষণছড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম! নদীপথে এই জার্নি টা আমার অনেকদিন মনে থাকবে, আসলেই আদ্ভুদ এই রুট, তবে ডাকাতির জন্য বেশ ভাল! এতটাই নীরব যে সন্ধ্যা হলেই কাত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে!
অবশেষে লক্ষ্ণণছড়া গিয়ে পৌছালাম! এবার আসলেই কষ্ট পেলাম এই দেখে এখানেও ঝর্ণা আর সুন্দর আরেকটি ব্রীজ দুটোই ভারতে ভেতর! মেজাজটাই গরম হয়ে গেল! বেটা, ব্রিটিশের বাচ্চাগুলোরে মনে হচ্ছিল ঐখানে পেলে ঐখানেই পুঁতে ফেলতাম! হতচ্ছাড়ার দল! দিবি দে, তাই বলে সব???
খুব ভাঙ্গা মন নিয়ে বিছানাকান্দি গেলাম, কাহিনী ঐ একই, ব্লাহ ও ব্লাহ! তবে বিছানাকান্দি জায়গাটি আগের দুটার চেয়ে বেশ ভাল! দেখার মত!
গ্রুপের সাথে গেলে এই এক সমস্যা, মন বড় চাইছিল ওখানকার সানসেটের ছবি তুলব, কিন্তু জামাতের নির্দেশিত পথই যে আমাকে অনুসরণ করতে হবে! অতঃপর সিএনজি যোগে আবার রেস্টহাইজে ফিরে আসলাম! রাতে আবার সেই পানসী! জিনিস একটা আসলে!
পরদিন সিনিয়রমুক্ত একটি যাত্রা শুরু করলাম-গন্তব্য রাতারগুল ফরেস্ট! সোজা সিএনজি যোগে রাতারগুলের সামনে পৌছালাম-এক ডিঙ্গি টাইপের নৌকা নিয়ে সোয়াম্প ফরেস্টের ভেতরে গেলাম-সাতার না জানা লোকের এখানে লাইফ জ্যাকেট নেয়া ফরয!
দেখতে খানিকটা ম্যানগ্রোভের মত হলেও রাতারগুলে বেশ আলাদা একটা ভাব আছে! বুঝিনা, বাংলা ছবিত শেষ দৃশ্য কেন এখানে করে না! জলিল স্যারকে বলে দেখব ভাবছি! বনের ভেতরে গিয়ে একটা ঝমেলায় পড়লাম! নৌকা এত পরিমাণে দোল খায় যে HDR তুলতে পারলুম না একটাও ঠিক করে! যাই হোক অসমাপ্ত একটা ওয়াচ টাওয়ারের উপরে গিয়ে কিছু ছবি তুললাম, তবে মন ভরল না! তবে ম্যাক্রো শুটারদের জন্য রাতারগুল বেশ ভাল জায়গায়! কীটপতঙ্গগুলো একটু আবুল কিসিমের! ভয় পায় না তো পায় ই না! সাথে ম্যাক্রো লেন্স ছিল, তবে একটাও তুলতে পারলুম না! কি লাগাব কখন? এই প্রাইম তো এই ওয়াইড না হয় আবার প্রাইম! এই প্রথম বুঝলাম, কেন মানুষ দুইটা ডিএসএলআর বডি রাখে! সিলেট গেলে দুট বডি থাকলে দুটোই নিয়েন! নাহলে পেইন খাবেন!
রাতারগুলের পাঠ শেষ করে লালখানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম! পথে “লকলকি” নামক এক সিলেটি ফল খেলাম যেটাকে টিপে টিপে খেতে হয়! এই টেপাটিপির ভেতর ক্যাপ্টেন সাজ্জাদতো একটা ১৮+ স্ট্যাটাস ই বানিয়ে ফেলল!
যাইহোক, লালখানে গেলাম, বোট ভ্রমণ করলাম-পানিটা বেশ দারুণ পুরোই নীল! পরে লালখান টিস্টেটে গেলাম-আফসোস! বহুদিনের শখ, চা তুলছে কেউ সে ছবি তুলব-তা আর হলনা! সেই সাজ্জাদ সাহেবকেই আবার মডেল বানালাম!
লালখান থেকে আসার পথে এক মেয়ের সাথে চোখাচোখি হল, পরে দেখলাম এক কর্ণেলের মেয়ে-ভয় পেলাম! এব নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখলাম! পৃথিবী আসলেই নিষ্ঠুর! কোন এক UTOPIAN নগরীতে সে হয়ত আমার বাচ্চাকাচ্চার মা হতে পারত :p
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রওনা দিলাম জাফলং এর দিকে, টার্গেট ছিল শেষ বিকেলে ছবি ধরা! ভাগ্য এতটাই ফাইযলামি করল যে এইদিনও শেষ বিকেলে ছবি মিস করলাম!
