রাত ৩টায় আমরা নেমে পড়লাম শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। আমার খুব প্রিয় একটি স্টেশন। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই প্ল্যাটফর্মের সাথে।
৩ঘন্টা ঝিমিয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে নিলাম। পূবের্র আকাশ ফিকে হয়ে আসতেই চা খেয়ে পথে নেমে গেলাম সিএনজির খোঁজে।
আমাদের ভাগ্য ভালই ছিল বলতে হবে। খুব সহজেই একটি সিএনজি পেয়ে গেলাম। ভোর ৬টায় রওনা দিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা লাউয়াছড়ার পাশের মেইন রোডে উঠে গেলাম। এখানে এসে সবুজ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে সঁপে দিব না তাই কি হয়? সিএনজি থামিয়ে নেমে পড়লাম পিচ ঢালা রাস্তায়। দুপাশে সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ বনরাজি। অজস্র পাখির কিচিরমিচির, ভোরের শিশির আর শীতল কুয়াশার মাদকতাময় আবেশে বেশকিছুক্ষন স্বপ্নময় পথে হেঁটে গেলাম। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। আমাদের চোখের সামনেই ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে লাউয়াছড়া।
একবুক ভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার সিএনজিতে উঠে বসলাম। কমলগঞ্জ শ্রীপুর হয়ে যখন রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের আদমপুর বিটে পৌছালাম তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ৮টা। বাজারে চা নাস্তা খেতে খেতে স্থানীয় লোকজনের সাথে আড্ডা দিয়ে জানতে পারলাম আদমপুর বিট রাজকান্দি রেঞ্জের অংশ হলেও অপেক্ষাকৃত নতুন আর মূল অংশটি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে কুরমা বিজিবি চেকপোস্টের কাছে। সেই বন অনেক গভীর আর একটি অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ী ঝর্না আছে। এটা শুনেই মন খুশিতে নেচে উঠল। আদমপুরের বিট অফিসার মিজান ভাই বেশ অমায়িক আর আমুদে লোক। আদমপুর থেকে কুরমা ট্রেক করব শুনে উনি বেশ অবাক হলেন তবে রাস্তা চিনিয়ে দিয়ে খুব উপকার ও করলেন। আমি আর শিহাব ভাই সকালের ঝলমলে রোদে ট্রেকিং শুরু করলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা বাঘাইছড়ি চা বাগানের ভিতর ঢুকে গেলাম। ছায়া গাছ গুলোর কোমল হাওয়ার স্পর্শ আর সবুজ চা বাগানের দৃশ্য শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল।
প্রায় ১০টার দিকে আমরা কুরমা বাজার পৌছলাম। আমাদের ঘিরে একটা জটলা হয়ে গেল। আমাদের কাধের বিরাট ব্যাকপ্যাক আর ট্রেকিং এর বেশভূষা দেখে তারা নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল।
ঐ জায়গায় আমরা কেন যেতে চাই?
ওখানে তো কেউ যায় না।
তারাই যেতে সাহস পায় না।
আমরা আত্মহত্যা করতে ওখানে যাচ্ছি কিনা এমন প্রশ্ন ও একজন করল।
হাসি মুখে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করলাম আমরা দুজন। পিছনে আমাদের নিয়ে বাজারে জোর জল্পনা কল্পনা চলছিল। ৪৫মিনিটের মধ্যেই আমরা চাম্পারাই টি স্টেটে চলে আসলাম। ১৯১০সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই অপূর্ব সুন্দর চা বাগানটি।
চা বাগানের শেষ প্রান্তে আদিবাসিদের ছোট্ট একটি পাড়ায় পৌছালাম আমরা ১১টার । ছবির মত সুন্দর কলাবাগান পারা। পারার ঠিক পিছন থেকেই সবুজ পাহাড়ের সাড়ি স্তরে স্তরে উঠে গেছে। পাশেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ১৫-১৬ বছরের মিন্টু আমাদের পথ দেখানোর জন্য রাজী হয়ে গেল। উঁচু নিচু টিলা পথে আমরা বনে ঢুকে গেলাম।
তেজী সূর্যের কিরন তখন আমাদের জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মিন্টু বারবার আমাদের তাড়া দিতে লাগল। কিন্তু আমরা বেশ আরাম আয়েশ করে ট্রেক করছিলাম।
মিন্টু বলল, দাদা সন্ধ্যার আগে আমাদের পারায় ফিরতে হবে। একটু পা চালায় হাঁটেন।
মিন্টুর চোখে মুখে অস্থিরতা দেখে ভয়ঙ্কর কথাটা তাকে বলেই ফেললাম।
মিন্টু, আমরা আজকে ফিরব না।
ফিরবেন না মানে? কোথায় থাকবেন?
