২৩ বছরের একজন মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রী তার ছেলে বন্ধুসহ দিল্লীর রাস্তায় রাত নটার কিছু পরে বাসে করে যাচ্ছিল। বাসের ভিতর হাতে গোনা কয়েকটি যাত্রী। এমন সময় সাতজন মানুষ একসাথে হামলে পরে সেই মেয়েটির উপর। মেয়েটি আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, ছেলে বন্ধুটি এগিয়ে আসে তার সাহায্যে কিন্তু সবই বৃথা। সাত সাতটি পশুর সাথে তারা দুজন পেরে ওঠেনা। লোহার রড দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয় ওদের রক্ত মাংসের শরীর দুটি। একটি ঘণ্টা ধরে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়। সাতটি পশু খুবলে খায় একটি অসহায় মানবতা। খাওয়া শেষ হলে মৃতপ্রায় সেই মেয়ে এবং তার বন্ধুকে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়।
মর্মান্তিক এই ঘটনাটি গত সপ্তাহের। ভাগ্যহত মেয়েটি এখনো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়। এই ঘটনার পর থেকে ভারত এখন উত্তপ্ত কড়াইয়ের মত ফুঁসছে কেবল। হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ পথে নেমে এসেছে। তারা ঘেরাও করেছে রাষ্ট্রপতি ভবন, পার্লামেন্ট। তাদের চাওয়া একটাই এই ঘৃণিত পশুগুলোকে ফাঁসি দিতে হবে। পুলিশ তাদের উপর হামলে পড়ছে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে, লাঠি চার্জ করছে তবু মানুষের ভিড় কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। বিদ্রোহের দাবানল নেভাতে মাঝ রাত্তিরে সেখানে হাজির হয়েছেন স্বয়ং সোনিয়া গান্ধি। পরদিন আবার তিনি সেখানে গিয়েছেন পুত্র রাহুল গান্ধিকে সাথে নিয়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডেকে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন। ইতোমধ্যে আসামীরা ধরা পড়েছে এবং তাদের বিচার করা হবে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের মাঝে এমন আশ্বাস এসেছে সরকারের কাছ থেকে।
এই ঘটনায় সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হল বিদ্রোহী জনতার কাতারে কেবলমাত্র সেদেশের ডাক্তার, মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রী নেই বরং তারচেয়ে বেশি আছে সাধারন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, আছে বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠন, পথে নেমে এসেছেন গৃহিণীরা, শিশু কিশোররা। প্রতিবাদে সোচ্চার সেদেশের মানবাধিকার কমিশন,কমিশনের চেয়ারম্যান জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রতিবাদীদের কাতারে দাঁড়িয়ে একাত্ম হয়েছেন। প্রতিটি সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন টিভি চ্যানেল প্রত্যেকে তাদের মাইক্রোফোন-ক্যামেরা নিয়ে হাজির। প্রতিনিয়ত এই খবর তারা প্রচার করে যাচ্ছে। দুর্ভাগা মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েছে, তার পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্যে উৎসাহিত করছে দেশের সকল স্তরের জনতাকে।
এক নিশ্বাসে অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আসুন এবার এক সেকেন্ড জিরিয়ে নিই। একটু দম নিয়ে চলুন ভেবে দেখি ঘটনাটা। মেডিক্যালের একজন ছাত্রী, সর্বোপরি একজন নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর জনতার মিছিলে কেবল সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত ডাক্তার বা মেডিক্যাল স্টুডেন্টরা নয় আছে সব ধরনের শিক্ষার্থী, সাধারন পেশার মানুষেরাও। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পুরো দেশের মিডিয়া। এইটুকু যদি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে থাকে তবে চলুন একটু অন্য দিকে নজর ফেরাই।
