সু,
তোমার সাথে আমার সম্পর্কটি কোন জনমের বলতে পার? তুমি আমার আরজনমের সখি, এছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনা আমি। অথচ কি অনায়াস নিষ্ঠুরতায় তুমি আমার সততায় প্রশ্ন রাখো। মাঝে মাঝে কি হয় তোমার বলতো.. কেন তোমার ডাবের কচি শাসের মতো কোমল হৃদয়টিকে কঠোরতর করে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠ? কেন তোমার আস্থা সরিয়ে নাও? তুমি কি জাননা যে তোমার রাখা আস্থাই আমার সব, আমার প্রাণভ্রমরা? আমাকে শতবার হত্যা করে আবার জীবিত করাই কি তোমার কোন গোপন খেলা? বিশ্বাস করিনা আমি। তুমি যে আমার চিরচেনা একমাত্র বন্ধু। আবার একমাত্র শত্রুও এই তুমিই। যে শত্রুর ধারালো দৃষ্টির নীচে প্রাণভ্রমরা সপেঁ দেয়া যায় নিশ্চিন্তে। শত সাধনাতেও কি এমন শত্রু মিলবে কারও?
সেদিন তুমি কাঁদলে। কি এমন হয়েছিল বলতে পার? এত অল্পতে ভুল বুঝে কেও, পাগলি একটা! তোমার চোখে মুক্তোর মত জল দেখে বুক আমার ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ভুল ভাঙ্গতে সময়তো লাগেনি তেমন, দু'দন্ডেই চাঁদমুখে জ্যোঁৎস্না এসেছিলো। লাজুক হাসির সাথে ভেজা চোখ দুটো একেবারেই যাচ্ছিলনা। কিন্তু আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কি এক যাদুর আকর্ষনে আমার দৃষ্টি হয়েছিল অনড় সেদিন। পৃথিবীর সব রূপকে কোন এক যাদুবলে যদি কেন্দ্রীভূত করা যায় কোন এক বিন্দুতে, সে সৌন্দর্য উপেক্ষা করে কোন সে দৃষ্টি। আমার গোবেচারা দৃষ্টির কাছে তুমি সেই মূহুর্তে তেমনই হয়ে উঠেছিলে।
একবার মনে হলো এমন কিছু করি যাতে এ সর্বনাসা ভুলবুঝা তোমাতে আর বাসা না বাঁধে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম, মহাজগত আমাদের দু'জনকে নিয়ে হয়তো খেলছে মজার কোন খেলা, তা খেলুক না। এ খেলা বন্ধ করে কি কাজ। জানি, এ খেলায় পুড়তে হয়। আমি পুড়তেই চাই। পুড়তে পুড়তেই একদিন ঠিক খাটি সোনা হয়ে বের হব, দেখে নিও। তখন আমার সু আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যেতেই পারবেনা, কেবলই আমার হয়ে থাকবে। কি থাকবে তো..
ছুটিতে যখন দেশে গেলাম, জানতে চাইলে, কেন আবার যাচ্ছি দূরদেশে, সবকিছু ছেড়ে। সত্যিইতো, যেখানে আমার সু থাকবেনা সেখানে ফিরে গিয়ে কাজ কি। নাহ্ ভাবছি চলেই আসব একবারে, চিরদিনের জন্য, একদম পারছিনা আর নিজেরই সাথে। জীবন গোছাতে গিয়ে যদি জীবনের অস্তিত্বই হয় বিপন্ন তবে কাজ নেই সেই আয়োজনের। সব সিদ্ধান্তেই মগজ-বেটা বড় বেশী প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে, হৃদয়-বেচারাকে এবারে দেয়া যাক প্রাধান্য.. হা হা হা..
