আ ডায়মন্ড ইয নট ফরেভার!
(#1) খুচরা পর্যায়ে এক খন্ড হীরে এমনিতেই ২০০ থেকে ৩০০% বেশি দামে বিকোয়... অর্থাৎ, ১ লাখ টাকায় যে হীরের আংটি কিনছেন, ওটার আসল দাম হোলসেল মার্কেটে বড়জোড় ৩৫ থেকে ৫০ হাজার! এবং যে মুহূর্তে হীরের আংটি কিনে দোকানের বাইরে পা রাখবেন, ঠিক সেই মুহুর্তে বস্তুটির দাম অর্ধেকেরও বেশি কমে যাবে। মোটামুটি জেনেশুনেই ডায়মন্ড ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের পকেট কেটে অর্ধেক থেকে দুই-তৃতীয়াংশ হাপিস করে দিচ্ছে। স্টক মার্কেটে ফ্রড ধরার জন্য এসইসি এবং কড়া আইনকানুন আছে (বাংলাদেশ বাদে hmm ) - ডায়মন্ড ফ্রডদের প্রতিহত করার জন্য কিছুই নেই। Diamond retailing = robbery in broad daylight...


(#2) তবে এখানেও আরো বড় ক্যাচাল আছে! সদ্য কেনা চকমকে পাথর খন্ডটি অর্ধেকের কম দামেও যদি বিক্রি করতে পারেন তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন! কারণ বেশিরভাগ দোকানই খুচরো ক্রেতাদের কাছ থেকে ডায়মন্ড কিনতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেবে। এর কারণ মূলত: দু'টি -
প্রথমত: আপনাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে ১ লাখ টাকায় আংটি গছিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু সে নিজে হয়তো ঐ জিনিসই কিনেছিলো ৩০/৪০ হাজার দিয়ে। কাজেই ওটা যদি সে আপনার কাছ থেকে কিনতে যায়, স্বভাবত:ই (অবচয় হার মাথায় রেখে) তাকে ৩০/৪০-এর অনেক নীচের কোনো প্রাইসপয়েন্ট অফার করতে হবে। আর এটা করতে গেলেই ব্যাপক সাইকোলজিকাল এফেক্ট লাফিয়ে এসে পড়ছে! কিছুদিন আগে ১ লাখ টাকার যে মাল আপনি কিনেছিলেন, ওটার রিসেল ভ্যালু আচমকা ২৫-৩০-এ নেমে আসলে বিরাট শক খাবেন! স্বভাবত:ই অপমানিত বোধ করবেন। তার ওপর, ডায়মন্ড নামক চকমকা কার্বনখন্ড একটি "চিরন্তন, অমূল্য, নিরাপদ বিনিয়োগের" যে চটকদার মীথ বাজারে প্রচলিত আছে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে! একজন ইন্ডিভিজুয়াল রিটেলার সরাসরি ক্রেতার কাছ থেকে আরো কম দামে হীরে কিনে নিলে সাময়িকভাবে কিছুটা লাভবান হবে ঠিকই, তবে তার আল্টিমেট এফেক্ট হবে - পুরো ইন্ডাস্ট্রীর কালেক্টিভ সুইসাইড। ডায়মন্ড জুয়েলারী ইন্ডাস্ট্রিটাই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রকারের ধাপ্পাবাজির ওপর - এ ধরণের ঘটনা (কাস্টোমার থেকে ডায়মন্ড কিনতে গিয়ে গ্যান্জাম) বারবার ঘটতে থাকলে একসময় না এক সময় গোমর ফাঁস হবেই। আর সে কারণেই ডায়মন্ড রিটেলাররা মোটামুটি সিন্ডিকেট করে কাস্টোমারের কাছ থেকে ডায়মন্ড কিনতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেয়!
