আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা প্রবাহ নয়, এমনকি হিমালয়ের বরফ গলিত তীব্র শীতল হিমবাহও নয় সবচেয়ে বিপদজনক প্রবাহ হল গড্ডালিকা প্রবাহ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই প্রবাহেই আমরা বেশিরভাগ আমজনতা গা ভাসাতে পছন্দ করি। হয়তো আমার এই লেখার পর স্বজাতির অনেকেরই চক্ষুশূল হয়ে যাব তবুও গত কয়েক বছরের ব্লগ লিখন আর ফেসবুক বিচরণের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া কিছু কথা শেয়ার না করলেই নয়।
আমি একজন যৎসামান্য চিকিৎসক, তারচেয়েও সামান্য একজন অনলাইন পদচারি। ফেসবুক কিংবা ব্লগের মহীরুহসম নামগুলোর তুলনায় অতিশয় খুদ্র একজন। নিউটনের ভাষায় অনলাইন দুনিয়ার একটি দুটি বালুকনা কুড়িয়েছি মাত্র। যেখানে সুযোগ হয়েছে চিকিৎসকদের জন্যে কীবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়েছি, অনেকের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক করেছি। এসবের মাঝ দিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আর সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টির সাথে যুক্তির সেতুবন্ধন রচনা করার চেষ্টা করেছি। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি চিকিৎসার দরজায় কড়া নেড়ে হতাশ হওয়া মানুষগুলোর হতাশার জন্যে ঠিক কতটুকু চিকিৎসক নিজে দায়ী আর কতটুকু আমাদের ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধাভোগী কলকব্জাধারীরা দায়ী। সবক্ষেত্রে সফল হয়েছি তা অবশ্যই না তবে অনেক ক্ষেত্রেই চমৎকার সুফল পেয়েছি আমি। আমার বন্ধুতালিকাতেই এমন অনেকে আছেন যারা অনেক ভ্রান্ত ধারনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এই মানুষগুলো চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সরাসরি জড়িত না থেকেও চিকিৎসকদের ভিতরের কথাগুলো অনেকটা বুঝতে পারেন এখন, হঠাৎ করেই একটা গালি দিয়ে বসেন না বাকি অনেকের মত।
যে কথা বলতে চাইছি তা হল যারা বোঝার তাদেরকে ঠিকঠাক পয়েন্ট ধরে বোঝালে তারা ঠিকই বোঝে আর যারা বোঝার না তাদেরকে গালাগালি করলেও তারা এ জীবনে বুঝবেনা। শুধু শুধু আমাদের মুখটাই নোংরা হবে। এই কথা কেবল ডাক্তারদের প্রসঙ্গে ভ্রান্ত ধারনা পোষণকারী মানুষগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না রোগীদের বেলায়ও খাটে। একজন খুদ্র চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি ওষুধে মানুষের রোগ সাড়ে না রোগ সাড়ে মুখের কথায়। এখানটাতেই সমস্যা। এই দরিদ্র মাতার বাংলাদেশে যেখানে একজন চিকিৎসককে প্রায় সব ক্ষেত্রেই তার সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি গুণ রোগীকে সেবা দিতে হয় সেখানে এই মুখের কথারুপী মোক্ষম ঔষধটুকু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেয়া সম্ভব হয়না। যার ফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারনা জন্মায় ‘বেটা ডাক্তার আমারে দেখলই না, তার আগেই ঔষধ লিখে দিল। এই ঔষধ খেয়ে কি হবে?’ একজন চিকিৎসক মাত্রই জানেন অনেক রোগীকে চেম্বারে ঢুকতে দেখেই তার রোগ নির্ণয় করা হয়ে যায় কিন্তু সে কথা তো আমি আপনি জানি; সেই রোগী বেচারা জানে না। তাই আমজনতাকে ঢালাও দোষারোপ করা ঠিক হবে না।
একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ফেসবুকারের একটি সাম্প্রতিক পোস্ট নিয়ে চিকিৎসক এবং মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ। একটা ভার্চুয়াল তিক্তাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়। অস্বীকার করবোনা আমি নিজেও সেই অসন্তুষ্টদের একজন। এই নিয়ে একটা লেখাও পোস্ট করেছি। তাঁর স্ট্যাটাসে সেই আক্ষেপের কথা জানিয়ে কমেন্টও করেছি। খুব অবাক হয়েছি যখন দেখলাম আমার কমেন্টের কিছুক্ষণের মাঝে সেই ভদ্রলোক নিজে থেকে আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন। সেটা গ্রহণ করার পর তিনি আমাকে ইনবক্সে নক করেন। বেশ আন্তরিকভাবে অ্যাপ্রোচ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ মৃদু বিতর্ক হল। একটু সময় বাদে আমাকে অবাক করে দিয়ে তাঁর ইনবক্সে আসা কিছু মেসেজ লিখে দেখালেন সংশ্লিষ্ট প্রেরণকারীর প্রোফাইল লিংক সহ। আমি সেগুলো পড়ে আর তর্ক চালানোর উপায় দেখলাম না। কারন যে ভাষায় উনাকে বলা হয়েছে, তাঁর পরিবারের লোকজন তুলে আজেবাজে কথা বলা হয়েছে সেটা সত্যিকার অর্থেই আমাদের ইমেজের সাথে বেমানান, খুবই বেমানান। আমরা চিকিৎসকরা এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে মনে করি, আমরা যে দেশের সবচেয়ে মেধাবানদের একটি অংশ সে কথা নিন্দুকেরাও স্বীকার করে। সেক্ষেত্রে আমি বলব ওনার সাথে যে আচরণ করা হয়েছে সেটা প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের মত অবশ্যই হয়নি। কোন একজন মানুষ আমাদেরকে আহত করে কথা বলামাত্রই আমরা যদি উল্টো তার গুষ্ঠি ধরে গালাগালি শুরু করি তবে কোন সুফল আসার কথা না। তাকে বোঝাতে হবে অকাট্য যুক্তি এবং বক্তব্যের স্পষ্টতায়। তাহলেই প্রমাণ হবে যে আমরা আসলেই মেধাবী।
ইন্টার্ন ডাক্তার এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠরত ছোট ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা আছে বলার। আমাদের পেশা নিয়ে অপপ্রচার হয় খুব, পত্রিকাওয়ালারা আমাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারলে খুশিতে বাক বাকুম হয়ে যায় কারন তারা ভাল করে জানে যে এই জাতীয় খবর লোকে খাবে ভাল। এইসব অপপ্রচার, ডাক্তার সমাজের প্রতি আমজনতার ঘৃণায় ঠাসা অনুভুতির সাথে পরিচিত হয়ে আপনারা অনেকেই খুব হতাশ হয়ে পড়েন। পেশা জীবনের শুরুতেই অথবা প্রবেশের আগেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে আপনাদের মনোজগতে একটা বড় রকমের আঘাত আসে। তাই আপনারা যখন দেখেন ভার্চুয়াল জগতে বিভিন্ন গলি ঘুপচিতে সুযোগ হলেই লোকে ডাক্তারদের পিণ্ডি চটকাচ্ছে আপনারা কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তখনই কারো কারো পদস্খলন হয়। আমি বলছিনা সাত চড়ে রা করেনা টাইপ রামগরুর ছানা হয়ে থাকতে, প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করবো এবং সেটা অবশ্যই কঠোর হবে কিন্তু সেই সাথে যেন যুক্তিপূর্ণও হয় সেদিকটা একটু খেয়াল রাখার অনুরোধ করছি আমি। একটা নমুনা উদাহরণ দিচ্ছি কেবলঃ
অধিকাংশ লোককে বলতে শুনবেন
‘ডাক্তাররা এতো টাকা পিপাসু কেন? রাত দুইটা পর্যন্ত একেকজন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখে! ওদের কত টাকা দরকার?’
আপনার ক্ষেপে যাওয়ার দরকার নাই। আপনি শুধু বলেন- 'ঠিক আছে আপনার কথা মেনে নিলাম। সারাদেশে কোন ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বারে একটা রোগীও দেখবে না। এখন আপনি বলেন রোজ সন্ধ্যার পর থেকে সারাদেশে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে তারা কিভাবে চিকিৎসা নিবে? সরকারী হাসপাতালে এমনিতেই রোগী দাঁড়ানোর জায়গা থাকেনা। তাহলে এদের কি গতি হবে? বিনা চিকিৎসায় থাকবে?'