জাফলং এর আগে নলগিড়ি নামক জায়গাতে নামলাম, জেলা পরিষদের বাংলোতে গিয়ে উঠলাম। পাহাড়ের উপর বাংলো, ঢুকেই দেখি আলিশান ব্যাপার সেপার! কি অবস্থা! নিজেকে তো তখন রাজা রাজা লাগছিল! বাংলোর বারান্দা থেকে মেঘালয়ের ঝরণা স্পষ্ট দেখা যায়! টাস্কি খেলাম পরিবেশ দেখে! আমি তো পুরাই পিনিকে! শুধু ভবিষ্যতের বউটিকে মিস করলাম! বেচারি! না জানি কোন জঙ্গলে পড়ে আছে! কপালে সুখ এখনো এল না! রাতে পাহাড়ি নাশপতি খেলাম! কি জিনিস মাইরি! পুরাই প্রেমে পড়ে গেলাম! আসার দিন এওত খুজলাম তাও পেলাম না!
রাতে কম ঘুমালাম সকালে ছবি তুলব বলে! শালার কপাল, এ যাত্রায় ও বাটপরি করল!
এসে সকালে নাস্তা করলাম “ক্ষুধা” রেস্তরা তে’। আমি IBS এর রোগী, নরমাল খাবারই খেলাম কিন্তু আমার সফরসঙ্গীরা বাঁশে রাধা এক বিশেষ ধরণের হাসের মাংস খেল! পুরাই অস্থির! রেস্তরার মালিক একজন স্বশিখিত ব্যাক্তি, তিনি তার বেশ কিছু কবিতা শুনালেন, যদিও বিরক্তি ভরএই শুনছিলাম-তবে পরে মনে হয়েছে তিনি আসলেই প্রশংসার দাবিদার! এমন দুর্গম এলাকাতে কিভাবে এই লেখালেখির চর্চার চালিয়ে যাচ্ছেন! তবে ভদ্রলোকের একটা কথা দারুণ মনে ধরেছিল!
তাকে বললাম, বর্ডার কোথায়? তিনি জবাব দিলেন,”যেখান থেকে দেখবেন পাহাড় কাটা আর হচ্ছে না, পাথর আর তোলা হচ্ছে না, পরিবেশ অটুট আছে সেটা ভারত-আর যেখানে হচ্ছে সেটা বাংলাদেশ”। শুনে বেশ কষ্ট পেলাম-কিন্তু পরে দেখলাম আসলেই তো!!! আমরা কেন এমন???!
কিন্তু হঠাত কোন এক বিষয়ে বি এস এফের সাথে আমাদের গোলযোগ দেখা দিল! তারা দাবি করল আমারা তাদের সীমানা অতিক্রম করেছি! কিন্তু আমরা আসলে তখন ও এদেশেই ছিলাম! আমার সহযাত্রীরা নিজেদের পরিচয় দেয়ার পরও কোন তোয়াক্কা করল না! মনে হল আজ যদি বেটা তুই পুচকে দেশের লোক হতি তাহলে তোকে এখানে এই ব্যবহারে জন্য পানিতে চুবাতাম!
পরে তো ঐ হতচ্ছাড়াগুলো আমাদের অনেকক্ষন নজরে রেখেছিল, ভয়ই পেয়েছিলাম! না জানি নিজেই ফেলানি হয়ে যাই!!!
খাসিয়া পল্লীর ভেতরে গেলাম এরপর! ছবি তুললাম না, কারণ একজায়গায় গেঞ্জাম পাকিয়ে এসে আরেক জায়গায় ঝামেলায় পড়তে চাই নি বলে! ওখানকার টি গার্ডেন একটু দেখে তারপর এপাশ থেকে জাফলং এর কিছু ছবি তুলে খান্ত হলাম!
পরে এই যাত্রা শেষ করে বাংলোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম, বিকেলে বাস, মিস করা যাবে না! এসে সিলেট স্টেশনে এসে কিছু ছবি তুললাম,
যাইহোক সিলেট ভ্রমণ শেষ করে বাসে সেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম-আর ভাবতে লাগলাম কি কি পেলাম এই ট্যুরে আর কি কি পেলাম না! এক কথায় বলতে গেলে সিলেট বেশ সুন্দর-খানিকটা দেশীয় সৌন্দর্য-তবে বান্দরবনের মত অন্য কোথাও আসছি- এমনটা মনে হবে না! সিলেটি মানুষজন সবাইকে তুমি বলে আর তারা অনেক বেশি মিশুক-এটাতে বিরিক্ত হতে পারেন কেউ কেউ-তবে মেনে নিবেন এসব! আর পানসী তে তো খাবেন অবশ্যই-আর ধ্রুব দের মত ভাল একটা গাইড নিবেন, তাহলেই পুরো ভ্রমণ টা উপভোগ্য হবে!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৯