[ রেনোয়া নির্মীত ফিল্ম এর মধ্যে 'রুলস অব দ্যা গেইম' নামটি আমার ভীষণ প্রিয়। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম নামটি কোথাও ব্যবহার করি। সুযোগ বুঝে মেরে দিলাম]
১.
জুই খুব সাধারণ মেয়ে। খুব সাধারণ তার জীবন যাপন। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার বয়স কুড়ি। প্রথম নজরেই তার চেহারার যে বিষয়টি সবার নজরে পরে তা হল বিষন্নতা। আর কারো কথা জানি না তবে জুই প্রমান করতে পেরেছে যে বিষন্নতাও মানুষের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারে। বন্ধুমহলে জুই ‘বিষন্ন সুন্দরী’ হিসেবেই খ্যাত।
তার বাবা আজগর সাহেব, প্রায় শিল্পী হতে হতে এখন একটি দ্বিতীয় শ্রেনীর বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ হেড। বাবা যখন শিল্পী হওয়ার চেষ্টায় অপ্রকিতস্থপ্রায় ঠিক তখন তার জন্ম। বাবার সাফল্য ও ব্যর্থতার সন্ধিক্ষণে এবং সংসারের চরম টানাপোড়নের সময় তার মা বিদেশ পাড়ি জমায়, অন্য মানুষ(তার অবশ্য বন্ধুই ছিল) বিয়ে করে। সচারচর যেমন কাহিনী হয় তেমন আর কি!
স্রেফ কাগজ কলমের সম্পর্ক নয় বলে কিংবা সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভালবাসে বলে কিংবা উকিলী ফ্যাসাদে সে তার বাবার পক্ষে ভোট দিয়েছিল বলে, এখন বাবার সাথেই তার বাস। মেয়ের কারণেই তার বাবা চাকরি নেন এবং অতি অল্পের মধ্যেই নিজেকে কর্পোরেট শিল্পী হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। বাবার মতে, পৃথিবীর বুকে আরও একজন অশিল্পীর জন্ম হয়। সেও অনেকদিন আগের কথা। এখন জুইয়ের বয়স কুড়ি। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে… ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বাবা-মায়ের প্রাক্তন প্রেমের সম্পর্ক, পরবর্তী সাংসারিক জটিলতা, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা এনসব কাহিনী জুইয়ের মনে নানা দ্বীধার সৃষ্টি করেছে। সম্পর্কের বিশ্বাসে আস্থাহানি। আর তাই, অনেক আগ থেকেই ও হিসেব-নিকেষ কষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, প্রেম একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর থেকে একশ হাত দূরে থাকুন।
কিন্তু প্রেম যে ওর থেকে দূরে থাকতে নারাজ। একে সুন্দরী, তার উপর একটু আধটু গানও জানে সুতরাং ছেলেরা পিছু তো নেবেই। অবশ্য এ ধরনের ছেলেদের কিভাবে এড়াতে হয় সে বিদ্যা ও কৈশর থেকেই চর্চা করে আসছে। কিন্তু ওর সকল বিদ্যা এসে মার খেয়েছে মিলনের কাছে। সে একটা যন্ত্রনা। সে একটা নাছোড় বান্দা। সে একটা সুপার গ্লু। সে একটা…
কিছুদিন হল এই ছেলেটা জ্বালিয়ে মারছে তাকে। রাত নেই দিন নেই ফোন। দেখা করতে চায়। দেখা করে। সিনেমার মত প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মোদ্দাকথা আপদমস্তক তার পুরোটাই পাগলামি। এবং জুই ঠিক জানেনা এই ছেলেটা তাকে জ্বালাতে বিচিত্র সব সময় খুঁজে বের করে কেমন করে। যেমন- রাত দুটো। তাবত মানুষ ঘুমে। তখন তার সাধ হয় জুইকে দেখার। শুক্লপক্ষে জোসনা ভাগাভাগি, কৃষ্ণপক্ষে আঁধারে স্নান করতে চায়। দুপুর একটা।সুর্য মধ্য গগণে। তখন তার সাধ হয় জুইকে নিয়ে পিচগলা রাস্তায় হাঁটার! বলা চলে সে কেবল দুদিন জ্বালাতন করে, যেদিন বৃষ্টি হয় আর যেদিন হয় না।
জুইয়ের বন্ধুদের মধ্যে অপূর্ব প্রধান। সে ফিচেল ধরণের ছেলে। ধূর্ত এবং কৌশলী। সে একদিন মিলনকে ফাঁদে ফেলে। অন্য বান্ধবীকে দিয়ে ফোন করিয়ে ক্যাম্পাসে লাইব্রেরীর সামনে এনে একটি দীর্ঘ ‘বহিরাগত পেটাও’ মার দেয় ওকে। জুইয়ের ব্যাপারটায় মত ছিল না একদম। কিন্তু কি আর করা! বন্ধু হিসেবে এতটুকু কাজ করার অধিকার অপূর্ব রাখে।
তারপর বেশ কয়েকদিন হাপ ছেড়ে বাঁচল। মিলনের কোন খোঁজ নেই। ও ভাবল, চিকিতসা করাতে দেশের বাইরেই গিয়ে থাকবে… হয়ত। তা যাক। সেখানেই কোন সুন্দরী নার্স পাক। মন দেয়া নেয়া হোক। জুই বড় বেঁচে যায়।
২.
