আমি তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। হঠাৎ করে বাবার বদলির অর্ডার আসায় ঠিক হয় মহসীন চাচার বাসায় থেকে পড়াশুনা করবো। মহসীন চাচা আমার গ্রামসূত্রে চাচা। দুই ছেলে চাচার। খুব শখ ছিল একটা মেয়ের। মেয়ে ছিল না বলেই বোধ হয় আমার প্রতি চাচা-চাচীর স্নেহের শেষ ছিল না ।
বিধাতা চাচা-চাচীর শখ অপূর্ণ রাখলেন না। ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো।
টুকটুকিটা ভীষণরকম চঞ্চল ছিল। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে রূপার নুপুর পায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াতো সারাবাড়ি। নুপুরের টুংটাং আওয়াজে সারাবাড়িতে আশ্চর্য এক পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়তো যেন। নিজের লেখা-পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে রবিন-রনির লেখা-পড়া দেখিয়ে দিতাম। দুই ভাইকে পড়াতে বসলে সেও চেয়ার নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিতো। কখনো কোলে, কখনো কাঁধে নিয়ে বসে পড়াতাম ওদের।
মাস্টার্স পরীক্ষার পরে রেজাল্ট বের হওয়ার মাঝের সময়টুকুতে পাড়ারই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতাম। আর সাথে এখানে-ওখানে অ্যাপ্লাই করতে থাকলাম চাকরির জন্য। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে আসতাম টুকটুকির জন্য। গুড়ের জিলাপি ছিল ওর ভীষণ প্রিয়।
রেজাল্ট হয়ে যাবার কিছুদিন পরেই একটা বেসরকারী কলেজ থেকে ডাক আসে লেকচারার পদে যোগ দেয়ার জন্য। এই পরিবারটাকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সিলেটে যাবার পর নিয়মিতই যোগাযোগ হত। টুকটুকিটা কয়দিনের মধ্যেই বেশ কথা বলা শিখে গেছে। ফোনে তার কতরকম আবদার! একবার বায়না ধরলো ওর জন্য যেন টিয়া রঙের ফিতে নিয়ে যাই। চাচী প্রায়ই বলতেন কিছুদিন যেন ওনাদের ওখানে গিয়ে থাকি। সে বছরের শীতের ছুটিতে চাচার বাড়ি যাবো ঠিক করলাম। টুকটুকিটার জন্য এক জোড়া টিয়া রঙের ফিতেও কিনেছিলাম।
টুকটুকিটা নিশ্চয়ই কত বড় হয়ে গেছে, আমাকে দেখলে চিনতে পারবে কিনা – চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে রাতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে এসবই ভাবছিলাম। ট্রেনের এই কামরার বেশিরভাগ যাত্রীই আগের স্টেশনে নেমে গিয়েছে। প্রায় ফাঁকাই হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি পাশের সিটে বছর চারেকের গোলগাল মুখের এক বাচ্চা মেয়ে। কখন এসে বসলো, খেয়াল করিনি তো! মুখটা খুব খুব চেনা চেনা লাগছে। চমকে উঠি, আরে! এ তো টুকটুকি! ও এখানে এলো কথা থেকে?
হতবাক আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে উঠলো, “এ্যাই, আমাকে চিনতে পারছো না?”
আমি উত্তর দেবার আগেই আবার বললো, “আমার ফিতা নিয়ে এসেছো?”
বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। অনেকরকম প্রশ্ন ঘুরছে মনের মধ্যে- টুকটুকি এই ট্রেনে কেন? ওরা কি তবে সিলেটে আসছে? আমাকে জানালো না কেন? এসব ভাবতে ভাবতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফিতেজোড়া বের করলাম টুকটুকিকে পড়িয়ে দিবো বলে। পাশ ফিরে দেখি কেউ নেই। এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করতে করতে হাতের সেলফোনের ভাইব্রেশন টের পাই। কল রিসিভ করতেই রবিনের কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর , “আপু, আজকে সকালে টুকটুকিটা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ... আমাদের টুকটুকিটা আর নেই !”
আমি যেন আর কিছু শুনতে পারছিলাম না। তখনও আমার হাতে ধরা ছিল টুকটুকির টিয়া রঙের ফিতেটা।
// স্বদেশ হাসনাইনের গল্পে মন্তব্য //
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১২ রাত ৮:০০