মাদুরের উপর আড়াআড়ি করে পলিথিন বিছানো। তার উপরে শাদা শাদা ভাত। ধোয়া উঠছে। বড় হাড়িতে ভাত হবার পর বাশের জালিতে ফেলে পানি দিয়ে ধুয়ে এই পলিথিনে রাখা হয়। মাড় গালার ঝামেলা থাকে না তখন। গরম ভাত পানির সাথে মিশে আরো পরিচ্ছন্ন হয়। ব্যস্ত হাতে এই মুহূর্তে সেই পরিচ্ছন্ন ভাত তুলে তুলে ক্যারিয়ার বন্দি করছে মজুর মা।
তার সহযোগী আলতা। গত বছর থেকে সে কাজে লেগেছে। এছাড়া উপায়ও ছিল না তার। বেশ দেখে শুনেই বিয়েটা করেছিল সে। খোকন মিয়াকে। মিশুক চালাত। থাকত এই বস্তিতেই। ফাঁক পেলেই আলতাদের ঘরে ঢু মারত, নানা বাহানায়। কখনও পান লাগে তার, কখনও আবার আলতার মায়ের সাথে দেখা করার খায়েশ জাগে। আসল কাহিনি যে কি তা কি আর আলতা বোঝে না? ভালই বুঝতে পারে। ভালও লাগে।
তাদের ঘরে খোকন মিয়ার কদরও ছিল খুব। শুধু তাদের ঘর কেন এই বস্তির প্রতি ঘরেই তার কদর ছিল। এই বয়সে নিজে নগদ ষাট হাজার টাকা দিয়ে মিশুক কেনা সহজ কোন কাম না। বিয়ের আগে সেই মিশুকে চড়ে কতদিন যে ঘুরেছে ও, তার কি আর ইয়ত্তা আছে! ব্যাটা যেমন পারে চালাতে তেমনই পারে রঙয়ের কথা কইতে। আলতা কি আর এমনি এমনি মজেছিল? শেষে বিয়েও করল। সংসারও করল বছর খানেক। তা ব্যাটা মিশুক চালাতে চালাতে আবার কোন প্যাসেন্জার নিয়া ভাগল তার খবর আজও হল না।
নিজের পেট টানার জন্যই মজুর মার সাথে ভিড়েছে। মারও একটু সাহায্য হয়। আর কামডাও তো একেবারে খারাপ না। অন্তত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরা লাগে না। রান্ধন তো মাইয়া মাইনষের নিয়তি। সে মেম হলেও আর ঝি হলেও। তার তো এটা শখই। আর রান্ধেও সে খুব ভাল। প্রশংসা জীবনে কম পায় নি। তা ব্যাটায় বুঝল কই? আগে মানুষটার জন্য রান্না করতে হত আর এখন না হয় অনেক মানুষের জন্যই করে।
মাঝে মাঝে এই মানুষগুলোর জন্য মায়াও লাগে তার। আহারে! ব্যাটাগো ঘরের মানুষটা নাই। কত কষ্ট না জানি হয়। মজুর সাথে তাই মাঝে মাঝে যেতে মন চায়। নিজের হাতের রান্না মানুষগুলি কেমন তৃপ্তি নিয়ে খায় তা দেখার তার বড় শখ। একবার মজুর মাকে বলেছিল ও। মজুর মা তখন সহানুভূতি নিয়ে বলেছিল
- কি? নিজের পুরুষটার লাইগা মন পুড়ে?