একদিন, এমনি দুপুর বেলা। জুইয়ের ক্লাস নেই। একা বাড়িতে। ইতস্তত বই পড়ছিল। আদি ভৌতিক রহস্য উপন্যাস। স্টিফেন কিংয়ের। আধো ভয়, আধো নয় এমন অবস্থা। হঠাত দুপুর ভেঙে সেল ফোনটা বেজে ওঠে।
জুই একটু চমকে ফোনটা ধরে। আননোন নাম্বার। কিন্তু নোন ভয়েচ। ওহ শিট! দ্যাট পেইন এগেইন! মিলন!
ব্যস্ত কোন রাস্তা থেকে সে ফোন করেছে। আশপাশে প্রচুর গাড়ির আওয়াজ, তাই গলা উঁচু। সেখানে জরুরী ভাব।
- হ্যালো! আমি মিলন। শোন জুই, আমি এখন একটা রাস্তার মোড়ে। তুমি যদি এই মুহূর্তে আমাকে ভালবাসি না বল তাহলে আমি গাড়ির নিচে লাফ দেব।
কোন রকম ভূমিকার ধার ধারে না মিলন।
- আপনার যা খুশি করতে পারেন।
এইরকম বলপূর্বক সরাসরি এ্যাপ্রোচে জুই রীতিমত বিরক্ত। আর কথারই বা কি শ্রী। একদম বিশ্রী। এ কেমনতর ছ্যাবলামো!
- আমি কিন্তু গড ড্যাম সিরিয়াস
জুই ভাবে মারের পর ডায়লগে একটু হলিউডি ভাব এসেছে ছেলেটার।
- আমিও সিরিয়াস
জুই হঠাত খুট করে একটা আওয়াজ পায়। সম্ভবত মোবাইল পড়ে যাবার। একটা আর্তচিতকার। তারপর অসংখ্য মানুষের কোলাহলের আওয়াজ। ক্রমে বাড়ে। অন্য আর একটা গলা কাছে এগিয়ে আসে।
- এই যে ভিকটিমের ফোন। ও মাই গড! লাইন এখনও চালু! হ্যালো, আপনার সাথে কথা বলতে গিয়েই কি ..
- কি হয়েছে?
- সরি! হি ইজ ডেড। মাথা পুরোটাই থেতলে…
- কি?!
জুই হতভম্ব। ভয়ে হাত থেকে ফোনটা ফেলে দেয়। যেন একটা বিষাক্ত সাপ ধরে আছে সে। একটা মানুষ, জলজ্যান্ত একটা মানুষ! কথা বলছিল! হঠাত সে মৃত! কি অস্বাভাবিক! কি অদ্ভুত! জুইয়ের পৃথিবীতে এমন ভয়ংকর ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি মা চলে যাবার সময়ও না।
সকাল থেকে বিকাল গড়ায়। সন্ধ্যা হয়। কিন্তু আতঙ্ক কাটে না।
স্বভবতই ওর রাতটা হল দুঃসহ। দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কে ভরা। একটা দুঃস্বপ্ন এমন-
অনেকগুলি ফোন বাজছে। কান ঝালাপালা রিংয়ের শব্দে। একটা ফোন জুই রিসিভ করে। অমনি একটা কচ্ছপ গতির কন্ঠ শোনা যায়- হ্যালো, আমি মিলন।
এর পরই মনিটর থেকে রক্ত গড়ায়। ভয়ে চিৎকার দেয় ও। কিন্তু গলা দিয়ে অনেক করেও কোন আওয়াজ বেরোয় না।
সে রাতে ভাল ঘুম হল না ওর, বলাই বাহুল্য।
৩.
সকালে ওর ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। দুঃস্বপ্নের আবেশ তখনও ছিল। ভয় পেয়ে ফোনটাই সে ছুড়ে ফেলে। যদিও ফোনটা বন্ধু প্রধান অপূর্বর ছিল তবু এরপর অনেকদিন আমরা জুইকে কোন ফোন ব্যবহার করতে দেখব না, সে ল্যান্ড ফোন কিংবা মুঠোফোন। কারণ দুঃস্বপ্নগুলি সে প্রতি রাতেই দেখবে এবং ফোন বিষয়টি তার জন্য আতঙ্কের কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে। জুইয়ের প্রত্যাহিক জীবনে কিছু পরিবর্তন আসবে। সে ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে যাবে। একটু রহস্যজনক আচরণ শুরু করবে। তার আনমনা ভাব বেড়ে যাবে। চেহারা হবে পাংশুটে, শরীর হবে রোগা।
ফোন বিষয়ে সে বাবাকে এই বলে বুঝ দেবে যে, একটি ছেলে তাকে প্রচন্ড বিরক্ত করছে। তাই সে কিছুদিন ফোন ব্যবহার করবে না। যখন বাবা তাকে নতুন সিম নেয়ার কথা বলবে তখন জুই তাকে তার মত থাকতে দেয়ার অনুরোধ করবে। তার বাবা আর জোর করবে না। জোর করবে অপূর্ব।
- সমস্যা কি তোর?
