গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকার অথবা অন্ধত্ব- ঠিক ধরতে পারিনি প্রথমটায়। নিস্তব্ধ চারপাশ। হঠাৎ জ্বলে ওঠা তীব্র সাদা আলো চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসছে শরীর। নড়তে পারছি না। হাত, পা, মুখ-বাঁধা। চিৎকার করে যন্ত্রণাটা হালকা করার কোনও পথ নেই। এভাবে থাকতে থাকতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর আলোতে চোখ সয়ে এলো। বুঝতে চেষ্টা করলাম, কোথায় আছি। আশে-পাশে দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তীব্র আলোটা স্পট লাইটের মত শুধু আমাকেই আলোকিত করে রেখেছে, আশে-পাশে দেখার উপায় নেই।
*
অন্ধকার , স্যাঁতসেঁতে এক দূর্গ। মেঝেতে তার পেট্রল আর গ্রীজের প্রলেপ। যেকোন মুহূর্তে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে সিঁড়ি খুঁজছি। কে যেন হাতটা ধরে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে দিলো। সংকীর্ণ, খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামছি, আন্দাজ করে পা ফেলছি, সাবধানে। পা পিছলে গেলে মুহুর্তেই তলিয়ে যেতে হবে অতল অন্ধকারে। ধীরে ধীরে বাতাস ভারী, গুমোট হয়ে উঠছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সিঁড়ি বেয়ে নামছি তো নামছিই। যেন শেষ নেই এই সিঁড়ির।
*
বাসটা মোড়ের কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বেশ নির্জন, সুপ্রশস্ত একটা রাস্তা। ডিরেকশন অনুযায়ী এই চৌরাস্তার মোড় থেকে ডানদিকে যেতে হবে আমাকে। আশে-পাশে রিকশা তো দূরের কথা একটা মানুষ পর্যন্ত নেই। উপায় না দেখে হাতের ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে এগোলে মানুষ দেখতে পাবো আশা করছিলাম। কিন্তু যতই সামনে এগোচ্ছি জায়গা যেন ততই লোকালয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এগোতে এগোতে ঘন একটা বনের মত জায়গায় চলে এসেছি। ঠিকানা ভুল করলাম না তো ? নাহ, চিরকুটে লেখা নির্দেশ অনুযায়ী স্টারলাইন বাসের শেষ স্টপেজ এই মোড়টায় আমি নেমে যাবো আর সেখান থেকে ডানে এগোলে পৌঁছে যাবার কথা। মনে সংশয় নিয়েই আরো একটু এগোই। একসময় মনে হতে থাকলো, বনের শেষের দিকে চলে এসেছি। বন পেরিয়ে সুবিশাল একটা মাঠ । মাঠের পাশ দিয়ে এই রাস্তা ধরে একদম শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে একটা চারতলা , সাদা বিল্ডিং। নাহ, ঠিকানা ভুল হয়নি তাহলে।
আমাকে রুম দেওয়া হয়েছে ২০৩ নং রুমে। ৩ বেডের একটা রুম। বাকি দুইজন রুমমেটের সাথে পরিচয় হলো। বেশ হাসি-খুশি আর হেল্পফুল। স্বস্তি পেলাম, দিন খুব একটা খারাপ কাটবে না এখানে।
প্রথম কয়েকটা দিন আসলেও খারাপ কাটলো না। মাসখানেক পর হঠাৎ একদিন সকালে বাড়ি থেকে ফোন এলো, বাড়ি ফেরা জরুরী, সম্ভব হলে সেইদিনই। দ্রুত বেরিয়ে সেই ঘন বন পেরিয়ে শহরে যাই, স্টারলাইনের ফিরতি টিকেট কিনতে। বাসের সময় হয়ে আসছে, প্রথম দিনে যে মোড়টায় নামিয়ে দিয়েছিল ঠিক ওখানেই দাঁড়াতে হবে। ফিরে এসে দ্রুত গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিতে রুমে ঢুকলাম। দরজা খুলে রুমে পা দিতে যাবো, তাকিয়ে দেখি মেঝে নেই, কিছুই নেই। বিছানা নেই, আসবাব পত্র নেই, রুমমেটরা নেই- কিছুই নেই। ২০৩ নং রুমের খোলা দরজাটা দিয়ে উঁকি দিলে নিচে দেখা যায় শুধু অতল অন্ধকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১২ দুপুর ২:০৮