মানুষের চিনি ও গুড়ের চাহিদা পূরণ করতে দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে আখ চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চিনি ও গুড়ের চাহিদা প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন। সেখানে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ টন চিনি ও ৬-৭ লক্ষ টন গুড় উৎপাদন হয় (সূত্র: বিএসআরআই ওয়েব সাইট)। এ অবস্থায় প্রশড়ব আসতেই পারে কেন প্রায় ১০লক্ষ টন চিনি/গুড়ের উৎপাদন ঘাটতি থাকার পরও জৈব জ্বালানী উৎপাদনের প্রসঙ্গ আসছে ?
আখ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আখের চাষ আশংকাজনক হারে অনেক কমে যাচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে যেখানে বাংলাদেশে প্রায় ৩ লক্ষ ৭১ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হতো সেখানে আখ চাষ কমতে কমতে ২০১১-১২ অর্থ বছরে ২ লক্ষ ৬৬ হাজার একরে দাঁড়িয়েছে (সূত্র: বিবিএস ২০১২)। সারাদেশে আখ চাষ এত কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে চাষীরা সুগার মিলে সরকার নির্ধারিত মূল্যে প্রতি মণ আখ মাত্র ১০০ টাকায় বিμি করা এবং পুর্জি পাওয়া সহ মিলের নানা রকম সমস্যা ও জটিলতাকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে গুড় উৎপাদনকারী চাষীরা চিনির দাম কম থাকার কারণে গুড়ের মূল্য পাচ্ছে কেজি প্রতি ৪০-৪৫ টাকা যা বিগত সময়ের তুলনায় অনেক কম। এভাবে সারা বছর পরিচর্যার মাধ্যমে আখ চাষ করে মিলে আখ দিলে বা গুড় এলাকার চাষীদের ১ বিঘা (৩৩ শতক) জমি থেকে মাত্র ৫-১০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে যা মাত্র তিন মাসের স্বল্প মেয়াদী অন্যান্য ফসল থেকে সহজেই উপার্জিত হচ্ছে ফলে বর্তমানে বহু বছর ধরে আখ চাষ করে আসা কৃষকের জন্য এটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাষীদের অবস্থা এমন বেগতিক হয়েছে যে বর্তমানে মিল গেটে ১ মণ আখের দাম মাত্র ১০০টাকা আর ১ মণ খড়ির দাম ২০০-৩০০ টাকা। ফলে তাদের মনে হচ্ছে আখ জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করলেও তাদের বেশি লাভ হবে। এটাতো গেলো চাষীদের বিড়ম্বনার কথা। এখন দেখা যাক মিলগুলোর র্দুরাবস্থার কথা। মাত্র ১০০ টাকা মণ আখ কিনেই ১ কেজি চিনি উৎপাদন করতে মিলের খরচ হচ্ছে ৮০-৮৩ টাকা আর বিμি করতে হচ্ছে ৩৭-৪০ টাকা ফলে ১৫ টি সুগার মিলের ১৫ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়ে ২০১২ সালে লোকসান হয়েছে প্রায় ৮২৯ কোটি ৪২ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা (সূত্র: পাক্ষিক কৃষি বিল্পব ১৪-২৮ এপ্রিল,২০১৪)। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬টি রিফাইনারী বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি নিয়ে এসে পরিশোধন করে কম মূল্যে বিμয় করছে এবং মিলগুলোকে সরকার নির্ধারিত রেটে মাত্র ৪০ টাকা কেজি দরে চিনি বিμি করতে হচ্ছে ফলে লোকসানের পরিমানটি এত বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