দ্বিতীয়ত: রিটেলাররা তাদের বিক্রিত ডায়মন্ডগুলো হোলসেলারদের কাছ থেকে কনসাইনমেন্টে সংগ্রহ করে। অর্থাৎ, মাল কিনতে দোকানীকে কোনো পয়সা দিতে হয় না। ডায়মন্ডটি বিক্রি হয়ে যাবার পরেই দোকানী তার দাম হোলসেলারকে পরিশোধ করে। বলতে গেলে, দোকানী মোটামুটি রিস্ক-ফ্রী বিজনেস চালিয়ে যাচ্ছে - একদিকে বিনা বিনিয়োগে সে কাঁচামাল পাচ্ছে (দোকানীর বিনিয়োগ বলতে র ডায়মন্ড পাথরটা পলিশিং এবং সাথে রিং ও আনুষাঙগিক এ্যাকসেসরীয যোগ করে বিক্রয়যোগ্য করার খরচ) - আবার ঐ জিনিসই সে ২ থেকে ৩ গুণ দামে খুচরো ক্রেতার কাছে বিক্রয় করছে। বিজনেসটি সরলভাবে দেখতে চাইলে অনেকটা এ রকম - সাপ্লায়ারের কাছ থেকে আপনি ১ টাকার কাঁচামাল জোগাড় করছেন, মূল জিনিসের সাথে হয়তো ৪/৫ পয়সার ভ্যালু এ্যাড করছেন - আর ঐ জিনিস ক্রেতার কাছে বিক্রয় করছেন ২ বা ৩ টাকায়। সেলস রেভিনিউ থেকে ১ টাকা সাপ্লায়ারকে দিয়ে দিচ্ছেন, ৫ পয়সা খরচ - আর বাকী পুরোটাই আপনার পকেটে! আর যদি ডায়মন্ডটি বিক্রি নাও হয় তাহলেও তেমন ক্ষতি নেই - সরাসরি হোলসেলারের কাছে ফেরত চলে যাবে (আর হোলসেলারও আরেক রিটেলারের মাধ্যমে ওটা বিক্রি করাবে)। উল্টোদিকে, কাস্টোমারের কাছ থেকে ডায়মন্ড বাই-ব্যাক করতে গেলে শুরুতেই দোকানীকে বিনিয়োগ করতে হবে। তার ওপর ঐ ডায়মন্ড আদৌ বিক্রি হবে কিনা নিশ্চয়তা নেই, আর যদি হয়ও সেক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন যাবৎ দোকানীর বিনিয়োগ আটকা পড়ে থাকছে। অতএব - আপনার কাছ থেকে ডায়মন্ড কিনলে বরং ওদেরই ক্ষতি।
মোদ্দা কথা - বিজ্ঞাপনে ঠিকই বলেছিলো: "আ ডায়মন্ড রিয়েলী ইয ফর এভার!" একবার কিনেছেন তো ফেঁসেছেন - পরে আর চাইলেও ওটাকে দূর করতে পারবেন না। hmm
(#3) গোল্ড, সিল্ভার হলো ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড ধাতু। ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড কমোডিটির দু'টো বৈশিষ্ট্য থাকে -
১) লিকুইডিটি - মার্কেটে বস্তুটির পর্যাপ্ত ডিমান্ড এবং সাপ্লাই
২) fungibility - বন্ধুর কাছে আপনার কাছে ১০০ টাকা পাওনা আছে। বন্ধু আপনাকে ১০০ টাকার একটি নোট না দিয়ে বরং ১০ টাকার ১০টি নোট দিয়ে ধার চুকিয়ে দিলো - এটাই "ফান্জিবিলিটি" (ইহার বংগানুবাদ আমার সাধ্যের বাইরে hairpull )। গোল্ড বুলিয়ন ফান্জিবল - অর্থাৎ, ১০০ গ্রাম ওজনের ২৪ ক্যারাট ১টি গোল্ড বুলিয়ন কিনলেন আপনি, ভবিষ্যৎে ওটা একই মানের (২৪ ক্যারাট) ৫০ গ্রাম ওজনের ২টি বুলিয়ন (বা যেকোনো ওজনের ভগ্নাংশ) দিয়ে এক্সচেন্জ করতে পারবেন।