কেন বনে থাকব ঝর্নার পাশে?
মিন্টু খুব ভয় পেয়ে গেল। ওকে দেখে মনে হল এমন গাঁজাখুরি কথা সে জীবনেও শুনেনি। মিন্টু বুঝি আমাদের পাগলই ভেবে বসল। ভীত গলায় বলল,
বনে কোথায় থাকবেন দাদা? যখন তখন বৃষ্টি পড়ে এখানে। ভাল্লুক ও আছে।
আরে চিন্তা কর না। আমাদের কাছে তাঁবু আছে, চাল ডাল আছে। রান্না করব, ঝিড়িতে মাছ ধরব। অনেক মজা করব। তুমিও থেকে যেও আমাদের সাথে।
মিন্টু এবার পারলে কেঁদে দেয়। দাদা শিবের কিড়া কেটে বলছি, এটা খুব খারাপ জায়গা। এখানে অনেক বিপদ। সন্ধ্যার পর এখানে কেউ থাকে না। আমি থাকতে পারব না দাদা। মাফ করে দিবেন। ঘরে আমার মাই একা আছে।
এরপর আর মিন্টুকে সামনে নিয়ে যাওয়া গেল না। মাঝপথ থেকেই সে চলে গেল।আমি আর শিহাব ভাই আবার আপন মনে বনের বন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। যে দিকে চোখ যায় শুধু বাঁশ আর বাঁশ। পুরো ট্রেইন ভর্তি বাঁশ পাতা আর কাটা বাঁশ। বনে বিরাট বিরাট গাছ দেখে খুব ভাল লাগল। এখনো কাঠচোরেরা এই বনটাকে সাবাড় করে দেয়নি ভেবেই অবাক হচ্ছি। ঘন্টা দুই ট্রেক করে আমরা একটি ঝিড়িতে এসে পড়লাম। অপূর্ব সুন্দর সেই ঝিড়ি। ছায়াময় দুপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেড়া সেই ঝিড়ি। হঠাত্ করেই পুরো ট্রেইলটা ঠান্ডা হয়ে গেল। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ঝিড়ি। ঝিড়ির ঠান্ডা পানি ধরে আমরা আপ স্ট্রীম ধরে ট্রেক করা শুরু করলাম।
পুরো ঝিড়ি পথে বড় বড় পাথরের বোল্ডার। হঠাত্ করেই পাহাড়ের খাঁজ থেকে চঞ্চলা কিশোরীর মত ফুটে উঠল হাম্মাম জলপ্রপাত। চারদিক দিয়ে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটু ফাকা জমি আছে পাশে। প্রায় ৭০ফিট উপর থেকে পানি ধারা নীচে নেমে আসছে। ক্যাসকেডের সামনে বিশাল বিশাল কয়েকটি বোল্ডার যেন পাহাড়া দিচ্ছে প্রকৃতির এই সম্পদকে। নানা রকম পোকা অর ঝিঁঝিঁর ডাকে পুরো খাঁজটা টটস্ত।আমাদের সাড়া পেয়ে কয়েকটি কাঠবিড়ালি তিড়িং বিড়িং করে পালিয়ে গেল।
প্রকৃতির এই খেলা দেখে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। নতুন উদ্যোমে আমরা ক্যাম্প সাজানোর রসদ পেয়ে গেলাম। শিহাব ভাই শুকনো কাঠ যোগার করতে লাগল, এই ফাঁকে আমি টেন্ট খাটানোর জায়গা পরিষ্কার করে শুকনো পাতার কুশন বানিয়ে টেন্ট সেটআপ করে ফেললাম। বৃষ্টির দিনে শুকনো কাঠ খুঁজে পাওয়া খড়ের মধ্যে সুঁই খুঁজে পাবার মতই প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ভিজে থাকা ড্যাম্প কাঠ আর বাঁশ দিয়ে আগুন জ্বালানো টা যে কি রকম কষ্টকর ছিল বলে বুঝানো যাবে না। এদিকে দিনের আলো নিভে যাচ্ছে আর সারাদিনের অভুক্ত পাকস্থলিতে ছুঁচোরা ডনবৈঠক মারছে।
জীবনে শ্রেষ্ঠ খিচুরি টা মনে হয় সেদিনই খেয়েছিলাম আমরা। সূর্য ডুবে গেলে জঙ্গল জেগে উঠে জিম করবেটের এই কথাটার প্রমান দিতেই বুঝি হঠাত্ করেই পুরো রাজকান্দি জেগে উঠল। চেনা অচেনা নানারকম আওয়াজে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। নিকষ কালো অন্ধকারে পাহাড়ী খাঁজটা ডুবে গেলে অন্য রকম এক আতঙ্ক এসে ভর করল আমাদের উপর। আমরা যেখানে আছি তার কিছুটা দূরেই বিএসএফ এর ক্যাম্প। আসার সময়ই তাদের টিনের চালা গুলোর ঝলকানি দেখেছিলাম।
আমাদের ক্যাম্প ফায়ারের আলো লক্ষ করে যদি তার টহল দিতে আসে, কি হবে?