জৈব জ্বালানী হিসাবে মূলত ইথানল ব্যবহার করা হয়। আখের রস বা মোলাসেস (চিটাগুড়) থেকে প্রথমে ইথানল তৈরী করা হয়। এই ইথানল গ্যাসোলিন (পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল) এর সাথে ২০-২৫% হারে মিশ্রিত করে অথবা পুরোটাই সরাসরি ইঞ্জিন চালিত যানবাহনে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ইঞ্জিনের সামান্য কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। গ্যাসোলিনের (পেট্রোল,অকটেন,ডিজেল) পরিবর্তে জ্বালানী হিসেবে ইথানল ব্যবহার করলে ৯০% কার্বন ডাই-অক্সাইড (গ্রীন হাউজ গ্যাস) নির্সরণ কম হয়। এটি ব্যবহারে ইঞ্জিনের শব্দ কম হয় এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বায়ু দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্যই, আধুনিক বিশ্বে ইথানলকে টেকসই জৈব জ্বালানীর অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আমরা যদি আখ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা দেশ গুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় যে, আখ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ব্রাজিল তার মোট উৎপাদনের ৫৬% আখ জৈব জ্বালানী (ইথানল) উৎপাদনে ব্যবহার করে এবং প্রতিটি ইঞ্জিন চালিত গাড়িতে বাধ্যতামূলক ভাবে ২০-২৫% ইথানল মিশ্রিত গ্যাসোলিন ব্যবহৃত হচ্ছে (সূত্র: ইন্টারনেট)। সে দেশে সুগার মিলেই গ্যাসোলিনের সাথে ইথানল মিশ্রিত করে তারপর পেট্রোল পাম্প গ্রুলোতে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং জনসাধারণ সেখান থেকেই ফুয়েল(জ্বালানী) হিসেবে ব্যবহার করছে।
জ্বালানী নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতের সরকার ২০০৯ সালে জৈব জ্বালানী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সেখানে ২০১৭ সালের মধ্যে ২০% ইথানল মিশ্রিত জ্বালানী ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে (সূত্র: দ্যা ইকোনোমিক টাইমস,২০০৯), চীনেও ২০২০ সালের মধ্যে ১৫% ইথানল মিশ্রিত গ্যাসোলিন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে (সূত্র: ডন ২০০৭)। শুধু মাত্র চীন ও ভারত নয় যেসব দেশে আখ উৎপাদিত হয় যেমন পাকিস্থান, তুরস্ক, ম্যাক্সিকো, থাইল্যান্ড প্রায় সব দেশই এ পথে হাঁটছে।
অনেকে মনে করেন, জৈব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারের জন্য আখের উৎপাদন বৃদ্ধি করলে অন্যান্য খাদ্য-শস্যের সাথে জমির প্রতিযোগিতা হবে এবং এর পাশাপাশি খাদ্য-শস্যের উৎপাদন কমে এর মূল্যবৃদ্ধির আশংকাও করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, উনড়বয়নশীল দেশ যাদের জনবল প্রচুর তারা (ভারত, চীন, ব্রাজিল) এটিকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে। কারণ, গ্রামের দরিদ্র
অভাবী মানুষরাই আখ উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকে এবং এটির উৎপাদনে প্রচুর শ্রমিক লাগে ফলে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এছাড়াও এ শিল্প বিস্তারের জন্য রাস্তাঘাটসহ আরও অনেক অবকাঠামো (যেমন সুগারমিল, স্কুল, কলেজ, বাজার) নির্মাণ করা হয়। ফলে, সত্যিকার অর্থে গ্রামীণ জীবন যাত্রার মান উনড়বত হয়। এজন্যই পৃথিবীর আখ উৎপাদনকারী প্রায় সকল দেশই এখন জ্বালানী নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ ও দরিদ্র বিমোচনের জন্য জৈব জ্বালানী উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ আখ উৎপাদন করে যেহেতু চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, চিনিকলগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সর্বোপরি দেশের বিরাট লোকসান হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ আখ উৎপাদনের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ চাষী ও সুগার মিলকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে অন্যান্য দেশের মত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে জৈব জ্বালানী তৈরীর বিকল্প নেই। কারণ, ১ টন আখ থেকে চিনি (রিকভারী ৭.