বাংলা সাহিত্যে মনস্বী প্রাবন্ধিক ও তত্ত্বচিন্তক শিবনারায়ণ রায় এক নাক্ষত্রিক ব্যক্তিত্ব। মানবতন্ত্রের মূল প্রত্যয় তিনি বিশ্বনাগরিক , বিবেকী ভাবুক , দায়িত্বশীল চিন্তক , শিক্ষাবিদ , মৌলিক মানবতাবাদী ( Radical Humanist) , দার্শনিক , ইতিহাসবিদ , সাহিত্য সমালোচক তথা বিশিষ্ট সম্পাদক শিবনারায়ণ রায় । তিনি সর্বদা , সর্বত্রই নাস্তিক্য , যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির মুক্তি ও মানবতাবাদের পক্ষে সক্রিয় থেকেছেন । সে জন্যই বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল একদা শিবনারায়ণ রায়ের উপর মন্তব্য করে বলেছিলেন “ শিবনারায়ণ রায় দাঁড়িয়েছেন সেই মতের পক্ষে যেটাকে আমি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ... তাঁর লেখা আমাদের সময়ের অধিকাংশ লেখকের চেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে প্রকাশিত। “
তাঁর লেখা ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ , যেমন সাহিত্য চিন্তা ১৯৫৬ , নায়কের মৃত্যু ১৯৬০ , মৌমাছিতন্ত্র ১৯৬০ , কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা ১৯৭৩ , গণতন্ত্র , সংস্কৃতি ও অবক্ষয় ১৯৮১ , রবীন্দ্রনাথ শেক্সপিয়র ও নক্ষত্রসংকেত ১৯৮৩ , স্রোতের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ , রেনেসাঁস ১৯৯২ , স্বদেশ , সকাল স্বজন ১৯৯৬ , যে আলোকে অনেক আঁধার ১৯৯৮ , প্রত্যয় , অন্বেষা ও অনুচিন্তন ২০০১ , খাড়াইয়ের দিকে ২০০২ , বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা ২০০৩ , জিজ্ঞাসার দশ দিগন্ত ২০০৪ , লাঠি থেকে লাটাই ২০০৫ , এবং কাব্যগ্রন্থ খোয়াব দেখি সত্তরে , মাইকেল! মাইকেল , কথারা তোমার মন ইত্যাদি গ্রন্থের বৈচিত্রসমৃদ্ধ প্রবন্ধগুলিতে তথ্য এবং গুটিকয়েক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তাঁর মনীষার প্রগাড় প্রদীপ্তি , নতুন ভাবনা , চিন্তনের অকুণ্ঠ জিজ্ঞাসা সুপ্ত ভঙ্গিমায় দীপিত হয়েছে ।
সেই প্রদীপনে এবং বিশ্বমনীষার মানচিত্রে সেকালের পাশ্চাত্যের হোমার – দান্তে , শেক্সপিয়র- গেটে , ব্লেক-মিল্টন প্রমুখের সৃষ্টি জগত যেমন বাদ পরে নি তেমনিই বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যের মধুসূদন , বঙ্কিম , রবীন্দ্রনাথ , শরৎচন্দ্র , নজরুল এবং তাঁর সমকালের জীবনানন্দ – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – বিষ্ণু দে প্রমুখ মনীষার সৃষ্টির ঐশ্বর্য ও দর্শন , তাঁর যুক্তি ও মননের নতুন ভাষা ও ভাবনায় বাঙালি পাঠককুলকে নতুন পাঠবীক্ষায় উন্নীত ও দীক্ষিত করতেও সচেষ্ট থেকেছে সর্বদা।
মনে , প্রাণে , ধ্যানে –ধারনায় শিবনারায়ণ রায় কিন্তু রেনেসাঁসের প্রতীক পুরুষ ।
তাঁর রেনেসাঁস সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতে পাশ্চাত্যের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস , প্লেটো , অ্যারিস্টটল , রাসেল এবং প্রাচ্যদেশীয় রামমোহন , ডিরোজিও , অক্ষয়কুমার দত্ত , মানবেন্দ্র রায় প্রমুখের জীবন জিজ্ঞাসাকে তিনি তাঁর রেনেসাঁস সংক্রান্ত লেখার বিষয় করে সমাজ পরিবর্তনের যুক্তিসম্মত পথ ও পাথেয় এষণায় ব্যাপৃত থেকেছেন ।