লজ্জায় আর কোনদিন সে এ বিষযে কথা তোলেনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব চিন্তা করে আলতা একটু লজ্জাও পায়। তবে এসব চিন্তা অবশ্য তার কাজের ব্যাঘাত ঘটায় না। বেশ তড়িৎ হাতেই মাংস আর ডাল বাটিতে চালান করে।
মইজুদ্দিনের এসবের দিকে নজর নেই। তার নজর তার চার বছরের বোনটির দিকে। কেমন হাপুস হুপুস করে খাচ্ছে সে। ঝোল আর ভাতে আস্তিন, মুখ আর জামা মাখামাখি। গরমে চেহারায় ঘামের ছাপ পষ্ট। তবু নিবিষ্ট মনে ডান হাত চালায় খাবারে আর মাঝে মাঝে অন্য হাতে নাকের তরল মোছে। মজু ঠিক করে রেখেছে তার একটু টাকা হলেই সে এই মেয়েটিকে একটা ডল পুতুল কিনে দেবে। অনেকদিন থেকেই মেয়েটি তাকে জ্বালাচ্ছে।
বোনের দিকের মমতার দৃষ্টি সরিয়ে এবার মজু মায়ের দিকে তাকায়।
-কই হইল মা?
কারিমা জবাব দেন না। নিবিষ্ট মনে কাজ করেন। আর কয়েকটা ক্যারিয়ার বাকি। এত অল্প বয়সে ছেলেকে খাটাতে তার কষ্টই লাগে। কত আর বয়স ওর। এই জ্যৈষ্ঠে নয় হবে। এ আর এমন কি বয়স! এর দিক তাকালেই তার ঘরের মানুষটার কথা মনে পড়ে যায়।
ওর বাপ যখন মরল তখন মজুর বয়স ছিল ছয় বছর। দুরন্ত পোলাডা হঠাৎ কেমন টাসকি মেরে গেল। পোলা কান্দেও না, কথাও কয় না। ওই বয়সে কি আর সব বোঝন যায়? তবে কিছু নিশ্চয়ই বুঝেছিল। নয়ত অমন তব্দা মেরে থাকবে কেন? আর এই রকম বিপদেও পরে নাকি মানুষে! মানুষটা কি ভোগাই না ভুগল কাশিতে। ওষুধে ওষুধেই গ্যালো জমানো সব টাকা। তা রিকশা চালিয়ে ক ট্যাকাই বা আর জমে! ভাগ্যিস রহমত ছিল!
মানুষটা যেদিন মারা যায় সেদিন ঘরে একটা টাকাও নেই। বস্তির সবাই মিলে চাঁদা তুলে তবেই দাফন হল। মরার আগে অবশ্য মানুষটা একটা আজব কথা কইছিল। বলেছিল, ময়নারে কইয়ো আমি তারে অনেক ভালবাসতাম। ক্যান যে কইছিল কথাটা আইজও বুঝে উঠতে পারে না কারিমা। জীবন কালে ময়নাকে সে দেখতেও পারত না। কোনদিন কাছে ডেকে একটু আদরও করে নাই। আর মরার সময় কিনা তার জন্যই দরদ উথলায়ে উঠল! তার কথাই কইয়া গেল? মানুষটা বড়ই আজিব। এতই যদি ভালবাস তাইলে আগে কও নাই ক্যান? মেয়েটা বাপের আদর পাইল না!
নাকি সে আন্দাজ পাইছিল যে ময়না তার সন্তান না। তা একটু আধটু ভাব ভালবাসা গরীবের থাকতে হয়। মজুর বাপে সারাদিন রিকশা টানার পর শইল্যে আর জুত পাইত না। ভাব ভালবাসা আসবে কোত্থেকে?
তা ভালবাসা পাইছিল সে রহমতের কাছে। বস্তির সামনের মুদি দোকানে কাজ করত সে। বয়সে তার চেয়ে দু'চার বছর কমই হবে। তাতে কি? সমত্থ জোয়ান পোলা তো! কতদিন যে মজুর মার দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থেকেছে। দোকানে গেলে খাতির-যত্ন করত খুব। তারপর আস্তে আস্তে আরো খাতির জমলে দোকানের চালটা, মরিচটাও আসতে লাগল ঘরে। মাঝেমাঝে চিরুনি বা সাবান। কিন্তু একবারের জন্যও উল্টাপাল্টা কোন প্রস্তাব দেয় নাই কোনদিন। তা সব কথা কি মুখ ফুটে বলতে হয়! পুরুষ মানুষের চোখেই কথা ভাসে। মজুর বাপ যখন থাকত না সেই ফাঁকে মাঝমাঝে এসে এটা সেটা সাহায্যও করত। এই সময়টা বড়ই ভাল লাগত কারিমার। তা তারও তো দোকানের কাম। সময় কই সময় নিয়ে বসার, গপসপ করার। কিন্তু কম কম আসলে যে চালটা, মরিচটাও আসে কম!