সু, কখনও কি বলেছিলাম সেই গল্প, কেন এই দূরদেশে পড়ে আছি, সব ছেড়েছুড়ে? কোনদিন বলিনি বোধহয়। বাবাহীন সংসারে মা'দের সংগ্রামের কাহিনী শুনেছ কখনও? তাঁরা হন অন্যরকম সংগ্রামী, সেই অর্থে আমার মার মত সংগ্রামী মানুষ কমই আছে। অনেকদিন আগে, জীবন-সংগ্রাম বুঝার বয়স আমার হয়নি তখনও, এটা সেই সময়ের গল্প।
"একদিন স্কুল থেকে ফিরেছি প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে, কারণ সকালের নাস্তাটি ছিল অপর্যাপ্ত। রান্নাঘরেরই একপাশে মা আমাদের চার ভাইবোনকে খেতে দিয়েছেন। খাবারের আয়োজন অতি নগন্য। শুধুই ভাত আর বেগুন ভর্তা। আর কিছুই নাকি জোগার করা যায়নি সেদিন। কি যেন হলো আমার শিশুমনে, রাজ্যের ক্ষোভ কোত্থেকে এল জানিনা। ছুড়ে ফেললাম থালাটি উঠোনে, মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়লো সাদা সাদা ভাত উঠোনজুড়ে। সেদিন মা আমাকে কিছুই বলেননি। তাঁর চোখে দু'ফোটা জল ছাড়া আর কিছু দেখিনি সেদিন।"
এরপর থেকে সেই দৃশ্যটি মাথা থেকে সড়েনি, একদন্ডের জন্যেও। উঠোনজুড়ে পড়ে রয়েছে সাদা সাদা ভাত, যা জোগাড় হতো আমার মায়ের হাড়ভাঙ্গা শ্রমে। আমার কেবলই মনে পড়তো সে ঘটনাটি, ছুড়ে ফেলা সেই ভাতগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াতো প্রায়ই। সময় গড়িয়ে চলে আপনমনে। সেই ঘটনার প্রায় দেড় যুগ পরে পাড়ি জমালাম পরবাসে। একদিন না বুঝে যে ভাত ফেলে দিয়েছিলাম, সেগুলো কুড়িয়ে নিতেই এসেছি এই দূরদেশে!
তোমার মন খারাপ করে দিলাম নিশ্চয়ই। একবার মনে হলো, নাইবা বলি এতসব। পরক্ষনেই মন বলল, যাকে মন-প্রাণ সব দেয়া গেল, তার কাছেইতো নিজেকে মেলে ধরতে হয়। দেখতে দিতে হয় সবকিছু, যা তিলতিল করে জমা হয়েছে হৃদয় নামক বায়বীয় অথচ অনুভবযোগ্য জিনিসটাতে। কোন ভুল করেছি কি, বল?
সু, সেদিন তুমি যে গোলাপটি আমার বুক পকেটে রেখেছিলে আলতো ছোঁয়ায়, ওটা এখন শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু সুবাস সড়ে যায়নি একটুও। গোলাপটি ধরলেই তোমাকে ছোঁয়ার একটা তাজা অনুভূতি হচ্ছে এবং অনুভূতিটি সমানুপাতিক হারে বেরে যাচ্ছে, বিষয়টি নতুন, এবং কিছুটা অদ্ভূৎ বৈকি। আচ্ছা, তোমারও কি এমন কিছু হয়, তুমিও কি আমার স্পর্শ কোনভাবে পাও? তোমার অস্তিত্বে আমার চলাচল কি আগের মতোই সাবলীল? কেন জানি মন বলছে উত্তরটি হ্যাঁ বোধক। সারাটা জীবনই তোমাকে এমন প্রবলতর ভাবেই পেতে চাই, দু'এক দন্ড সময়ের জন্য শুধু নয়। কোন বাধাটাধা মানতে রাজী না, এ আমি আগেই বলে রাখছি, হুম্।
- সু অধিকৃত বিশিষ্ট দূর্বল মানব
উৎসর্গঃ
যুঁথি এবং শ্রাবণ জল। অতি চেনা আর প্রায় অচেনা দু'জন উচ্চমাত্রার আবেগপ্রবন মানুষ। চিঠির বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ অসীমের কাছাকাছি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০৬