আজকের রাত একদম অন্যরকম....আমার জীবন নতুন এক মোড়ে ঘুরে গেছে।এখন ও স্পস্ট মনে পড়ে সেই রাত টার কথা ..... শেষ বিকালে পৌছে গেলাম আমার নতুন স্কুল কাম আমার নতুন বাসায়। সবকিছুই আগে থেকে চেনা। গত ২মাস ধরে একটু একটু করে এর সাথে আমার পরিচয়... প্রতিদিন গাড়ীর কাঁচের ভিতর দিয়ে এই জায়গা টা কে দেখতাম আর নিজেকে শক্ত করতাম... প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখতাম এই সবুজ বিশাল খেলার মাঠ, মাঝে লাল ইটের কয়েকটা বিল্ডিং।আব্বু চেনাত...এটা হইল জয়নুল আবেদিন হাউস...আর এটা কুদরত-ই-খুদা হাউস। তোকে এখন থেকে এখানেই থাকা লাগবে। তবু ও আজকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে। ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করেছিলাম বলেই হয়ত আমার কপালে জয়নুল আবেদীন হাউস জুটেছিল। সিট পরল সেকশন-3 তে- বেড নাম্বার ১৭। ভাগ্য খুবই ভাল ছিল বলতে হবে...সেকশন-3 এর বেস্ট সিট পেয়েছিলাম। বেডের পাশেই ছিল লকার আর বেডের সামনে এক টুকরো খোলা জায়গা। কলেজ থেকে যে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের যে লিস্ট দিয়েছিল, আব্বাজান সেগুলো বেশ যত্ন নিয়েই কিনে এনেছিলেন। সবকিছু ব্যাগ থেকে নামিয়ে গোছগাছ শুরু করলাম। তপু ভাই খুব হেল্প করল। কোন জিনিস টা কোথায় রাখতে হয় তা দেখিয়ে দিল। এইদিকে দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে গেল। আব্বু আম্মুকে এখন চলে যেতে হবে। ঠিক সেই সময় হল একটা কাহিনী...আমি অভ্যাস মত ২টা বালিশ সাথে এনেছিলাম। এখন শুনি একটার বেশী বালিশ allowed না। আয় হায়...আমি ঘুমাব কিভাবে? ২টা বালিশ ছাড়া আমার ঘুমই আসবে না। আমার আদরের নরম হাত বালিশ টা আব্বু নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখেই বুক টা মোচড় দিয়ে উঠল আর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। আম্মু কিছুক্ষন কান্নাকাটি করল...পরে আব্বুর ধমক খেয়ে ফোঁপানি শুরু করল। আমি তখন বালিশ শোকে কাতর। এরপর শুরু হইল আব্বাজানের নসিহত বর্ষন...ভাল মত থাকবি, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করবি, দুষ্টামি করবি না, লেখাপড়া মন দিয়ে করবি, তোর উপর অনেক আশা ভরসা আমার...bla bla bla o_O
সময় শেষ হয়ে গেছে। আব্বু আম্মু কলাপসিবল গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে….এটা দেখতে খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তাদের আর কোনদিন দেখতে পারব না।খুব খুব কষ্ট হচ্চিল তখন। চোখ বন্ধ করে আল্লাহ কে ডাকা শুরু করলাম।
...এটাই ছিল আমার শেষ কান্না।
আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেল। চারিদিকে অবস্থা একই রকম। একে একে পরিচিত হলাম আমার নতুন জীবনের বন্ধুদের সাথে|আমার বেডের ডান পাশে সজীব আর বাম পাশে মিশু|
¬জীবনে প্রথমবার ডাইনিং এ খাওয়ার জন্যে ঢুকলাম|ও বাবা, বিশাল এক হল ঘর...সারি সারি টেবিল আর চেয়ার| ডাইনিং এর সিস্টেম টা খুব ফাটাফাটি ছিল| প্রতিটা টেবিলে ক্লাস ৩-৭ এর ৩জন করে থাকত| সব কয়টা টেবিলে একজন করে লিডার থাকত| লিডার হত ক্লাস সেভেন থেকে|
মুলতঃ ডাইনিং ই ছিল সিনিয়রদের সাথে পরিচয়ের জায়গা| এইখানেই সব খেলা হইত| খেলা মানে পলিটিক্স|কেউ কি বিশ্বাস করবে, এখানে আমাদের পলিটিক্স এ হাতে খড়ি হয় ক্লাস থ্রি থেকে???হাহাহা... পলিটিক্স এর কথায় পরে আসি|
…টেবিলেই সিনিয়রা উপদেশ যা দেওয়ার দিয়ে দিল| উপদেশ এর আড়ালে প্রচ্ছন্ন হুমকি বুঝতে সমস্যা হয় নি কারো|সিনিয়রদের অবাধ্য হইলে খবর আসে এটাই চামের উপর বুঝায়া দিল|