নেশা ধরানোর জন্য কারিমা নিজেই একদিন নিজেকে এগিয়ে দেয়। যতই সাধু হোক না কেন পুরুষ মানুষ তো! প্রথম দিনেই হামলে পড়তে চেয়েছিল। কারিমা দেয়নি। প্রথমেই সব দিয়ে দিলে নেশা কাটতেও দেরী লাগবে না। শাড়ি পড়তে যত সময় লাগে তার চেয়েও আস্তে খুললে তবেই না পুরুষ মানুষের আগ্রহ বাড়ে। এবং আস্তে আস্তে তার সবই দিয়েছিল কারিমা। কতদিন আর সহ্য হয়। বিশেষ করে দুপুর বেলায়, শরীরে কি জানি ভর করে। মনও বড় বিচাইন হয়। মজুর বাপ তখন কতদূরে, কোন অজানায় কে জানে! ময়না তখনই তার শরীরে নানা ভাবে জানান দেয়।
তা রহমত মানুষটা বড় ভাল। ভোমড়ার মত শুধু মধু নিয়া কেটে পড়েনি। মজুর বাপ যখন অসুস্থ, বিছানায়, তখনও সাহায্য করেছে, যখন যা পেরছে। শরীর নিয়েও তখন বেশি মাতামাতি করেনি। সময় সুযোগ হলে আসত। ডেকে নিয়ে যেত আলোদের ঘরে। আলো দিনের বেলা কাজ করে, সাহেবগো বাসায়। চাবি দিয়ে যেত কারিমার কাছে। মজুর বাপ কিছু টের পেত কি না বোঝা যেত না। আর টের পেলেও কিছু কইত না। জানে ওষুধে ব্যাঘাত ঘটলেই সব শেষ।
মজুর বাপের মরনের পর রহমতই এই ব্যাবসার ব্যবস্থা করে দেয়। টিফিন ক্যারিয়ারের ট্যাকা এখনও ফেরত দেয়া হয় নাই। এত দিনে যেই একটু টাকা পয়সা হয়েছে আর তখনই কিনা রহমত সৌদি। বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু কারিমা রাজি হয়নি। জানে পুরুষ মানুষ বড় দখলদার জাত। যত মহৎই হোক না কেন নিজেরটাই আগে বুঝে, একেবারে ষোল আনা। ময়নাকে খুব মহব্বত করলেও কিছুদিন পরই মজুকে দেখতে পারবে না। মজুর বাপ যেমন দেখতে পারত না ময়নারে।
কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়াটা কোন ভাবেই পছন্দ করেনি রহমত। কত কিই না করছে সে কারিমার জন্য। আর সে কিনা মনটায় এমন দাগা দিল। ভালবাসার নামে ছলনা করে সে তাহলে সুবিধাই নিয়েছে! গ্রামের কোন ভাই তাই বিদেশ যাওয়ার কথা বললে কষ্টে আর না করেনি।
কারিমা ভেবেছিল বিদেশ যাওয়ার কথা বলে রহমত বুঝি নিজের দাম বাড়াতে চায়। এমনিতে তো সে তার আচলেই বাধা। তা যে সত্যি সত্যিই পাখি উড়াল দিবে এটা বুঝে উঠতে পারেনি। যখন বুঝেছে তখন পাখি ফুরুৎ। খামোখা মজু কয়েকদিন কারিমার হাতের চড় চাপড় খেল।
তবে রহমত না থাকায় খুব বেশি সমস্যা হয়নি। মজু এখন কাজ কাম করতে পারে। কাস্টমারও ভালই বেড়েছে। শুরুর দিকে কারিমা নিজেই খাবার নিয়া যেত। কাস্টমার সবই পুরুষ মানুষ। কেউ ব্যাচেলার, কেউ আবার বিবাহিত, বউ সাথে নাই। তা না হলে কি কারিমার রান্না খায়! তা মানুষগুলি পরেও খুব। এত এত ভাল পোষাক পড়া লোকগুলা খাওয়া ছেড়ে তার গতরের দিকেই ইতস্তত নজর দেয়। বেশিরভাগেরই ওই নজর দেয়াই সার। সাহস করে আর কিছু বলতে পারে না। তবে দু'একজনের আবার লাজলজ্জার বালাই নেই। আড়াল পেলেই বলে ফেলে। কারিমা কেবল একজনের প্রস্তাবেই সারা দিয়েছিল, বুঝে শুনেই। কাস্টমার তো আর এমনি এমনি বাড়েনি।
মজু একটু বড় হবার পরে এখন আর ঝামেলা নেই কোন। মজু একলাই চব্বিশটা ক্যারিয়ার টানতে পারে। লাঠির দুই মাথায় টুনটুন আওয়াজ তুলে কেমন নাচতে নাচতে যায়। কারিমার খুব মায়া হয়।
মজু আবার তাড়া দেয়।
- কি হইল?