- কিসের সমস্যা?
- আমাকে এ্যাভোয়েড করে চলিস কেন?
- তোকে এ্যাভোয়েড করে চলার কি আছে?
- ভাবছিস কিছু বুঝি না?
- তুই কি বুঝবি?
- সেই মার-খেকো ছেলেটার সাথে প্রেম শুরু করেছিস, তাই না?
- করলে তোর কি?
এমনি প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্ন, প্রশ্ন দিয়ে উত্তর চলে সেদিন। কিন্তু কোন অর্থ দাড়ায় না।
কয়েকদিন পরের কথোপকথন। অপূর্ব এবার বেশ সিরিয়াস। বেমানান রকম গম্ভীর।
- আমাকে কি খুলে বলবি আসলে কি হয়েছে তোর?
- কিছু না
অন্য সময় হলে ও বলত, তুই কি আমার স্বামী যে তোর সামনে খুলতে হবে? ওদের সকল বন্ধুদের সম্পর্ক এমন সাবলীল।অপূর্ব বলে
- তুই কি গত কয়েক দিন আয়নাও দেখিসনি? কি অবস্থা তোর চেহারার? বল, ঘটনা কি?
জুই কি আর সহজে বলে? ঘটনা জানতে অপূর্বকে এরকম আরো কিছুদিন সিরিয়াস হতে হয়। অবশেষে পরামর্শ দেয়
- যা হয়েছে সব ভুলে যা
ইস! সত্যিই যদি সব ভুলে যাওয়া যেত!
৪.
নতুন উপসর্গ দেখা গেল জুইয়ের। আজকাল মৃত মিলন ফোন করছে তাকে খুব। অপূর্বর পরামর্শ মত সে সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টাই করছিল। সেই আগের মত বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গান নিয়ে মেতে ছিল।
নিতু একটা গান লিখেছে বিকল্প প্রেম নামে। গানের মূলভাব এরকম- আকাশ ভালোবাস, পাখি ভালবাস কিন্তু মানুষ ভালবেস না। কারণ মানুষ দুঃখ দেয়। গানের কথা অনুযায়ী নিতুকে গাছের সাথে বিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে বন্ধুরা। জুইয়ের উপর ভার পরেছে গানটিতে সুর করার। বিবাহ সঙ্গীত হিসেবে এটি যথা সময়ে, যথাস্থানে পরিবেশন করা হবে। রবিন অবশ্য পাত্র হিসেবে ওদের বাসার বনসাই বটগাছটার কথা প্রস্তাব করেছিল। নিতু নাকচ করে দিয়ছে। তার খাট বর পছন্দ না।
তবে কি এসবে জুই বেশ ভাল ছিল। এবং রাত ছাড়া দিনের বেলা ভুলেই ছিল সবকিছু। আগের মত মুঠোফোনটিও ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সেটা দিয়েই বাবাকে ফোন করার চেষ্টা করছিল। বাবার ফোন বন্ধ। সম্ভবত মিটিংয়ে। সকালে বলতে ভুলে গিয়েছিল যে বাসায় চিনি শেষ। ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে নিজের হাতে তৈরী এককাপ চা না হলে ওর চলে না। বাবাকে আর একবার ট্রাই করবে নাকি ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে নিজেই কিনে আনবে সেটাই ভাবছিল। ঠিক তখনই ফোনটা আসে। আননোন নাম্বার। জুই ফোন ধরে
-হ্যালো। কে বলছিলেন?
ফোনে ঘরঘর জাতীয় একরকম বিচিত্র শব্দ। তারপর স্বপ্নের মতই একটা কর্কশ কচ্ছপ গতির কন্ঠ শোনা যায়- হ্যালো, আমি মিলন।
অপূর্বকে জানালে ও বলে- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকেই এসব হয়েছে। এটা আসলে ওর অপরাধী মনের কল্পনা। কই নাতো! ও চিন্তা করা প্রায় তো ছেড়েই দিয়েছিল।
তা অপূর্ব যাই বলুক, সেই থেকে মৃত মিলনের জ্বালাতন আবার শুরু হয়। প্রায় দিনই ফোন আসতে থাকে। একএকবার এক এক নাম্বার থেকে। কখনও মোবাইলে, কখনও ল্যান্ডফোনে। কখনও ভরদুপুরে, কখনও মাঝরাতে। কখনও ঘরঘর আওয়াজ, কখনও শোঁ শোঁ বাতাস। কখনও শুধু হ্যালো, কখনও শুধু আমি মিলন। জীবিত অবস্থায়ই মিলনের সাথে মিলন ঘটুক তা চায়নি জুই, আর মৃত মিলন তো নয়ই। বড় যন্ত্রনায় পরা গেল! মিলন যে মরেও ওর পিছু ছাড়ছে না ঠিক যেমন ছাড়ছে না রাতের দুঃস্বপ্নও।
৫.
জুই আগের মতই ফোনটা অফ রাখতে পারত। কিন্তু অপূর্বই পরামর্শ দেয় ফোনটা বন্ধ না রাখার। ও গতানুগতিক চিন্তা থেকে পরামর্শটি দিয়েছে। বলেছে ফোন বন্ধ না করে বরং পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। দেখুক না শেষ পর্যন্ত কি হয়?