খাওয়ার পর গেলাম সবাই দল বেধে দাঁত ব্রাশ করতে| লাট সাহেবের মত নাইট ড্রেস পরলাম| রাত তখন মাত্র ১০টা...এখন নাকি ঘুমানোর টাইম...জীবনের প্রথমবার নীল রঙ এর মশারী টানাইলাম| এই কাজটা আমি মনে প্রানে ঘৃনা করি...এখনও|
গেলাম তো ঘুমাতে মাগার ঘুম তো আর আসে না| পাশের সিটে সজীবের ফোঁপানোর আওয়াজ পাচ্ছি|কথা বলার চেস্টা করেও পারলাম না|কেমন যেন অসস্তি লাগছে| ছটফট করছি| কই ছিলাম আর কই চলে আসলাম| অনেক রাগ লাগছে আব্বুর উপর| আব্বুর সাথে আর কোনদিন কথা বলব না ঠিক করলাম|
কত বন্ধু ছিল আমার...আর দেখা হবে না তাদের সাথে| বাসায় কত হৈ-হুল্লর করতাম...জীবন টা দেখতে দেখতে পাল্টে গেল...।
এই কুলাংগার টারে আর বাসায় রাখা যাবে না। হোস্টেল এ রেখে আসব। ছাগলনাইয়ায় একটা মাদ্রাসা আছে...পিটায়া একদম সোজা কইরা ফেলবে।
ব্যাস শুরু হইত আম্মাজানের মড়া কান্না...এত পাষান তুমি?? কতই বা বয়স ওর? বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। ওরে ছাড়া আমি থাকব কেমনে। তুমি থাকতে পারবা?...তখন আব্বাজান বলত- ওর ভালোর জন্যেই পাঠাইতে হবে।
আব্বু-আম্মুর প্রতিদিনের ঝগড়া দেখতে দেখতে এক সময় ছাগলনাইয়ার ভয় মনের ভিতর বাসা বেধে ফেলল।
একেক জন একেক রকম তথ্য দিল।৬ বছরের আমার জন্য সেই সব তথ্য ছিল খুবইই ভয়ংকর। ছাগলনাইয়ার মাদ্রাসার মোল্লারা নাকি ১০মিনিট পর পর পশ্চাৎদেশে বেত দিয়ে আদর করে।কোনদিন বাসায় আসতে দেয়না। বাসার কারও সাথে দেখাও করতে দেয়না।
আমার সব ভাই-বোনেরা এটা নিয়ে ভয় দেখাত।এই ব্যাপারে সবচেয়ে খারাপ ছিল আপি। প্রতিদিন ওকে ধরে পিটাতাম আর ও আব্বুর কাছে গিয়ে বিচার দিত।
তখন বাসার সবার মত আমার ও আব্বুকে হিটলার মনে হত। আব্বুর হিটলার নাম টা আমার বড় চাচার দেয়া। একদম appropriate নাম। তার চেহারা টাই ভয় পাওয়ার মত। ইয়া বড় গোফ, বদরাগী, ভ্রু ২টা সব সময় কুচকানো…কেউ কনোদিন তার মুখে একটা মিস্টি কথা শুনে নাই।আব্বুকে ভয় পায়না এমন খুব কম মানুষ ই পৃথিবী আছে। এখন একমাত্র ছিল দাদি ই আমার ভরসা...
দাদির ছত্রছায়ায় আমার শয়তানির পাল্লা ও দিন দিন ভারি হতে লাগলো। ...দেখতে দেখতেই এক সময় শয়তানির ঘড়া ভরে গেল।
এক বছর ও গেলো না...আল্লাহ আমার উপর রাগ করে দাদিকে নিয়ে গেল।
...শুরু হল হিটলারের অত্যাচার।কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আবিস্কার করলাম। প্রতিদিন ভোরে আব্বাজান ওরফে হিটলার পড়াতে বসাত। সারাদিন পড়তাম। অংক ভুল করলে মাথায় ঠুয়া জুটত। আমি কোনদিন ই গলায় আওয়াজ করে পড়তে পারি না।এর জন্যে যে কত ঠুয়া খাইসি...
কয়েকদিন পর শুরু হইল থার্ড ডিগ্রি অত্যাচার। প্রতিদিন নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতাম কোচিং করতে। তখনই “ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ” কে প্রথম দেখি। দেখ কি সুন্দর জায়গা...কত বড় মাঠ...ইচ্ছামত খেলতে পারবি- এইসব বলে আমাকে লোভ দেখাত। তখন মাত্র ক্লাস ২ তে পড়ি।কলেজে ক্লাস ৩ থেকে ভর্তি নেয়। আমি দিনরাত পড়তাম আর প্রতিদিন ঢাকা যেতাম।তখন আমি পড়তাম জেলা স্কুলে।আমার ৩টা চাচাতো ভাই-বোন ও আমার সাথে পড়ত।স্কুল ছুটি...সবাই নিচের উঠানে ধুমায়া খেলছে...আর আমি অংক করছি। টপটপ করে চোখের পানিতে খাতা ভিজে যেত...কিন্তু হিটলারের মনে দয়া-মায়া জাগ্রত হত না ...উল্টো আমার ভাই-বোন গুলা ঝারি খেত। দেখতে দেখতে ভর্তি পরীক্ষা চলে আসল...আর এখন আমি এইখানে...এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমায় পড়লাম টের ই পাই নি।
[link|http://www.somewhereinblog.net/blog/dukhimanob/29209939|আমার বান্দর বেলা [পর্ব দুই]]
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১১ রাত ১১:৪৬