(#4) ডায়মন্ড:
১) লিকুইডিটি: যৎকিন্চিৎ। এটা শুধু এক রাস্তা দিয়েই হাতবদল হয়: সাপ্লায়ার -> রিটেলার -> কাস্টোমার। উল্টোপথে মালিকানা বদল প্রায় হয়ই না (অল্পস্বল্প যা হয় তাতে কোনো প্রভাব পড়ে না)
২) ফান্জিবিলিটি: নেই। ডায়মন্ডের গ্রেডিং করা হয় 4C ক্রাইটেরিয়া দ্বারা (4C: carats, color, cut, and clarity) এই ৪টি ডাইমেনশন মিলিয়ে অদলবদল করার মত পাথর খুঁজে বের করা খুবই দুরুহ কাজ, প্রায় অসম্ভব।
মোদ্দা কথা: ইনভেস্টমেন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে ডায়মন্ড একটি বাজে বিনিয়োগ।
(#5) তবে ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড ডায়মন্ডও আছে। কিন্তু সেগুলো খুবই দুর্লভ। একটি ডায়মন্ড হোলসেলার কোম্পানী প্রতি মাসে হাজার হাজার পিস ডায়মন্ড প্রসেস করে। ওর মধ্য থেকে হয়তো ক্বদাচিৎ একটি পার্ফেক্ট ডায়মন্ড ওরা পেলেও পেতে পারে। বছরে হাতে গোণা এক-আধ ডজন এমন দামী হীরে আবিষ্কার হয় এক একটি ট্রেডিং কোম্পানীতে। আর যাও বা পাওয়া যায় তাও আর ম্যাস মার্কেটে আসে না - তাদের মধ্যেই হাতবদল হতে থাকে। বাজারে যে হীরে পাওয়া যায় তা হলো "কমার্শিয়াল গ্রেড" ডায়মন্ড। ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড ডায়মন্ডের সাথে আমাদের কমার্শিয়াল ডায়মন্ডের মূল্যমানের আকাশপাতাল ফারাক।
(#6) ডায়মন্ড একটি "রেয়ার ম্যাটেরিয়াল" বলে কোম্পানীগুলো মীথ প্রচার করে থাকে। এটিও ডাঁহা মিথ্যে কথা। বরং ডায়মন্ডের চাইতে প্ল্যাটিনাম অনেক দূর্লভ ম্যাটেরিয়াল (কোথায় যেন পড়েছিলাম পুরো পৃথিবীর প্ল্যাটিনাম সংগ্রহ করলে তা একটি মাঝারী আয়তনের ঘরের সমান হবে)। হীরে মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়, তবে এটাকে "দুষ্প্রাপ্য" করে রাখা হয়। পুরো দুনিয়ার ডায়মন্ড মাইনিং কন্ট্রোল করে আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকার কিছু মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী প্রাইভেট কোম্পানী। এরা নিজেরা ইচ্ছামত সিন্ডিকেটিং করে প্রাইস ফিক্সিং করে। আপনার স্ত্রী/বান্ধবী-র কণিষ্ঠা আঙুলের ১,০০,০০০ টাকা দামের ডায়মন্ডটির জীবনীচক্র:
আপনি কিনেছেন ১ লাখ টাকা দামে
আপনার রিটেলার কিনেছিলো হয়তো ৪০ হাজারে
তার হোলসেলার কিনেছিলো হয়তো ৩০ হাজারে
আর মাইনিং কোম্পানীর আসল প্রডাকশন কস্ট হয়তো ১৫-২৫ হাজার!