কিন্তু ওরা সবাই ছেলেমানুষ। এই নিয়মিত ফোন আর দুঃস্বপ্ন যে জুইয়কে মানসিক ভাবে গুড়িয়ে দিতে পারে সে চিন্তা কখনওই মাথায় আসেনি। ফলে জুইয়ের শরীর আবার ভেঙে পড়ল আর মন তো আগেই ভাঙা।
বাবা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন কিন্তু ও বলেনি কিছু। আপূর্ব নিষেধ করেছিল। কারণ ফালতু একটা বিষয় নিয়ে সে শুধু শুধু চিন্তা করবে। সে হয়ত অফিস কামাই করে মেয়ের পাশে বসে থাকবে। এর আগেও এমন করেছে। তাছাড়া শোনার সাথে সাথেই তিনি সাইক্রিয়াটিস্টকে ফোন দিবেন। এই বস্তুটিকে অপূর্ব কিংবা জুই কেউই পছন্দ করে না।
সেদিন রাত্রে আবারও ফোন আসলে জুই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বাবার দরজা টোকা না দিয়েই ঢুকে পরল। বাবা কোনদিনই দরজা বন্ধ করে ঘুমান না। জুই গিয়ে বাবার মাথার কাছে বসল। তার চোখে পানি। বাবা যথারীতি ঘুমাননি, শুযে পরেছিলেন মাত্র। জুই পাশে বসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, কি হযেছে? জুই এবার ফুপিয়ে ওঠে। বাবা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসেন। লাইটটা জ্বালাতে গিয়েও জ্বালান না। নিশ্চয়ই অনেক বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। লাইট জ্বালালে পরিবেশটা নষ্ট হবে, জুই হয়ত স্বাভাবিক হতে পারবে না। বাবা প্রথমেই কিছু জিজ্ঞেস না করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তাতে ওর কান্নার বেগ গেল বেড়ে। বাবা এই বেগ বাড়তে দিলেন। আগে ও একটু হালকা হয়ে নিক। জুই সবকিছু কান্নার মধ্যেই হরহর করে বলতে শুরু করল। বাবা বুঝলেন সবই। কিছু কথা জড়িয়ে গেল তবে তিনি সেটা অনুমান করে নিলেন।
পরদিন সকালেই বাবা অপূর্ব আর জুইকে নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টয়ের কাছে গেলেন। শিল্পী এবং আড্ডাবাজ মানুষ হওয়ার কারণে এ শহরে তার বন্ধুর সংখ্যা অনেক। ডা: রজত রায়ও তেমনি। জুইও খুব চিনে। আমুদে লোক। কাঁচাপাকা দাড়ির অন্তরালে একজন শিশুর বাস। ও ডাকে ডাক্তার চাচা। এখনও বাসায় এলে জুইয়ের জন্য চকলেট নিয়ে আসেন। জুই যে চকলেট খাবার বয়স পার করে এসেছে অনেকদিন, সেটা যেন মনেই থাকে না।
আজগর সাহেবই সবকিছু বললেন। অপূর্ব গ্যাপগুলি ধরিয়ে দিল। রজত সাহেব কোন প্রশ্ন না করেই সবটুকু আগে শুনলেন। তারপর বললেন
- আজগর তুমি আর এই ছেলে কি যেন নাম বললা তোমার, যাই হোক, তোমরা একটু বাইরে যাও। আমি একটু ওর সাথে একলা কথা বলি।
ওরা বাইরে গেলে রজত সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন।
- হ্যা মা। এবার তুমি বল।
জুই বেশ সাবলিল ভাবেই বলল। সব শুনে তিনি বললেন
- কি নাম যেন তোমার বন্ধুর?
- অপূর্ব
- হ্যা। অপূর্ব। ছেলেটার বুদ্ধিও অপূর্ব। ও ঠিকই বলেছে। এ সবই তোমার আপরাধী মনের কল্পনা। যদিও তুমি আদৌ কোন অপরাধ করনি। যা হয়েছে তাতে তোমার কোন হাত নেই। তুমি বুঝতে পারছ আমার কথা?
- কিন্তু চাচা আমার কাছে তো ফোন আসে। সে সব কেমন করে আমার কল্পনা হবে?
- আচ্ছা তুমি বল, তোমার বাবা কিংবা বন্ধুর সামনে কখনও ফোন এসেছে?
এমন করে তো জুই আগে ভাবেনি। একটু বিস্ময় নিয়েই চিন্তা করে সে।! তারপর বলে
- না
- কেন? কারণ অন্যরা সামনে থাকলে তুমি নিজের সামনে নিজে দাড়াতে পারো না। বিষয়টা ক্লিয়ার?
জুই এবার তার মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়ে।
- কিন্তু নাম্বার তো আমার ফোনেই আছে
- কই দেখি?