কাঠ চোরাকারবারি রা যদি ভেবে বসে তাদের উপর স্পায়িং করতে আমরা এসেছি?
কিছু তো বলার ও সুযোগ পাব না। তার আগেই গলা আর ধড় আলাদা করে দিবে।
এটা ভাবার সাথে সাথেই মনে হচ্ছিল কেউ পাহাড়ের উপর থেকে আমাদের লক্ষ করছে। হঠাত্ করেই জঙ্গল অস্বাভাবিক ভাবে শান্ত হয়ে গেল।
আতঙ্ক আর সময় কাটানোর জন্য আমরা জাল বুনে ঝিড়িতে চিড়িং মাছ ধরতে লাগলাম। এক সময় ব্যাপারটা নেশার মত হয়ে গেল।টর্চের আলোয় চিংড়ির চোখ জ্বলে উঠলেই জাল দিয়ে ঘাত মারো।
আগুন জ্বালানো টাও খুব মজাদার একটা খেলা ছিল। মাঝরাত পর্যন্ত আগুন নিয়ে খেলা করে এক মগ কড়া ব্ল্যাক কফি খেয়ে শুতে চলে গেলাম।
টেন্টে ঢোকার আগে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে একটাও তারা নেই। রাতে বৃষ্টি পরবে।
সারাদিনের পরিশ্রম আর খাটুনির ফলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাই নি। রাত প্রায় ৩টার দিকে শুরু হল বজ্র বৃষ্টি সাথে তুমুল বাতাস। বাতাসের তোড়ে টেন্টের উপরের কভারের একটি ফ্ল্যাপ ছুটে গেল। সাইডের নেট দিয়ে পানির ছিটে স্লিপিং ব্যাগ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অনেক কষ্ট করে ফ্ল্যাপ লাগিয়ে আবার মড়ার মত ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল ৮টায়। ক্যাম্পের সব গুছিয়ে, প্লাস্টিকের প্যাকেট সহ সব লিটারিং প্যাক করে আমরা ফেরার জন্য রওনা দিলাম। মাঝপথে মিন্টু আর পারার একজন বয়স্ক লোক সাথে দেখা হয়ে গেল তারা আমাদের খোঁজেই আসছিল। পুরো গ্রাম নাকি আমাদের জন্য চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে নাই। তাদের ব্যবহারে উষ্ণতা আমাদের ছুঁয়ে গেল। ঝিড়ি ধরে ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম পারার দিকে।পারার সবাই আমাদের দেখে খুব খুশি হল। তাদের সরলতা দেখে ক্রমেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আবার চাম্পারাই হয়ে কুরমা ট্রেক করলাম। বাস দিয়ে বিকেলেই পৌছে গেলাম শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে রাতে ঢাকা।
এমন অসাধারন একটি ট্রিপের জন্য আমি শিহাব ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। উনি না থাকলে এই নির্জন পাহাড়ী বন্যতা এভাবে হয়ত উপভোগ করতে পারতাম না।
ছবিঃ চৌধুরী শাহ্ আহমেদ শিহাব।
একটা অনুরোধ থাকবে... যেখানেই যান, পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখবেন... যেখানে সেখানে পলি ব্যগ ও ড্রিঙ্কস এর বোতল ফেলবেন না...আসলে কোন কিছু না ফেলাই ভাল... কস্ট করে ডাস্টবিন এ ফেলুন বা ময়লা যেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এমন জায়গায় ফেলুন... আমরা সধারনত ময়লা ফেলার জন্য নিজেরা ব্যগ সাথে নেই, সব একত্র করে পরে ডাস্টবিনে ফেলি... আশা করি ভ্রমন বিলাসীরা মনে রাখবেন... ভ্রমন শুভ হোক..
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৪৭