আমি দেখেছিলাম তাকে, দেখেছিলাম অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকা ডানাভাঙা পাখিটিকে। নিভৃতে, অভিমানে জড়োসড়ো লুকিয়ে ছিল খাঁচার কোণটিতে। সে খাঁচার দরজা ভাঙা । অবাক হচ্ছো? ভাবছো, ভাঙা খাঁচায় বন্দী নয় সে! ঠিক ধরেছো, খাঁচা তাকে বন্দী করেনি। কিন্তু কি এক শেকলে যেন বেঁধে ফেলেছিল তাকে। আমি কি করে তার খোঁজ পেয়েছিলাম? আচ্ছা, বলি তাহলে সেই গল্পটা।
প্রতি শীতে আমার জানালা ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ঝিরঝির বৃষ্টির মত তার চিরল হলুদ পাতাগুলো ঝরাতো, আর সূর্য তখন কঙ্কালসার গাছটিকে থোরাই কেয়ার করে উঁকি দিয়ে যেত আমার জানালায়। এক শীতে জানালার ফাঁক গলে ভেসে আসা রোদের খানিকটা ঢেকে দিয়েছিল একটা ছায়া। অচেনা এক পাখি গান গাইছিল অচেনা এক সুরে । রোজ সে গান শুনিয়ে যেত। শীত শেষে বসন্ত এলো। পাতায় পাতায় ছেয়ে যেতে লাগলো ডালগুলো। পাতার ছায়ায় রোদ এলো না আর, পাখিটাকেও আর দেখতে পেলাম না।
সেইবার গ্রীষ্মের এক বিকেলে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মাঠটা পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম দিগন্তের ওপারের মৃতপ্রায় নগরীটতে। সে নগরীর শেষপ্রান্তের এক অন্ধকার ঘর থেকে ভেসে আসছিল দীর্ঘশ্বাস। খুব পরিচিত সেই দীর্ঘশ্বাসের সুর। ঘরের অন্ধকার কোণে ভাঙা এক খাঁচায় সেই গান-পাখি।
মনে পড়ে গেল পাখিটির তৃতীয় জন্মের কথা। বিষণ্ণ-পাখি দ্বিতীয় জন্মে গান-পাখি হয়েছিল। গানে গানে শুনিয়ে গিয়েছিল তার তৃতীয় জন্মের ভবিষ্যত; তৃতীয় জন্মে সে হবে ডানা-ভাঙা পাখি।
সেই শীতশেষে, বসন্তে সে এসেছিল এই নগরীতে। আর এই ঘরের বারান্দাটায় তখন বেড়ে উঠেছিল লতানো পাতা-বাহার। গান-পাখির গান শুনে মৃদু বাতাসের তালে তালে দুলতো পাতা-বাহার। এক সন্ধ্যায় বায়বীয় সীসায় আছন্ন হয়ে চোখ বুঁজেছিল তারা। দীর্ঘ ঘুমের প্রহর পেরিয়ে গেলে একদিন চোখ মেলে পাখি। ভাঙা এক খাঁচায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তার খাঁচাটা জড়িয়ে নিস্পন্দ ঘুমে আচ্ছন্ন পাতা-বাহার। খাঁচাটা ছেড়ে যেতে পারেনি আর কোথাও।
আমি পাখিটিকে দেখেছিলাম তখন, মায়ার শেকলে আটকা পড়ে পরবর্তী দীর্ঘ ঘুমের অপেক্ষায় ছিল সে, যে ঘুম থেকে তাকে আর উঠতে হবে না নিঃসঙ্গ চতুর্থ জন্মের দুঃস্বপ্ন দেখে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১২ রাত ৯:৫৫