জুই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে আসলেই তার ফোনে ওই রকম কোন নাম্বার নেই। মানে কি? সে কি তাহলে পাগল হয়ে গেল? মাথায় কি তার একটু ভোতা যন্ত্রনা হচ্ছে ? জুই একটু কঁকিয়ে ওঠে যেন। আহ্ । ডা: রজত বললেন
- শোন। বিষয়টা এখন তো ক্লিয়ার তোমার কাছে। তাই না? সো, ঘাবরাবার কিছু নেই। বিশ্রাম নেও। গান শোন। আড্ডা দাও। লোকজনের সাথে বেশি বেশি মিশ। বাসায় ডিভিডি আছে না। বেশি বেশি মুভি দেখ। দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি তোমাকে কোন অষুধও দিচ্ছি না। শুধু ‘ক্লোব’ দিচ্ছি। এতে তোমার টেনসান দূর হবে। ঠিক আছে?
জুই কোন মতে বলে, হু
ডা: রজত প্রেসক্রিপশান লিখে দেন। তারপর আবার বলেন, আর ফোনটা আপাতত তুমি বন্ধই রাখ।
ডা: চাচা আরও অনেক্ষণ ওর সাথে গল্প করেন। অনেক উতসাহব্যাঞ্জক কথা বলেন। কিন্তু ও যেন আর ওর ভিতরে নেই। পৃথিবীটা যেন স্লোমোশনে চলছে, ওর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কখন যে ওই রুম থেকে বের হল, কখন যে ডা: চাচা ওর বাবার সাথে কথা বললেন ও কিছু টেরই পেল না যেন।
৬.
আজগর সাহেব ডা: রজতের কথা মেনে নিয়েছেন কেবল কিন্তু মনে নিতে পারেন নি। তার মেয়ের কেমন করে সাইকোলোজিক্যাল প্রোব্লেম হয়? দিব্যি সুস্থ্য ও। আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই। একটু রোগা হয়ে পরেছে এই যা! তবে ডা: রজতের এই কথাগুলো মেনে নিলেন, যে ওকে বেশি বেশি মানুষের সাথে মিশতে হবে। অপূর্বকে বলে দিয়েছিলেন পুরো ব্যাপারটা সবার কাছে চেপে যেতে। চেপে গেছে কিনা কে জানে?
কয়েক সপ্তাহ এভাবে কেটে গেল। আজগর সাহেব ডাক্তারের পরামর্শ মত বিষয়টা নিয়ে জুইয়ের সাথে আর আলাপ করেন না। তবে মনের ভিতর ছটফট করেন অবস্থা জানার জন্য। আদৌ কি মেয়েটার কোন উন্নতি হল?
জুই আগের চেয়ে অনেক গম্ভির হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। বিষয়টা সম্পূর্ণই নতুন ওর কাছে । ওর কথা মনে হলেই কিঞ্চত অপরাধবোধে ভোগেন তিনি। কি হল তার জীবনে! একজন ব্যর্থ আর্টিস্ট। একজন ব্যর্থ বাবা।
তবে এই ক’দিন চিন্তা করেছেন অনেককিছু। কিন্তু ঠিক হিসাব যেন মিলছে না। বাবা হিসেবে চিন্তা করছেন বলেই হয়ত ঠিক হিসাবটা মিলছে না। একটু দূর থেকে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করা দরকার। অপূর্বকে ডাকতে হবে।
বাইরে বসল তারা । পার্কে, বেঞ্চের উপর। এই ভর দুপুরে দৃশ্যটা হয়ত একটু বেখাপ্পাই মনে হবে। একটা কাকপক্ষীও নেই আশপাশে। কেবল দূরে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা যায়। তারা বোধ হয় লেকের পানিতে দাপাদাপি করছে। তবে দেখা যাচ্ছেনা। বাসা থেকে এই পার্কটার দূরত্ব হাঁটা পথ। আজগর সাহেব ছুটির দিনে এখানে আসেন এবং ঠিক এই বেঞ্চটিতেই বসেন।
চঞ্চল আর দুষ্ট অপূর্বকে দেখলে এখন কেউ বলতেও পারবে না এই ছেলেই গতকাল এক বান্ধবীর পিঠে ’অপূর্ব আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’ লিখে চিরকুট সেটে দিয়েছিল। আংকেলের সামনে কেমন একটা ভোলা ভোলা টাইপ ভোল ধরেছে। পিট পিট করে নিষ্পাপ দৃষ্টি হানছে। যেন স্বর্গের দেব শিশু, এই কুলষিত মর্তে নেমে ঠিক দিশে করতে পারছে না। শুধু আংকেল না, যে কোন বয়স্কদের সামনেই ওর এই ভোল ফোটে।
আজগর সাহেব একটু গলা খাকরি দিযে শুরু করলেন
- অপূর্ব তুমিই তো ওর সবচেয়ে ভার বন্ধু, তাই না? তোমার কি মনে হয়? ওর অবস্থা কি?
- আমি আর কি বলব আংকেল। আপনি যতটুকু জানেন আমিও ততটুকু।
- তাও ও তোমার সাথে যে রকম ফ্রি আমার সাথে তেমন না। বিশেষত এই ব্যাপারটায়।
- আংকেল ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পরই ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে ঠিকমত আসে না, ঠিকমত আমাদের সাথে কথাও বলে না ।
- ক্যাম্পাসে ঠিকমত যায় না! সে কি? ওতো প্রতিদিনই ক্যাম্পাসের কথা বলে বাইরে যায়! ও তাহলে কই যায়?
৭.
