[২০০৮ সালের শেষদিকে মাসাইদের দেশ কেনিয়া ভ্রমণের সুযোগ হয়। কেনিয়ার সেই সফর নিয়ে আমার এই ধারাবাহিক]
আমার মনের কোন এক কোনায় আফ্রিকায় আসা ও কাজ করার একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো সবসময়ই। সে ইচ্ছা আজ পুরণ হতে চলেছে। অফিসের কাজে কেনিয়া যাচ্ছি। কেনিয়া দেখেছি “Out of Africa” তে কারেন ব্লিক্সেন বা মেরিল স্ট্রিপের চোখে। দেখেছি “Constant Gardener” এ। Discovery বা NatGeo চ্যানেলের বদৌলতে অসংখ্যবারই দেখেছি সিংহের হরিণ শিকার বা কুমিরের জেব্রা শিকার করার দৃশ্য। আজ নিজ চোখে দেখতে যাচ্ছি। জীবনে প্রথমবারের মতো প্লেনে চড়তে যাচ্ছি। আজ ২ ডিসেম্বর, ২০০৮।
প্রথমেই বাম হাত ঢুকালো এমিরেটস এর বিলম্বিত ফ্লাইট। ঢাকা থেকে প্লেন ছাড়লো দুই ঘন্টা দেরি করে। দুবাই পৌঁছে শুনলাম কানেক্টিং ফ্লাইটও মিস করেছি, পরবর্তী ফ্লাইট পরেরদিন সকাল এগারটায়। শাপে বর হিসেবে পেলাম ২০ ঘন্টা দুবাইতে কাটানোর সুযোগ, সাথে ফ্রি হোটেল স্টে আর ভিসা। জয় এমিরেটস! জয় ফ্লাইট ডিলেই! [দুবাইয়ের এই ঘটনাবহুল ২০ ঘন্টা নিয়ে একটা পোস্ট পরবর্তীতে দেয়ার ইচ্ছা আছে।]
নাইরোবি যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আহামরি কোন শহর নয় নাইরোবি। ঢাকার সাথে অনেক মিল—হাইরাইজ দালান, দরিদ্র মানুষজন, রাস্তার পাশের ভাঙাচোরা ফার্নিচারের দোকান, স্থবির ট্রাফিক সবই এখানে আছে। আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে পরিচয় পাকিস্তানের আসিফের সাথে। সে-ই সাবধান করে দিলো সন্ধ্যার নাইরোবির ব্যাপারে। অন্ধকার নামলেই নাকি এটা হয়ে যায় ছিনতাইকারীর শহর।
নাইরোবিতে এরকম পার্ক/সবুজ উদ্যানের দেখা মিলবে অনেক
কেনিয়া গিয়ে এসব হ্যান্ডিক্রাফট না কেনা হবে অন্যায়
আমি এটা কিনেছিলাম, দাম পড়েছিল বাংলাদেশি টাকায় ৭০০ টাকার মতো।
আমি যে এপার্টমেন্টে উঠলাম তাতে ফ্যান বা এসি ছিল না। পরে দেখলাম প্রায় সব বাড়িতেই একই অবস্থা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই শহরের তাপমাত্রা সারা বছরই বিশ/বাইশ সর্বোচ্চ পচিঁশ। ইকুয়েটরের কাছাকাছি বলে ঋতু পরিবর্তনেরও তেমন বালাই নেই। পরবর্তীতে আফ্রিকার অনেক শহরে ছিলাম, এত ভাল আবহাওয়া আর কোথাও পাইনি।
অসমতল রাস্তা নাইরোবির বৈশিষ্ট্য।
কেনিয়াতে প্রথম বিপত্তি হলো খাওয়া দাওয়া নিয়ে। জীবনে কখনও রান্না করিনি। তাই প্রথম কয়েকটা দিন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে স্যাম্পলিং করলাম। বুঝলাম রান্না ছাড়া গতি নাই। অগত্যা রান্নায় হাত দিতে হলো। প্রথমবার রান্নায় আমি নিজেই অবাক। এতোদিন এ প্রতিভা কোথায় ছিল! নানান এক্সপেরিমেন্ট চলল—গিনিপিগ আমি নিজেই, মাঝে মাঝে আমার দুই কলিগ। রান্না যে একটা শিল্প সেটা তাদের বুঝানোর চেষ্টাতে কোন ত্রুটি ছিল না। এখানে কোন বাঁধাধরা নিয়ম নাই, যাই রাঁধবেন তাই একটা খাবার। এরপর যে কয়দিন কেনিয়া তে ছিলাম রান্নার গবেষনা করেই খেয়েছি। [P.S.: আমার টেস্টবাড নিয়ে কোন প্রশ্ন করা চলবে না। ]
আমার রান্না খাবারের একাংশ
