তিথি গতকালকেই এসেছে। এয়ারপোর্টে আনতেও গিয়েছিলাম। তবে তখন বিশেষ কথা হয়নি। কথা বলার মৃদু চেষ্টা করেছিলাম, কাজে দেয়নি। ‘হু’ ‘হা’ জাতীয় উত্তর দিচ্ছিল। ওকেও দোষ দেয়া যায় না। লম্বা এক জার্নি করে এসেছে। টায়ার্ড তো লাগবেই। আমাদের বাসায় নিয়ে যাবার অফার করেছিলাম, রাজী হয়নি। সেটাও খারাপ না। যেহেতু আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি, একটু দূরত্ব থাকাই ভালো। ভেবেছিলাম আজ ও হয়তো রেস্ট নিয়েই কাটাবে। পরশু নাগাদ হয়তো কথা বলার সুযোগ হবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না।
সকালেই ফোন পেলাম, ‘কথা আছে’। আর সেকারণেই হোটেলে ছুটে আসা। আমাকে নিচে, লবিতেই অপেক্ষা করতে বলল। এখন আমি সেটাই করছি। তিথি অবশ্য বেশ পাংচুয়াল। দশ মিনিট মানে দশ মিনিট। যেকোনো সময়েই এসে পড়বে। অস্বীকার করব না, কিছুটা টেনশড ফিল করছি।
তিথিরা আমেরিকায় সেটেলড। প্রথমে ওর ভাই সেখানে যায়। সিটিজেনশিপ পেয়ে একে একে সবাইকে নিয়ে যায়। তিথি যখন ওখানে যায়, তখন অর বয়স মাত্র দশ। ফলে ওকে ‘বর্ণ অ্যান্ড ব্রট আপ ইন আমেরিকা’ গ্রুপেই ফেলা যায়। দেশ নিয়ে এমন কোন আদিখ্যেতা নেই। দেশীয় সংস্কৃতি, চালচলন মেনে চলবে, এমনটা না। বাংলা জানে, কিছু বাঙ্গালী বন্ধু বান্ধবও হয়তো আছে, তবে ব্যাস ঐ পর্যন্তই। বলা যায় বাঙ্গালী ব্যাপারটা ওর ভেতর আর বড়জোর ২০ ভাগ অবশিষ্ট আছে। সেই বিশ ভাগের মধ্যেই আমি পরেছি। কাটিয়ে উঠতে না পারা কোন এক অজানা ভয়ের কারণে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিয়ে বাঙ্গালী ছেলেকেই করবে।
ওখানে হয়তো চেষ্টাও করেছিল। অবশেষে আমি। ঘটক দিয়েই বিয়ের আলাপ আলোচনা হয়। কিছুদিন আগে এসছিল। ছেলে দেখতে। তখন আরো সব ছেলের মতো আমিও ইন্টারভিউ দিই। বেশ অনেক কয়জন পাত্রকে হারিয়ে অবশেষে আমি জয়ী হই, হবু বর হিসেবে সে আমাকে পছন্দ করে।
--কেমন আছো?
বোধহয় নিজের স্মৃতিতে বেশি মগ্ন ছিলাম, তাই দেখতে পাইনি। তিথি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেবল গোসল সেরে এসেছে। দারুণ ঝকঝকে লাগছে। এমনিতেও তিথি বেশ সুন্দরী, তারপরও চোখে পড়ার মতো হচ্ছে ওর স্মার্টনেস। ঠিক বাঙ্গালী মেয়েদের মত হেলেদুলে চলে না। পোশাক যা ই পড়ুক সেখানে থাকে একটা পরিপাটি ভাব।
--কি হোল?
বোধহয় একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, তাই উত্তর দিয়ে দেরী করে ফেলেছি। কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলাম, তারপরও একটু ফ্লার্ট করার জন্য বললাম
--বেশ সুন্দর লাগছে।
তিথি স্মিত হাসল। সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল
--তোমার খবর?
--চলে যাচ্ছে। তোমার?