আজগর সাহেব অপূর্বর কথা শুনে সত্যি চমকে উঠলেন। কি বলে ছেলেটি? জুই ঠিকমত ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না। জন্মাবধি জুই বাবার সাথে কখনও মিথ্যে বলেনি, এটা আজগর সাহেব অনেক গর্ব নিয়েই বলেন। ছেলে মেয়েকে কিভাবে মানুষ করতে হবে এর উদাহরণ হিসেবে প্রায়ই আড্ডায় তিনি তার এবং জুইয়ের প্রসঙ্গ টানেন। সে কথায় থাকে আস্থা আর বিশ্বাসের ছড়াছড়ি। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন
- তাহলে ও কই যায়?
অপূর্বও বেশ বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। সে কোন মতে বলল
- আমি জানি না আংকেল।
তার দৃষ্টিতে ভয় আর উদ্বেগের মিশেল। আজগর সাহেব কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন
- সত্যি বলছ? তুমি জানো না?
অপুর্ব একটা কাষ্ট হাসি দিয়ে বলল
- জ্বি আংকেল। জানি না
- সত্যি?
- আংকেল আমি কেমন করে জানব?
- আমার ধারণা, তুমি অনেক কিছুই জানো
- না আংকেল আমি কিচ্ছু জানি না
- অপূর্ব, আমি তোমার সাথে বন্ধুর মতই কথা বলছি, তাই না? আমরা একটা বিষয় শেয়ার করার চেষ্টা করছ্। একটা সমস্যা হযেছে সেটা সমাধান করার চেষ্টা করছি। সো, তুমি কিছু লুকিও না।
- আংকেল, আমি কিছুই লুকাচ্ছি না। আপনি বিশ্বাস না করলে জুইকে ডাকেন
- জুই কে ডাকতে হবে না। তুমি আমাকে জাস্ট একটা বিষয় ক্লিয়ার কর। ঠিক তোমার সাথে শেয়ার করার পরই কেন ওর কাছে ওই ভুতুরে ফোন আসতে শুরু করল?
অপূর্বর গলাটা শুকিয়ে গেল। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হঠাত কোন কথা খুঁজে পেল না ও। তারপর কোনমতে আমতা আমতা করে বলল
- আংকেল.. আমার মনে হয়.. এটা একটা.. কো ইন্সিডেন্স
আজগর সাহেব মানলেন না। তিনি সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করেন। এমনকি ঈশ্বরও। কাজেই চিড়ে ভিজল না। তিনি কন্ঠ আরো গম্ভীর করে বললেন
- দেখ অপূর্ব। এটা আমার মেয়ের জীবন মরণ সমস্যা। সে তো তোমারও সবচেয়ে কাছের বান্ধবী তাই না?
এভাবে অনেক জোরাজুরির পর অপূর্ব অবশেষে স্বীকার করল, হ্যা, সে মাঝে মাঝে জুইকে ওই রকম ভয় দেখিয়েছে। তবে এটাও বলল যে এতকিছু হবে ও সেটা বোঝেনি। ও স্রেফ মজা করতে চেয়েছে। বন্ধু হিসেবে এতটুকু করার অধিকার অপূর্ব নিশ্চয়ই রাখে। আজগর সাহেব সব শুনে বললেন
- এজন্যই কি জুইকে তুমি বিষয়টা আমার সাথে শেয়ার করতে নিষেধ করে দিয়েছিলে?
- হ্যা।
- তাহলে ডাক্তারের রুমে ঢোকার আগে এক ফাঁকে তুমিই ওর মোবাইল থেকে সেই আননোন নাম্বারগুলি সরিয়ে ফেলেছ?
- জ্বি
রাগে আজগর সাহেবের শরীর জ্বলতে লাগল। তবে অপূর্বকে তার আচটুকুও পেতে দিলেন না। তিনি ঠান্ডা মানুষ। যা হয়েছে তা নিয়ে কথা বললে কেবল প্যাচালই বাড়বে বরং সমাধানের পথেই আগে বাড়া উচিৎ। তাই ওকে বললেন
- ঠিক আছে অপূর্ব। এই ঘটনাটাই তোমার জীবনের একটা লিসন হতে পারে। যাই হোক, তাড়াতাড়ি বাসায় চল। আমার ধারণা জুইকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললে হয়ত এ যাত্রা ও বেঁচে যাবে। আমি মানসিক ভাবে বাঁচার কথাই বলছি। তাড়াতাড়ি কর নয়ত মেয়েটা আবার বেড়িয়ে পরতে পারে।
অপূর্ব হাপ ছাড়ে।যেন এ যাত্রা জুই নয় ওই বেঁচে গেল।
জুই বাসায়ই ছিল্। স্বভাব সুলভ গম্ভীর। মুখে আগের মতই যন্ত্রনার ছাপ। সে সব কিছুই শুনল।বেশ মনোযোগের সাথেই শুনল। তারপর বলল
- হতে পারে বাবা অপূর্ব আমাকে ফোনগুলো করেছে। কিন্তু মিলন নিজেও আমাকে ফোন করেছে।
বাবা বললেন
- তুই কিভাবে শিওর?