মাসাই ভাষায় নাইরোবি মানে হলো ‘শীতল পানির স্থান’। শীতল পানির সন্ধানে বহু দূর-দুরান্ত থেকে মাসাইরা এখানে আসতো চাষাবাদ, পশু চরাতে । বিট্রিশরা এ অঞ্চলে আসার পর উগান্ডা থেকে দক্ষিণের শহর মোম্বাসা পর্যন্ত রেল লাইন তৈরি করে। তখন থেকেই নাইরোবি ছিল বড়সড় স্টেশন। ওই রেল লাইন তৈরির কাজে ব্রিটিশরা ভারত থেকে আনে অনেক ভারতীয় শ্রমিক। তাই কেনিয়াতে, বিশেষ করে নাইরোবিতে এখনও প্রচুর ভারতীয় দেখা যায়। যদিও তাদির বেশিরভাগই এখন কেনিয়ার নাগরিক। ভারতীয়রা এখন প্রচুর ধন সম্পত্তিরও মালিক। বিশাল বিশাল সব শপিং সেন্টার আর সুপারমার্কেট তাদের দখলে।
ভিলেইজ মার্কেট উচ্চবিত্তদের কাছে খুবই জনপ্রিয়
এরকমই একটি চেইন সুপারমার্কেট “নাকুমাট”। নাকুমাটের স্টোর কেনিয়ার প্রায় সব শহরেই আছে। তাই বেশিরভাগ কেনাকাটা এখান থেকেই করতাম। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে নাকুমাটের ডাউনটাউন স্টোরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে, আমি তখন কেনিয়াতেই। আগুন লেগে প্রায় ৫০ জনের মতো মারা যায়।
নাইরোবিতে এরকম অনেকগুলো মন্দিরের দেখা পা্ওয়া যাবে
একদিন গেলাম এনগং হিলে কারেন ব্লিক্সেনের সেই বাড়িটিতে। যেখানে পা দিতেই কারেনের সময়ে চলে যাই। মনে পড়ে যায় মুভির প্রথম সংলাপ “I had a farm in Africa at the foot of the Ngong Hills…”। মুভির নানা দৃশ্য আমার মাথায় অনুরণন তোলে। একসময় এই বাড়ি ছেড়ে কফি খামার, আসবাবপত্র, সব বিক্রি করে রওনা দেয় কারেন, আফ্রিকা ছেড়ে চলে যাবার জন্য। তার অনেক স্মৃতির এনগং হিল চোখের সামনে বিস্মৃতি হয়ে যায় চিরকালের জন্য।
কারেন ব্লিক্সেনের সেই বাড়িটি
৭ ডিসেম্বর ২০০৮। ঈদুল আযহা। দেশের বাইরে, পরিবারের বাইরে প্রথম ঈদ। বাংলাদেশের ঈদের আমেজের কিছুই নাই এখানে, এমনকি অফিসও ছুটি না। কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই আজ ঈদ। সকালে অফিসে গেলাম একটু তাড়াতাড়ি। টুকটাক কিছু কাজ সেরে সোজা ঈদগাহে। কেনিয়াতে যে এত ভাল একটা বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে জানা ছিল না। এ কমিউনিটির নিউক্লিয়াস হলো হাইকমিশনার একেএম শামসুদ্দিন সাহেব। ঈদগাহে অনেকের সাথে দেখা হলো, একসাথে এত বাঙালি দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। নামাজ শেষে হাইকমিশনারের আমন্ত্রণে আমরা সবাই তার বাসায় গেলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনিও বুয়েটিয়ান, আমার ডিপার্টমেন্টেরই। তার বাসায় আরো অনেকের সাথে দেখা হলো। দেশের বাইরে থাকলে যেকোন বাঙালিকেই কাছের বলে মনে হয়। বাঙালি স্বাদের অসাধারন খাবার দেশের কথা একটু হলেও ভুলিয়ে দিল। খেলামও bon appetit করে। দেশ থেকে ৪০০০ মাইল দুরে বসে এরকম খানাপিনা করা ছিল কল্পনাতীত। পরে জানতে পারলাম সবগুলো খাবারই রান্না করেছেন হাইকমিশনার আঙ্কেলের স্ত্রী। এরপর বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বেশ কয়েকবার গিয়েছি তাদের বাসায়, প্রতিবারই পেয়েছি অকৃত্রিম আতিথেয়তা।
এটা ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ তোলা। গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে হাইকমিশনারের বাসায় বাঙালিদের মিলনমেলা বসতো।
(চলবে)