এবার খুব ভালোভাবে চোখ তুলে তাকাল। চোখে কেমন যেন একটা সিরিয়াস ভাব। বুকটা ধক করে উঠল। মনে হচ্ছে, খুব কঠিন একটা কথা বলবে।
--সেটা বলতেই এসেছি।
২
মাথা রীতিমত ভোঁ ভোঁ করছে। আমেরিকা এগিয়ে গেছে, তবে এতোটা, তা ভাবিনি। তারচেয়েও বড় কথা মনে মনে অনেক কিছু ছাড় দেয়ার যে পরিকল্পনা আমি নিজে করে রেখেছিলাম, সেখানে এমন কোন সম্ভাবনার কথা কাস্মিন কালেও ভাবিনি। কি যে করব, ভেবে পাচ্ছি না। আমেরিকা যাওয়ার এই সুযোগ হারাতেও মন চাইছে না, আবার যে শর্ত তিথি দিয়েছে, সেটাও পেনে নিতে পারছি না।
আমার সম্পর্কে তো বলাই হয়নি। আমি ইঞ্জিনিয়ার। ছাতার মত গজিয়ে ওঠা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছি। ফলন বেশি হলে যা হয়, দাম পাওয়া যায় না। আমারও অনেকটা সেই অবস্থা। চাকরি জুটছিল না। জুটছিল না কথাটা আংশিক সত্যি, কারণ জুটছিল, তবে খুব ভালো কিছু না। মামা চাচার জোর একেবারে নেই তা ও না, তবে সেই জোরেও খুব ভালো কিছু জুটছিল না। অভিজ্ঞতা নেই, মেনে নিচ্ছি, তবে যেসব যায়গায় কাজ পাচ্ছি, সেখানকার অভিজ্ঞতা পরে খুব একটা কাজে দেবে না, এটাও ঠিক। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, ভালো কোথাও ঢুকতে।
এমন সময় ঘটক সাহেব প্রস্তাবটা আনেন। মেয়ে আমেরিকায় থাকে, গ্রীন কার্ড আছে, বিয়ের পরে নিয়ে যাবে। নিঃসন্দেহে লোভনীয়। বাসায় সবাইও খুশী। এখন মেয়ে আমাকে পছন্দ করলেই হয়। মেয়ের সঙ্গে যেদিন আমার পরিচয়ের সুযোগ হল, সেদিন সত্যিই বেশ অবাক হয়েছিলাম। দেখতে এমন কিছু খারাপ না। অন্ততঃ প্রেম হওয়া উচিৎ। তারপরও কেন হয়নি কে জানে। হয়তো ওখানে বাঙ্গালী বা বলা যায় মনের মত বাঙ্গালী ছেলে পায়নি।
ওখানকার কাউকে কেন পছন্দ করেনি, জানি না। হয়তো পরিবারের ভেতরে কিংবা ওর নিজের ভেতরেও বাঙ্গালী প্রীতি থেকে গেছে। সেকারণেই বাংলাদেশে আসা। আলাপ পরিচয় হল। বেশ ভালো লাগলো। তেমন ন্যাকামি নেই। বেশ সোজা সাপটা কথা বার্তা। আমি কি করি, কি করতে চাই, কেন বিয়ে করছি এসব জানতে চাইল। খুব দ্রুতই বুঝে গেলাম, মিথ্যে বললে, ফেল করব। অকপটে সব বললাম। ‘গ্রীন কার্ডের লোভেই বিয়ে করছি’—বলতে লজ্জা লাগলেও, বললাম।
সেটাই সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি কাজে দিল। পাত্র হিসেবে আমি সেলেক্টেড হলাম। বেশ খুশিই হলাম। বাসায়ও সবাই আনন্দিত, তবে আমেরিকায় যেতে পারছি দেখে, না আমার বিয়ে হচ্ছে দেখে, জানি না। বন্ধু বান্ধবদের ভেতরও অনেকের মাঝে মৃদু ঈর্ষা দেখতে পেলাম। আবিস্কার করলাম, আমার বিয়ে হচ্ছে না, একটা চাকরি হচ্ছে। বরের চাকরি। বলতে পারেন, সেটাও মেনে নিয়েছিলাম। কম বেশি সব ছেলেই তো তাই করে। বর হিসেবে জীবন পার করে। সবাই সেটা মাথা উঁচু করে করে, আমি কিছুটা নিচু করে করব।
তবে তিথির একটা ব্যাপার বেশ ভালো লেগেছিল, আমাকে অসম্মান করেনি। ওর দয়ায় যে আমি আমেরিকায় যেতে পারছি, তা দেখানোর কোন চেষ্টা করেনি। বরং কেমন যেন বন্ধুর মত পরামর্শ দিচ্ছিল, কি করতে হবে, কি কি সমস্যা হতে পারে। সেবার এর চেয়ে বেশি কথাবার্তা এগোয়নি। এরপরে ও চলে যায়। কথা ছিল, জানুয়ারীর ছুটিতে বিয়ে করতে আসবে। এরমাঝে ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো আমাকে সেরে রাখতে বলেছিল। আমি সেসবই করছিলাম। এমন সময় এই হঠাৎ আগমন।