জুই বলল
- ওর কন্ঠ আমি চিনি। আর তাছাড়া কয়েকদিন থেকেই ওকে আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখছি। ওকে ফলোও করেছি। কিন্তু যেমন হঠাত হঠাত দেখি ঠিক তেমন হঠাত হঠাতই উধাও হয়ে যায়।
৮.
আবার সেই সাইক্রিয়াটিস্ট। আবার ডা: রজত।
জুইয়ের কাহিনী শোনার পর এই প্রথম আজগর সাহেব মেজাজ গরম করেছিলেন। অপূর্বকে বলেছিলেন- কি হাল তুমি করলে মেয়েটার? অপূর্বর অপরাধী মাথা আপনা আপনি নত করে নিয়েছিল। তবে একটা ব্যপার বুঝেছিল, এতদিন জুই ক্যাম্পাস ফাঁকি দিযে কই যেত।
আজগর সাহেব আর কালক্ষেপণ না করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসলেন ওকে। জুইও বোধ হয় এর যৌক্তিক সমাধান চাইছে। তাই আগেরবারের মত সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসার জন্য আর গাইগুই করেনি। কিংবা ও হয়ত পরিস্থিতির কাছেই নিজেকে সপে দিয়েছে।
ডা: রজত জুইকে বললেন
- তোমাকে আর নতুন করে কি বলব বল। তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার কি হযেছে?
জুই ইতস্তত করে বলল
- ইল্যুশান?
- উহু। হ্যালুসিনেশান। ইলুশান হল হল ধর তুমি একটা দড়ি দেখে হঠাত সাপ মনে করলা। কিন্তু যার আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই সেই রকম একটা সিচুযেশন তুমি নিজে তৈরি করলে সেটা হ্যালুসিনেশান্।তুমি যেটা করেছ আর কি…
- চাচা বিশ্বাস করেন, সত্যি সত্যি আমি ওকে দেখেছি
- আমি বিশ্বাস করছি তো মেয়ে। কিন্তু তুমিই তো বলেছ ও মারা গেছে। একজন মৃত মানুষ কেমন করে হাটে আর কেমন করেই বা তুমি তাকে দেখ!
জুই একটু বিভ্রান্ত হয়। কথা খুঁজে পায় না। ডা: রজতই বলেন
- তারমানে পুরো পরিবেশটাই তুমি তৈরী করছ। নিজের অজান্তেই করছ। তুমি ভাবছ বাস্তবেই বোধহয় ঘটনাটা ঘটছে। আসলে ঘটছে না। তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে। যখনই ছেলেটাকে দেখবে তখনই নিজের মনে বলবে, এটা আমারই তেরী একটা ঘটনা। আসলে আমি যা দেখছি তার কোন অস্তিত্বই নেই।
অপূর্ব আর আজগর সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। একটা কথাও বলেননি। আজগর সাহেব রাগে আর অপূর্ব লজ্জায়। অবশেষে আজগর সাহেব মুখ খোলেন
- এই অবস্থায় ওর বাইরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
ডা: রজত বলেন
- দরকার কি? তুমি কিছুদিন ওর সাথে থাক।
আজগর সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিলেন। মেয়ে আর বাবা মিলে এরপর অনেকদিন ঘর কন্না করলেন। মাঝে মাঝে জানালার বাইরে জুই দাড়িয়ে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করে।এ ছাড়া আর সবকিছুই আগের মতই স্বাভাবিক। রাতে রাতে ওষুধ খাওয়া ছাড়া জুই কে দেখে কেউ বলতেই পারবে না, কোন ভয়বহ ঘটনা ওর জীবনে ঘটে গেছে।
আজগর সাহেব ছুটি শেষ হয়ে গেলে আরো কিছুদিন অফিস কামাই দেন। তারপর আরো কিছুদিন অফিস করলেও বেশ তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে আসেন। একসময় আবার অফিস নিয়ে পুরোপুরি ব্যস্ত হতে হয়। জুইও পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে ওঠে। এমনকি একদিন ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলে।
সময়টা শীতকাল। গ্রামে এসময় রাত্রিকালীন শৈত্য সকালের বাষ্প হয়ে পুরো এলাকা ধোয়াশে করে ফেলে। শহরে তার ছিটেফোটা আসে। জুই ক্যাম্পাসের জন্য নটায় বের হলেও সেই বাষ্পের খানিকটা পায়। অফিসযাত্রীরা পুরোটা শেষ করতে পারেনি।
ও বাসার সামনে রিকশা খুঁজছিল। একটা রিকশা পেয়েও গেল।পনের টাকা। আজকাল সবকিছুর দাম যে হারে বাড়ছে তাতে রিকশাওয়ালারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এই তো সেদিনও এখান থেকে ক্যাম্পাস মাত্র দশ টাকা ছিল। জুই ঠিক যে মুহূর্তে উঠতে যাবে ঠিক তখনই এক ধরণের অস্বস্তি হতে থাকে। তার মেয়েলি সেন্স বলল কেউ একজন দেখছে তাকে। জুই খুট করে ঘুরে দাড়ায়। হ্যা। ঠিকই ভেবেছে সে। মিলন দাড়িয়ে আছে।
তার চেহারায় মলিন বেশ। চুল উস্কোখুস্কো। যেন কত রাত ঘুমায়নি। এই শিতেও সে একটা হলদেটে টি শার্ট পরে আছে শুধু।
জুইযের সাথে সাথে ডাক্তার চাচার কথা মনে পড়ল। এই যে ছেলেটিকে সে নির্ভুল ভাবে দেখছে এ তার নিজেরই তৈরী! সে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। একদম মিলনের কাছাকাছি গিয়ে দাড়ায়। মিলন দাড়াবে না যাবে, নাকি দাড়ালেও কিভাবে দাড়াবে, ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না। জুই আস্তে আস্তে বলে- তুমি আসলে কেউ না। তুমি আমার কল্পনা মাত্র। আমারই তৈরী…
মিলন নড়ে ওঠে মাত্র। জুই আবার তার কথার পুনরাবৃত্তি করে। এবার মিলন তার সেই বিখ্যাত কচ্ছপ গতির কন্ঠে বলে
- না জুই। আমি তোমার তৈরী কিছু না। আমি… আমি আসলে মরিনি । তুমি ভালবাসলে না বলে প্রতিশোধ নিলাম।
জুই প্রশ্ন করে
- তাহলে ওই যে মরে যাওয়া?
