কিউবা তথা স্প্যানিশ আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির নাম নিকোলাস ক্রিস্তোবাল গ্যিয়েন । ১৯০২ সালে জন্ম নেওয়া এই মহান কবির অনুপ্রেরণা ছিল মূলত কালো মানুষ এবং সামাজিক অসঙ্গতি । আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি গারসিয়া লোরকার কাছে কিউবার সত্যিকার পরিচয় ছিলো , এ শুধু হোসে মারতিরই দেশ নয় , নিকোলাস গ্যিয়েনেরো দেশ । লাতিন আমেরিকার "কালো হোমার" গ্যিয়েনের কবিতার বিষয় কালোদের জীবন আর বহমান ঐতিহ্যের স্মৃতি ।
কিউবার কামাগুয়েতে জন্মগ্রহন করা এই কবি হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন কিন্তু আইন পেশা ত্যাগ করে সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করেন । তাঁর কবিতা ১৯২০ এর দশকের শুরু থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ১৯৩০ সালে তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ Motivos de son বা শব্দ- সঙ্গীতের উদ্দেশ্য তৎকালীন সময়ে পাঠক ও সমালোচকদের উদ্দীপিত মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল । এর সাথেও আফ্রো- কিউবান নামে এক নতুন ও জনপ্রিয় ধারার সংগীতেও তাঁর এই কাব্য গ্রন্থটির প্রভাব ছিল যথেষ্ট ।
তাঁর বাবা ছিলেন কিউবার স্বাধীনতা -যুদ্ধে জড়িত এবং একটি পত্রিকার সম্পাদক । গ্যিয়েনও প্রেসের কাজকর্ম থেকে হয়ে উঠেছিলেন সাংবাদিক । সম্পাদনা করতেন "লিস" নামে এক সাহিত্য পত্রিকা । বাবার রাজনৈতিক আলোচনা শুনে আর বাড়ির লাইব্রেরির পুরনো পুঁথিপত্র থেকে গড়ে উঠেছিল গ্যিয়েনের কিশোর বয়স ।
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ওয়েস্ট ইন্ডিস লিমিটেড । এটা পাঠ করলে গ্যিয়েন এর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় আর সেই বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়ে প্রকাশিত হয় Cantos para soldados y sones para turistas (1937) - " সৈনিকদের জন্য গান এবং ভ্রমণ কারীদের জন্য বাজনা । কিউবার কালো মানুষ , আদিবাসী আর সমাজের প্রতি একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতা ছিল তার উপরের কাব্য গ্রন্থ দুটিতে ।
১৯৩৩ সালে কিউবার স্বৈরাচারী জেরার্ডো মাচাদো শাসনের সময় রাজনৈতিক দমন , নিপীড়ন তীব্রতর হয় । ১৯৩৬ সালে তাঁর সম্পাদিত "মেডিওডিয়া" পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কিছু সময় জেলে কাটান । ১৯৩৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক লেখক কংগ্রেসে যোগদানের জন্য প্রথম স্পেন সফর করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের যুদ্ধের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব নিয়ে আলোচনা করা ।
গ্যিয়েনের কবিতা ক্রমশ মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে উঠছিল । ফলে ১৯৫৩ সালে, স্বৈরাচারী ফুলজেনসিও বাতিস্তা সরকার তাকে চিলি ভ্রমণের পর কিউবায় পুনরায় প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং তাঁকে পাঁচ বছর নির্বাসনে কাটাতে হয় ।
১৯৫৮ সালে গ্যিয়েন এর নতুন Elegías এলিজি প্রকাশিত হয় । এই কাব্য গ্রন্থটিতে স্পস্ট হয়ে যায় যে , গ্যিয়েন ফিদেইল কাস্ত্রোর বিপ্লবের সক্রিয় সমর্থক এবং তাঁর আদর্শের অনুসারী । এই এলিজিতে শুধু কুবা নয় সমস্ত লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী ইতিহাস থেকে তৈরি হয়েছে গ্যিয়েনের রাজনৈতিক কবিতার চালচিত্র ।
১৯৫৯ সালের কিউবান বিপ্লবের পর, নতুন রাষ্ট্রপতি ফিদেঈল কাস্ত্রো গ্যিয়েন কে নির্বাসন থেকে কিউবায় স্বাগত জানান । ১৯৬১ সাল থেকে তিনি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে Unión de Escritores y Artistas de Cuba ন্যাশনাল কিউবান রাইটার্স ইউনিয়ন এর সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন ।
তাঁর কবিতা ও গানের সমাহার মানুষকে মুগ্ধ করেছে । কারন কবিতায় উঠে এসেছে কিউবার মানুষের যন্ত্রনার কথা , মুক্তির আকাঙ্খা এবং বিজয়ের বার্তা । কিউবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর সবার মতোই নিকোলাস গ্যিয়েন সুবিচারের আশায় উল্লাসিত হয়েছেন । Canta el sinsonet কবিতায় যেন কবির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছেঃ
মাঠে এলো সদ্য বৃষ্টির গন্ধ ।
এক বাদামী মেয়ে আর এক গৌড়
একসাথে হাঁটছে একই পথে ,
দুজনের মাথায় বন্ধুত্বের মুকুট ।
বাতাসের রঙ সবুজ । গলা নকল করে পাখিটা গায় কি আনন্দে !
সুপ্রভাত ফিদেইল !
নিকোলাস গ্যিয়েন অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ “আমার আছে” (Tengo 1964) , “মহান চিরিয়াখানা” ( El gran zoo 1967 ) , নগ্ন চাকা (La rueda dentada 1972 ) এবং “দিনলিপির পরে কেন দিনলিপি” (El diario que a diario 1972) যেগুলো কিউবান দ্বীপপুঞ্জের সর্বাত্মক জীবনের প্রতিধ্বনি ।
নিকোলাস গ্যিয়েন ১৯৮৯ সালে ৮৭ বছর বয়সে পারকিনসন রোগে মারা যান । তাঁকে হাভানার কোলন কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং কিউবার জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৫:১২