কেন আসছে, তা জানাল না। জানুয়ারীতে তো বিয়ে করতে আসছেই, তাই শুধু শুধু কেন তিনমাস আগে আসছে, বুঝতে পারছিলাম না। মনে একটা ভয় কাজ করছিল, বোধহয় শেষ মুহূর্তে ও মন পাল্টেছে কিংবা অন্য কাউকে পছন্দ করেছে। যেটাই হোক, প্রস্তুত ছিলাম। খারাপ লাগছিল না, তা না। তবে বেশি খারাপ লাগছিল, ওকে হারানোর কথা ভেবে। বোধ হয় প্রেমে পরে গেছি। লোভের কারণে শুরু হলেও পরে ব্যাপারটা আর তেমন থাকেনি। মাঝে মাঝে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যাট সব মিলিয়ে সম্পর্ক অনেকটাই নিবিড় হতে শুরু করেছিল। কাল যখন ও ভালোভাবে কথা বলেনি, তখন সত্যিই খুব খারাপ লেগেছিল। ‘টায়ার্ড’ বা ‘এতো লং জার্নি’ এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেও, মনে মনে জানতাম, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে এই, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
৩
কথাটা শুনেই বুকে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। কি এমন কথা, যা বলতে এতো কষ্ট করে তিথি আমেরিকা থেকে এসেছে। তার চেয়েও বড় কথা, ফোনে বলল না কেন? আমেরিকায় মানুষ হলেও, তিথি কেবল নিজেকে নিয়ে থাকে না। তার চারপাশের মানুষ নিয়েও ভাবে। ভাই, বোন, বাবা, মা সবার প্রতিই আলাদা একটা টান ওর মধ্যে আছে। ওর কোন কাজে, অন্য কেউ যেন আঘাত না পায়, এই ব্যাপারটা ও খুব খেয়াল রাখে। তেমন গুরুতর কিছু হলে, ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়। ও যখন বলল, ‘সে কথা বলতেই এসছি’ তখনই বুঝে গেলাম, ভয়ংকর কিছু একটা হবে। এমন কিছু, যেটায় কিছুটা হলেও অন্যকে আঘাত দেয়ার ব্যাপার আছে। আর সেকারণেই বুক ঢিপ ঢিপ শুরু করে দিল।
--এনিথিং সিরিয়াস?
--ইউ ক্যান সে সো।
--আর উই ব্রেকিং আপ?
তিথি বেশ মিষ্টি করে হাসল। কেন যেন আজকে তিথিকে বেশ সুন্দর লাগছে। সেকথা বলতে গেলে ফ্লার্টিং মনে হবে। আর তেমন কথা বলার পরিবেশও এখন নেই। তবে ওর হাসি একটা নিশ্চয়তা দিল, বিয়ে নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। অন্যকিছু। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
--কোন সমস্যা?
--সর্ট অফ। বুঝলাম, যা বলতে চাইছে বলতে পারছে না। এমন কোন সমস্যা, যা শুনে আমি কষ্ট পাব বা আমার প্রত্যাশার বাইরে। ওকে সহজ করার জন্য বললাম,
--একেবারে পার্সোনাল হলে জানতে চাইবো না। তবে যদি আমাদের দুজনের জীবনকে এফেক্ট করে মনে কর, তাহলে বলে ফেল।
তিথি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। বোধহয় ঠিক করে নিচ্ছে কিভাবে বা কোথা থেকে শুরু করবে। হয়তো শব্দগুলো ঠিক করছে, কোনটিতে আঘাত সবচেয়ে কম হবে। একসময় চোখ তুলল।
--আই হ্যাভ সামথিং টু কনফেস।
টিপিক্যাল তিথি। পুরো ব্যাপারটার দোষ নিজের কাঁধে নেবে। যাই ঘটে থাকুক, মেনে নেব। বললাম
--ক্যারি অন।
--আমি যেখানে চাকরী করতাম, ওরা আমাকে একটা অফার দিয়েছে।
তিথি আমার দিকে তাকাল। বোধহয় আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে, আমি কতোটা তৈরি। ওকে আশ্বাস দিলাম
--বলে যাও
--সেটা হচ্ছে, ওরা আমাকে বেশ বড় একটা লিফট দিবে, বিনিময়ে আমাকে একটা বন্ড দিতে হবে।
--কি বন্ড?