দেখবেন এরা কোন উত্তর খুঁজে পাবেনা।
আমরা যদি নিম্ন শ্রেণীর কিছু মানুষের মত লাগাতার খিস্তি খেউর করি তবে আমাদের নিজেদের অবস্থানই কেবল নীচে নামবে, যাদের উদ্দেশ্যে করছি তাদের কিছু যাবে আসবে না। স্বীকার করছি মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত চিড়িয়ার দেখা পাওয়া যায় যারা কিছুতেই কিছু বুঝতে চায় না, উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে, মন্তব্য করে। যদি মেজাজ ধরে রাখতে না পারেন তবে বলব আজকাল ব্লগ-ফেসবুকে অনেক ডাক্তার অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা লিখছে সেইসব লেখা গুলো সংগ্রহে রেখে দিবেন, তাদেরকে পড়াবেন, জবাব দিতে বলবেন। সব কিছুর পরও যারা ২+২ = ৪ একথা মানবে না, ঘাড়ে ঠেলে তর্ক চালাবে, তালগাছের গোঁড়া আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকবে ওগুলোকে ব্লক করে ওদের ভার্চুয়াল আত্মাকে শান্তি প্রদান করাই শ্রেয় বলে মনে হয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের পেশায় গুটিকয় পূর্বসূরিদের কিছু অপকর্মের ভূমিকা আছে আজকের ডাক্তার সমাজের দুরবস্থার জন্যে। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন; কোন একজন ডাক্তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চাসনে বসে স্বজাতির দিকে তাকিয়েছে বলে মনে পড়েনা। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা পরবর্তীতে নবীন চিকিৎসকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর কথা মনে করেননি। তারা কেউ কেউ টাকার পিছনে ছুটেছেন, ডিউটি ডাক্তারকে দিয়ে অ্যাসিস্ট না করিয়ে ওয়ার্ডবয়, নার্সকে বেছে নিয়েছেন। আর সেইসব অগ্রজদের কয়েকজনের অপকর্মের দায়ভার যখন অনেকাংশে সৎ, নিষ্ঠাবান এবং পরিশ্রমী এ প্রজন্মের ডাক্তারদের কাঁধে এসে ভর করে তখন সেই বোঝা বইতে ইচ্ছে করেনা একদম।
আমজনতা যখন ঢালাওভাবে আমাদের পেশা তুলে গালাগাল করে তখন রাগ হয়, ঘেন্না ধরে; মনে হয় মানুষগুলা এতো অকৃতজ্ঞ কেন? বিশ্বাস করুন এই অনুভূতি আপনার চেয়ে আমার একবিন্দু কম না বরং অনেক বেশি হবার সম্ভাবনা। এই নিয়ে অসংখ্য লেখা লিখেছি বিশাল বিশাল মন্তব্য লিখেছি ব্লগে, ফেসবুকে নানা জায়গায়। সবকিছুর পরও এই কথা ভুলে যাওয়ার উপায় নেই আমাদের পূর্বসূরিদের কোন একজনের অপকর্মে, অবহেলায় বা এক মুহূর্তের মনঃসংযোগের ঘাটতির কারনে যে মানুষটি তার মা’কে হারিয়েছে বা সন্তানকে হারিয়েছে তার কাছে আপনি আমি কতটা সৎ-নিষ্ঠাবান ডাক্তার তার কানাকড়ি মূল্য নেই। ডাক্তার মাত্রই তার কাছে চক্ষুশূল হবে এটাই স্বাভাবিক। এরকম একজন মানুষকে যদি আমরা অফেন্সিভ কথা বলি তবে পাল্টা আক্রান্ত হব এটাই স্বাভাবিক। আহত একজন মানুষকে আঘাত করে ভাল কিছু পাওয়ার আশা করে লাভ নেই। আমরা যদি একেকজন নিজেদেরকে আরও পরিষ্কারভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারি তবে লোকজন নিশ্চয়ই বদলাবে, খুব ধীরে হলেও বদলাবে। আমি এমন অনেককে পেয়েছি যারা আগে সমানে আমাদেরকে গালমন্দ করতো কিন্তু এখন আমূল বদলে গেছে। আমাদের নিয়ে কেউ আজেবাজে বললে তারাই এখন প্রতিবাদ করে। ঘরের খেয়ে ফেসবুকের মোষ তাড়ানো একদম বৃথা যায়নি – এমন অনুভূতি হয় তখন আমার।
সমাজের অধিকাংশ মানুষ আমাদের প্রতি বিরুপ ধারনা পোষণ করে। এসব দেখে আমরা একেকজন ক্লান্ত, ভঙ্গুর প্রায়। তবু দেখুন একটানা ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে ডিউটি করার পরেও যখন আপনার ডিউটি রুমের দরজায় এসে একটা কিশোর হাঁপাতে হাঁপাতে বলবে – "স্যার! আমার মা’কে বাঁচান! মা যেন কেমন করতাছে!" আপনি তখন ঠিকই এক নিমেষে সব ক্লান্তি ভুলে গিয়ে স্টেথোস্কোপ নিয়ে ছুটে যাবেন সেই মা’কে বাঁচাতে। রাত তিনটায় ঘুম ভাঙিয়ে যখন আপনার প্রতিবেশী কান্নাভেজা কণ্ঠে বলবে "বাবা! আমার বাচ্চাটা তো চোখমুখ উলটে দিচ্ছে। আমার খুব ভয় লাগতাছে বাজান! তুমি একটু আস" আপনি সেই মুহূর্তের মাঝে দৌড়ে যাবেন সেই শিশুকে বাঁচাতে।
মানুষ স্বীকার করুক কিংবা অকৃতজ্ঞ থাকুক আমাদের কাজ আমরা করে যাবই। দিনের শেষে এই বুঝ-অবুঝ মানুষগুলোকে নিয়েই আমাদের জীবন। সেই জীবন যখন সঙ্কটাপন্ন হবে তারা আমাদের কাছেই আশ্রয় খুঁজবে। যতোই রাগ করি, অভিমান করি আমরা ঠিকই জানি তাদের অসহায় মুখগুলো দেখে আমরা কখনোই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবোনা। এটাই আমাদের পেশার মাহাত্ম।
আমি একজন চিকিৎসক, আমি একজন গর্বিত মানুষ।