(#7) "ডায়মন্ডস আর ফরেভার" - এই ক্রেজটি তৈরী করা হয় ৪০-এর দশকের শুরুতে। এর মাস্টারমাইন্ড নিউ ইয়র্কের এ্যাডভার্ৎাইজিং গুরু - জেরল্ড লওক। ৩০-এর দশকে আমেরিকান অর্থনীতি প্রবল মন্দাক্রান্ত ছিলো। তারপরও ডী বিয়ার্স কোম্পানীর ৭৫% ডায়মন্ড সেলস হতো আমেরিকায়, বাকী দুনিয়ায় ২৫% বিকাতো। ঐ সময় ডায়মন্ডের মূল ক্রেতা ছিলো বিয়ের আগে হবু-স্ত্রী-র জন্য গিফট খুঁজতে শপিং-এ আসা আমেরিকান তরুণ সমাজ। তবে একটা বড় সমস্যা - আমেরিকান নারীরা ডায়মন্ড তেমন একটা পছন্দ করতো না, মোটামুটি ইউজলেস পাথর হিসাবেই গণ্য করতো। আর তাই ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ডী বিয়ার্সের দরকার হয়ে পড়েছিলো ডায়মন্ডের পাবলিক পারসেপশন আমূল বদলে দেয়া।
আর ঐ মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসাবে তারা আরম্ভ করে ম্যাসিভ আকারে চতুর, ধূর্ত ক্যাম্পেইনিং। আমেরিকানদের রিতীমত ব্রেইনওয়াশিং শুরু করে। আমেরিকান পুরুষদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় - পার্টিতে গ্যাদারিং-এ তার হাতে যদি মোটাসোটা একখানা চকমকে কার্বনের দলা শোভা না পায় তাহলে তার জীবনটাই ব্যর্থ - প্রফেশনালী "আন-সাক্সেসফুল"। নারীদের শিখিয়ে দেয়া হয় পরিবারের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, কণিষ্ঠা আংগুলে হীরের আংটি নেই তো তাদেরর পরিবার "গরীব, লুজার"। ডায়মন্ডকে প্রতিষ্ঠিত করানো হয় সামাজিক এবং পারিবারিক সাকসেস স্ট্যাটাস সিম্বল হিসাবে। হলিউড স্টারদের বড় বড় সাইযের ডায়মন্ড গিফট করা হয় - আর পাপারাজ্জীদের ভাড়া করা হয় ডায়মন্ড পরিহিত স্টারদের ছবি তুলে ম্যাগাযিনে ছাপানোর জন্য। রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ডায়মন্ড গছিয়ে দেয়া হয়, এবং তাদের এমনসব ছবি পত্রিকা/ম্যাগাযিনে প্রকাশ করা হয় যেখানে কিন্চিৎ প্রকটভাবে তাদের পরণের হীরের আংটিটি নজরে পড়ে। ফ্যাশন ডিজাইনার, বিউটিশিয়ানদের ভাড়া করা হয় - তারা রেডিও-টিভি প্রোগ্রামে ডায়মন্ড হাইপ চড়িয়ে দিতে থাকে। এমনকি ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রী এক পর্যায়ে বৃটিশ রয়্যাল ফ্যামিলীকেও ধোঁকা খাইয়ে ডায়মন্ড প্রোপাগান্ডার কাজে লাগিয়েছিলো।
Liz Taylor
Halle Berry
Duchess of York
ফলাফল - ১ বছরের মধ্যেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও মন্দাপীড়িত আমেরিকায় ডায়মন্ড রিটেলিং লাফ দিয়ে ৫৫% বেড়ে যায়।
আজ ৮০% আমেরিকান দম্পতিদের এনগেজমেন্ট হয় ডায়মন্ড দিয়ে। হীরের আংটি ছাড়া প্রপোজ করার কথা এখন আর কল্পনাও করা যায় না! ওয়েডিং রিঙের কার্বন খন্ডের সাইয দেখেই এখন অনেকে অটোমেটিক মেপে ফেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে "ভালো+বাসা" কতটুকু... :O
ডমিনেশন কম্পলিট!


হিটলারের নাৎসী ক্যাম্পেইন মাত্র কয়েক দশকের জন্য কয়েক মিলিয়ন মানুষকে বোকা বানিয়েছিলো। kidding
ডী বিয়ার্সের ডায়মন্ড ক্যাম্পেইন শতাব্দী পার করে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে বাকরা বানিয়ে চলেছে! cool
ব্লাড ডায়মন্ড - কোটি কোটি তরুণের রক্তপানি করা সন্চয় চুষে খাচ্ছে অল্প কিছু গোষ্ঠী...
ডায়মন্ডস আর বুল**!
“The reason you haven’t felt it is because it doesn’t exist. What you call love was invented by guys like me, to sell nylons.”
- Don Draper, Madmen
বি:দ্র: পোস্টটি Priceonomics-এর ডায়মন্ডস আর বুল** আর্টিকল অবলম্বনে
যাইহোক আমি লেখাটি চুরি করেছে এখান থেকে
লেখক একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিসিয়ান। এই ঈদে কতজনের কত টাকা ক্ষয় ক্ষতি হল এই পাথর কিনতে গিয়ে তাদের জন্যই এই কপি পেস্ট আয়োজন .........