শিবনারায়ণ রায়ের দর্শন ও রাজনীতি চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে “মৌমাছিতন্ত্র” কেই মনে করেন অনেকে । মৌমাছিতন্ত্র মূলত কমিউনিজমকে সমালোচনা করে লেখা । শিবনারায়ণ মনে করতেন ব্যাক্তিসত্তার বিলোপ এবং রাষ্ট্রের প্রতি কঠোর আনুগত্য একদিন পৃথিবীতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর পতনের অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়াবে । এই গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন ষাটের দশকে , যখন পৃথিবী ব্যাপী চলছে কমিউনিজমের জয় জয়কার । তাঁর অভিমত ছিল যে রাষ্ট্র থেকে প্রেম ও সৃষ্টি নির্বাসিত , সেখানে স্বাধীন চিন্তা নিষিদ্ধ । সেখানে বৈচিত্র্য অবলুপ্ত । সেখানে স্বাতন্ত্র্যের শাস্তি – দাসত্ব অথবা মৃত্যু ।
“গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি এবং চার্চ” প্রবন্ধে শিবনারায়ণ রায় দেখিয়েছেন – গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল কোনও দল বা দলের ক্ষমতা বা পাশ্চাত্যের চার্চ বা প্রাচ্যের কোন মন্দিরের আধিপত্য বা শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান নয় । গণতন্ত্রের ভিত্তি হল ব্যাক্তিমানুষ , তার স্বাধীনতা বা স্বাধিকার বোধ । যে বোধ গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পথ ধরে , সংস্কৃতির মুক্ত আবহাওয়ায় , নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা ও চিন্তা –চেতনার ঘাত –প্রতিঘাত ও অভিঘাতের মধ্য দিয়ে । ব্যাক্তি তার অন্তর্নিহিত সৃজনের বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পথ ধরে নিজের যে জাগরণ ঘটায় , নিজের বিশ্বাস ও অন্তরের শক্তিকে প্রকাশ করে যে জাগরণে , যে প্রকাশে কোনও শক্তির আনুগত্য নেই , কোনও পদানতি নেই । সেখানেই রেনেসাঁসের বীজ – সেই পথই রেনেসাঁসের যাত্রা ।
“বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা “ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন বাংলা ও বাঙ্গালির সাহিত্য – সংস্কৃতির যে রেনেসাঁ তা ডিরোজিও , রামমোহন , বিদ্যাসাগর , বঙ্কিম –মাইকেল , অক্ষয়কুমার প্রমুখ মনীষীর কর্মকীর্তি ও জীবনাদর্শের পথ ধরেই উৎসারিত হয়েছে ।১৯২৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও আবুল হোসেন সম্পাদিত শিখা পত্রিকা তাঁকে চমৎকৃত করেছিল এবং দ্বিধাহীনভাবে তিনি এই আন্দোলনকে রেনেসাঁর মর্যাদা দিয়েছেন ।
স্রোতের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ গ্রন্থে শিবনারায়নবাবু তাঁর সহজাত বুদ্ধি , যুক্তি , প্রশ্ন ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রখর চিন্তা -চেতনায় ধর্ম- বর্ণ – জাতি নিরপেক্ষ এক জগত গড়ার দিকে নিবিষ্ট হয়েছেন – যা দেশকালের সীমানা পেরিয়ে প্রতিটি দেশের যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষিত সমাজ তথা বিশ্বমানব কল্যাণের কথাই বলে । এই গ্রন্থে “নাস্তিকের মৃত্যুচিন্তা “ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন “ অতিমানব বলে বিশ্বজগতে কিছু নেই , শব্দটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ মাত্র , কিন্তু অস্মিতাসম্পন্ন ব্যাক্তির প্রভাব অনেক বেশি , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কৃতি তার মৃত্যুর পরেও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে । বুদ্ধ , সক্রেটিস , কনফুসিয়াস , যিশু , মোহাম্মদ , কান্ট , মার্কস , রবীন্দ্রনাথ , পিকাসো – এঁরা প্রত্যেকেই অনন্য অস্মিতাসম্পন্ন মানুষ । তবে এঁরা কেউ অজর , অমর , ত্রুটিবিচ্যুতিহীন আত্মা বা “বিশ্বমানব” বা বিচারের উর্ধ্বে “অতিমানব” নন । "
“দেশ” পত্রিকায় যখন শিবনারায়ণের প্রবন্ধ “রবীন্দ্রনাথ ও গ্যোটে “ প্রকাশিত হয় তখন তাঁকে নিয়ে প্রবল সমালোচনায় মুখর হয়ে তৎকালীন সাহিত্য- সংস্কৃতি জগত। বাঙালি হয়ে বাংলাইর লেখা ভালো না বলে কোন এক গ্যোটে কে তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় প্রতিভাবান মনে করছেন । এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত ছিল “গ্যোটে বেশ্যাবাড়ি গিয়েছেন , মদ খেয়েছেন , মেয়েদের হৃদয় ভেঙ্গেছেন । সে সব তিনি লুকিয়ে রাখেন নি । সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ এটা পারেন নি । বাস্তব জীবন রবীন্দ্রনাথের লেখায় দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে ।
এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন “ আমার মতে বাংলার রেনেসাঁসের সবচেয়ে বড় কীর্তি হল বাংলা গদ্যের বিকাস । বাংলার চিন্তা , বাংলার মনন , সারা ভারতবর্ষকে একশো বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল”। এই বিকশিত বাংলা গদ্যের একটি বিশিষ্ট রূপকল্প নিঃসন্দেহে প্রবন্ধ সাহিত্য । কিন্তু শিবনারায়ণ মনে করতেন “বাংলা প্রবন্ধের অস্পষ্টতা এবং দারিদ্র্য প্রায় একেবারেই ঘোচেনি । বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য নিতান্তই অপরিণত । বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের উন্নতিকল্পের সারস্বত সংকল্প নিয়ে শিবনারায়ণ ১৯৮০ সালে প্রকাশ করলেন মনন ও চিন্তন নিকষিত জিজ্ঞাসামুখর প্রবন্ধমুখ্য ত্রৈমাসিক “জিজ্ঞাসা”। বাইশ বছর নিরবচ্ছিন্ন সম্পাদনায় এ –কে শক্ত জমির ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্পাদক শিবনারায়ণ । বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে এবং প্রবন্ধসাহিত্যের সৌষ্ঠবসাধনে “জিজ্ঞাসা” পত্রিকার অবদান উপেক্ষণীয় নয় ।
শিবনারায়ণ কোন তত্ত্বদর্শনের আবেষ্টনীতে নিশ্চল হয়ে থাকেননি । মননের চলিষ্ণুতা , অভিজ্জতার প্রাচুর্য , তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ শক্তি এবং সর্বপরি স্বাধীন চিন্তা তাঁকে সজীব সচল করে রেখেছে একজন সংবেদী মানুষ হিসেবে । মননদৃষ্টির এই ক্রম পরিবর্তনের নির্যাস তাঁর রচনাসম্ভারেও পাওয়া যাবে । এ বিষয়ে অনুসন্ধানী গবেষক- পাঠক তৎপর হতে পারেন ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৪২