--আগামী পাঁচ বছর ওদের সাথে থাকতে হবে। তিথির দিকে তাকালাম। সমস্যা এখানে না। ও কোথায় চাকরী করবে, সেটা ওর ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমার মতামত নেয়ারও কিছু নেই, আর সেটা জানাবার জন্য এতো কষ্ট করে এখানে আসবার কথাও না। সমস্যা অন্য কোথাও। ও হয়তো নিজেই বলবে, তারপরও ওকে সহজ করার জন্য বললাম,
--আর কিছু?
--আর এই পাঁচ বছর আই কান্ট টেক এনি বেবি। সেজন্য ওরা একটা অফারও দিয়েছে। আমার ওভাম ফ্রিজ করে রাখারা পুরো কষ্ট ওরা বিয়ার করবে।
খুব বড় সমস্যা না। পাঁচ বছর পরেই নাহয় আমাদের সন্তান হবে। এজন্য এতো ঘাবড়াবার কি আছে। ও হয়তো ভাবছে, বাঙ্গালী মানেই বিয়ের দুবছরের মধ্যে সন্তান প্রত্যাশী হওয়া। মিথ্যে বলব না, আমার প্ল্যান ছিল, একটু সেটল হতে পারলেই... যাই হোক, ওকে এখন একটু আশ্বাস দেয়া দরকার।
--চাকরিটা তোমার পছন্দ কি না? আই মিন, যদি মনে কর, ইট উইল হেল্প ইউ ডেভেলপ ইয়োর ক্যারিয়ার, আমার আপত্তি নেই।
তিথি তখনও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখ বলছে, আরও কিছু কথা আছে। এবার ভয় পেয়ে গেলাম। বিয়ের ব্যাপারেও কোন নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি? না, বোধহয়। তেমন কিছু হলে, সেটাই আগে বলত, বাচ্চার ব্যাপারটা বলত না। কিন্তু সেটা কি? আর কিছু খুজে পাচ্ছি না। মাথা কেমন এলোমেলো লাগছে।
--নিজের ব্যাপারে আমি আরও কিছু ডিসিশান নিয়েছি। ইট মে সাউন্ড সেলফিশ, বাট, ভেবে দেখলাম, এগুলো আমি খুব মনে প্রাণে চাই।
এই মুহূর্তে আমার কথা বলা ঠিক হবে না। তিথি মন খুলে তার নিজের কথা বলছে। ও বলুক। আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
--আই উইল টেক অনলি ওয়ান বেবি।
--বেশ তো।
--বাট দ্যা ফাদার উইল বি সামওয়ান এলস।
--মানে?
--কিছুদিন আগের কথা। আমি যখন ওভাম ফ্রিজিং এর সব নিয়ম কানুন জানতে যাই। দেখলাম ওরা ওভাম ব্যাংকের সাথে সাথে স্পার্ম ব্যাংক ও করেছে। ওরা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির সব টপারের স্পার্ম কালেক্ট করে রাখে। সেই ফার্টিলিটি সেন্টারে আমি যেদিন যাই, সেদিন ওখানে আই মেট অ্যা গাই। কিছুক্ষণ আলাপও হল। দুর্দান্ত ব্রিলিয়ান্ট। আই জাস্ট বিকেম হিস ফ্যান। বাট ঠিক লাইফ পার্টনার হওয়ার মত না। আই মিন, ওকে ঠিক ভালবাসিনি, আবার ভালোও লেগেছে। আমি হয়তো ঠিক বোঝাতে পারছি না। অ্যান্ড তারচেয়েও বড় কথা, আই ওয়ান্ট মাই বেবি টু বি ব্রিলিয়ান্ট লাইক হিম।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:৪২