- ওটা একটা বড় নাটক জুই।
জুই বেশ খুশি হয়ে ওঠে। বলে
- আমার আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল। তাই তো! কোন পেপারেও তো আসে নি! আপনার উপর আমার ভিষণ রেগে ওঠা উচিত। কিন্তু পারছি না। তারচেয়ে খুশিই বেশি লাগছে।কারণ কি জানেন?
এই সময় কিশাওয়ালা ডাক দিল, কি যাবেন না? জুই বলে, একটু দাড়াও আসছি।
তারপর মিলনের দিকে তাকিয়ে বলে
- কারণ ওরা সবাই মিলে আমাকে হ্যালুসিনেশান মিশন কত কি বলে রীতিমত পাগল বানিয়ে ফেলেছে। আমি আর পারছিলাম না। যাক আপনাকে পেয়ে ভালই হল। কিন্তু কেন করলেন এ সব?
জুই হঠাত কেঁদে ফেলে। মিলন বলে
- সে অনেক কথা জুই। অন্য কোনদিন বলি? আজ যাই……
জুই পথ আগলে দাড়ায়।
- না। আপনি যেতে পারবেন না। আগে সবাই দেখুক যে আমি পাগল নই। তারপর যাবেন। চলুন। এই রিকশা..
মিলন অনিচ্ছা স্বত্তেও রিকশায় চাপে। রিকশাওয়ালার মিলনের এই মলিন বেশ, উদভ্রান্ত চেহারা বোধ হয় পছন্দ হয়নি। তাই আস্তে করে বলে, পাগল না মাথা খারাপ?
পুরো রাস্তা ওদের আর কোন কথা হয় না। রিকশা গিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতর বটতলার সামনে থামে। জুই ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে ফোন করে অপূর্বকে। অপূর্ব কাছেপিঠেই ছিল কোথাও। আসতে ওর পাঁচ মিনিটও লাগে না। আর অনেকদিন পর জুই ক্যাম্পাসে এসেছে সেই তাড়াও বোধ হয় ছিল। অপূর্ব আসতেই জুই বলে
- এই দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। তুই, বাবা, ডাক্তার চাচা সবাই মিলে রীতিমত পাগল বানিয়ে ছেড়েছিস আমাকে। হ্যালুসিনেশান না ছাই। এসব ছিল নাটক। ওই আমাকে বলেছে।
অপূর্ব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। তারপর বলে
- তুই কার কথা বলছিস জুই? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
৯.
এই হাইজিং সোসাইটিটা বড়লোকদের। এখানে অনেক কিছুই হয়। সাধারণ মানুষেরা এসব জানতেও পারে না। এখানে বড়লোকের অনেক ছেলেই নিজে একটা পুরো বাসা নিযে মাস্তি করে। এরকমই একটি বাড়িতে ফ্লোরে রাখা আসবাব বেষ্টিত একটি রুমে বেশ আওয়াজে সিনেমা চলছে। তবে এই আওয়াজ ছাপিয়েও একটা ছেলের গলার আওয়াজ শোনা যায়। বলাই বাহুল্য কন্ঠটি মিলনের। তার গলা বেশ উঁচু। সেখানে জরুরী ভাব।
- হ্যালো! আমি মিলন। শোন মহুয়া, আমি এখন একটা রাস্তার মোড়ে। তুমি যদি এই মুহূর্তে আমাকে ভালবাসি না বল তাহলে আমি গাড়ির নিচে লাফ দেব।
- আপনার যা খুশি করতে পারেন।
- আমি কিন্তু গড ড্যাম সিরিয়াস
- আমিও সিরিয়াস
মিলন হঠাত হাত থেকে ফোনটা ফেলে দেয়। মোটা কার্পেটের উপর ফোনটি পড়ে কয়েকবার নড়েচড়ে ফ্লোরে রাখা ২১ ইঞ্চি এলসিডি মনিটরের পাশে স্থির হয়। সেখানে সিনেমায় ব্যস্ত রাস্তায় একটি এক্সিডেন্টের দৃশ্য।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৪:৩১