কারিমা মুখ ঝামটায়
- দেখতাছোস না? চউখ নাই?
কাজের সময় মেজাজ ভারী গরম থাকে কারিমার। এটা জানে মজু। তাই আর ঘাটায় না। অন্য প্রসঙ্গ টানে
- গোশত রাখছ তো
-আইজ বাজার কম হইছে। থাকব না।
আলতার আচল পড়ে গিয়েছে। এখানে সেই অর্থে কোন পুরুষ মানুষ নেই। তবু মজুর নজর আগে একবার বুকের দিকে গিয়েছিল। না সেই নজরে কোন পাপ ছিল না, ছিল বিস্ময়। তবু সাবধানতা থেকেই আলতা আঁচল ঠিক করে নেয়। তারপর বলে
-এক দুইখান রাখলে এমন কি ক্ষতি হইব? পোলাডা এত কষ্ট করে
আবার মুখ ঝামটায় কারিমা। বলে
-এত কষ্ট করে আর আমরা বুঝি ওম পোয়াই। রান্দনের সোম খেয়াল আছিল না। তহন ওরে খাইতে কইছিল কেডা। আর অহন কোন ঝামেলা করন যাইব না। সবাইর বিল দেওনের সময় হইছে। বিল পাইয়া লই তখন খাসির গোশত আনুম নে।
এর উপর কথা চলে না। আবার কিছু না বলে চুপচাপ থাকবে এরকম বান্দাও মজু না। তাই ঝারি মারে
- অউছে, বুজছি, বুজছি। অহন তাড়াতাড়ি করো
আলতা আর কারিমা তাড়াতাড়িই করেছে। চব্বিশটা ক্যারিয়ারের আর মাত্র দুটো বাকি। সে দু'টোতে ভাত দেয়া আছে। আলতা তার ঝোল মাখা হাতে সাবধানে মাংসের বাটি বসায়। তারপর ন্যাকড়া দিয়ে বাটির কোনার ঝোল মুছে দেয়। মজু তার লাঠি বাড়িয়ে দেয়। কারিমা হাত ধুয়ে ক্যারিয়ার বাধতে শুরু করে। এই ফাঁকে মজু তার বোনটাকে একটু আদর করতে উঠে দাড়ায়। আর মিনিট পনেরর মধ্যে সব কিছু রেডি করে মজু রাস্তায় নামে। আলতা আর কারিমা দরজায় দাড়িয়ে থাকে। এতক্ষনের পরিশ্রম হালকা বিষাদ আনে। দু'জনের একবার চোখাচোখিও হয়। ইশারায যেন অনেক কথা হয়ে যায়। যেন বাড়ির একমাত্র পুরুষ মানুষ দুজন নারীর দায়িত্ব কাধে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কারিমার আবার মায়া লাগতে শুরু করে। ময়না তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারেই খাচ্ছে।