৫০% হলে) পাওয়া যায় ৭৫ কেজি যার বর্তমান বাজার মূল্য ৭৫দ্ধ৪০=৩০০০ টাকা। আর ঐ আখ থেকে প্রায় ৮৫ লিটার জৈব জ্বালানী (ইথানল) পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য দাড়ায় (১০০দ্ধ৮৫)= ৮৫০০ টাকা। আর জ্বালানী তেলের দাম কয়েক দিন পর পরই অনেক বড় মারজিনে (ব্যবধানে) বাড়ছে। ভবিষ্যতের কথা বাদই দিলাম, বর্তমানেই এটি উৎপাদন করে প্রায় ৩ গুণ বেশি অর্থ আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশে শুধুমাত্র কেরু এন্ড কম্পানীতে মোলাসেস (চিটগুড়) থেকে ইথানল তৈরি করা হয় এবং তা পানীয় হিসেবে ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার হয়, জৈব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। এ মিল থেকে প্রতিবছর ৬০-৭০ কোটি টাকা আয় হয় (সূত্র: কেরু এন্ড কোম্পানী)। কিন্তু বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ হিসেবে আমরা ইথানলকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না তবে নিয়ন্ত্রিত ভাবে জৈব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারে তো দোষের কিছুই নেই। অন্যান্য মিলের মোলাসেস বিμি না করে এগুলো দিয়ে জৈব জ্বালানী (ইথানল) উৎপাদনে ব্যবহার করলে এবং প্রয়োজনে কিছু আখের রস দিয়েও জৈব জ্বালানী উৎপাদন করে সুগার মিলেই গ্যাসোলিনে মিশ্রিত করে পেট্রোল পাম্প গুলোতে গ্যাসোলিনের তুলনায় কিছুটা কম মূল্যে বিμি করলে মানুষ সহজেই তা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করবে।
জৈব জ্বালানী উৎপাদন করলে যে লাভ হবে তা দিয়ে সুগার মিলের চাষীদের আখের মূল্য অনেক বেশি দেয়া যাবে। আখের মূল্য বেশি পেলে চাষীরা আখ চাষ করবে, মিলও লাভবান হবে। আবার লাভের এ অর্থ দিয়ে চিনি উৎপাদনে ভর্তুকি দিলে সরকারকেও প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা লোকসানের ঘাঁনি টানতে হবে না। সব মিলিয়ে, এ শিল্পটি সুন্দর ভাবে টিকে থাকবে।
আর যেহেতু সুগার মিলগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান তাই চিনির দাম বিশ্ব বাজারে খুব বেড়ে গেলে সরকার চাইলেই মিলে জৈব জ্বলানী উৎপাদন কমিয়ে চিনি উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে পারবে। এভাবে রিফাইনারী গুলোকে সরকার সহজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। সুতরাং আশংকার কোন কারণই নাই যে, চিনি উৎপাদন যেটুকু হচ্ছে তার উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৫.৬৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানী তেল আমদানী করেছে যার জন্য প্রায় ৫.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩ হাজার ৫ শত ৬০ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে ( সূত্র : ওয়বসাইট)। এত বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করে আমাদের জ্বালানী তেল সংগ্রহ করতে হচ্ছে এবং প্রতিবছর এর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং আমরা যদি জৈব জ্বালানী এর সাথে মিশ্রিত করি (২০-২৫% হারে) তাহলে একটি বিশাল অংকের টাকা সাশ্রয় হবে যা বাংলাদেশের অন্যান্য উনড়বয়ন মূলক কাজে ব্যবহার করা যাবে।
পরিশেষে, এ কথাই বলা যায় যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত জৈব জ্বালানী (ইথানল) ব্যবহারের মত যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে চিনি শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
লেখকবৃন্দঃ
এইচ.এম.আল-আমিন, মো. রাশেদুল ইসলাম, হিমাদ্রী প্রসাদ রায় ও মো. এলমুর রেজা
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২৭