গত ৩০নভেম্বর রাতে ঢাকার দক্ষিণখানের একটি ক্লিনিকে কর্তব্যরত অবস্থায় নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন আমাদের এক হতভাগ্য চিকিৎসক বোন ডাঃ সাজিয়া আফরিন ইভা। এখনো একটি মাস পেরোয়নি তবু মনে হয় স্মৃতির গর্ভ থেকে যেন উঠে আসতে চায়না বুঝি। “ডাঃ সাজিয়া ? ও হ্যাঁ হ্যাঁ! মনে পড়েছে। শুনেছিলাম বিষয়টা! আহারে বেচারি!”... এই তো! এই টুকুতেই শেষ হয়ে গেল আমাদের মানবতা। আমাদের দায়িত্ববোধের উঠোনে ঠিক এই পর্যন্তই সীমানা প্রাচীর।
একটা মানব বন্ধন রচিত হয়েছিল বিএমএ'র উদ্যোগে, ডাঃ সাজিয়ার কর্মস্থল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সামনে। সেখানে গুটিকয় চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ ছিলেন, ছিলেন উক্ত মেডিক্যালের কিছু চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট কলেজে অধ্যয়নরত আগামী দিনের চিকিৎসকরা। আর ছিলাম আমরা কিছু লোক যাদের ঘরের খেয়ে ফেসবুক/ব্লগের মোষ তাড়ানোই মূল কর্ম। ডাঃ সাজিয়াকে নিয়ে আমি যে লেখা দুটি লিখেছিলাম সেগুলো শেয়ার করা হয়েছিল ৯২৩ এবং ২৪৯৫ বার অথচ সেই লেখার পাঠকদের মাঝ থেকে ১০০ জন মানুষও হাজির হননি আমাদের সাথে প্রতিবাদ জানাতে। দুএকটি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া আর কোনটিতে এই নিয়ে কোন সাড়া শব্দ হয়নি। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা যতনের সহিত তাদের চাকুরি করে গেছেন। রোগী দেখেছেন, স্টুডেন্ট পরিয়েছেন। কোন কর্মবিরতিতে যাননি, প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করেন নি। নিজের মানিব্যাগের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন, যে সরকারের চাকর খাটেন সে সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। খুবই ভাল কথা। কিন্তু একটিবারের জন্যে কি আমরা ভেবে দেখেছি যে আমরা সবার আগে একজন মানুষ, তারপর একজন বাঙ্গালী, এরপর চিকিৎসক ও সবার শেষে সরকারী চাকুরীজীবী? সরকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিয়েছি ঠিকই কিন্তু মনুষ্যত্বের দায় দায়িত্ব এড়িয়ে গেলাম যে?
প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, হাসপাতালের পরিচালকেরা যদি বলতেন "আমার ছাত্রীকে, আমার কন্যাকে মেরে ফেলেছেন কেন? রাষ্ট্রযন্ত্র জবাব দিন। তারপর আপনার গোলামি করব।" তবে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? জানি মরুভূমিতে বাস করে আমি সুমিষ্ট ঝর্ণাধারার স্বপ্ন দেখছি। আমাদের বাঁকা মেরুদণ্ড কোনোদিন সোজা হবে না। আমাদের পৌরুষ কেবল পাবলিক বাসের সংরক্ষিত মহিলা আসন দখল করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এরচেয়ে বেশি না। আমাদের মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কেবল তার গোঁফ এবং পুংকেশরে শ্যাম্পু করা পর্যন্তই। বিদ্যা শিক্ষা হীন মানুষের মত চিকিৎসকদের রক্তচোষা, কুকুরের লেজ এসব বলে গালি দিয়ে আমজনতার বাহ্বা কুরানো পর্যন্তই দৌড় আমাদের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় ‘দড়ি মিজান’ সাহেবের। ডাক্তার মরলে তার মাথা ব্যাথা নেই, মশা মাছি মরলে বরং তার পায়ু ব্যাথা হয়। হায়রে বুদ্ধিবেশ্যাজীবী!
আর আছে আমাদের মিডিয়া। বিশ্বাস করুন একটি কথা! মিডিয়া প্রসঙ্গে অনেক বলেছি অনেক লিখেছি অতীতে তবুও অভ্যস্ত হতে পারিনি। এখনো যতবার ওদের কথা লিখতে শুরু করি ততবার আমার বমি বমি ভাব হয়, মুখে থুতু জমে। একটা টিভি চ্যানেল না! একটিও না! কোন চ্যানেল প্রচার করেনি ডাঃ সাজিয়া হত্যার সেই ঘটনা এবং এই নিয়ে ঘটে যাওয়া প্রতিবাদী মানব বন্ধনের কথা। এমনকি টিভি স্ক্রিনের নীচের স্ক্রলেও আসেনি এই খবর। আমাদের পত্রিকাগুলো ফিচার করে হলিউড তারকা টম ক্রুজ আর কেটি হোমসের মেয়ে ‘সুরি’ বড়দিনে কত দামি উপহার পেল তাই নিয়ে। উপহার হিসেবে পাওয়া সেই পুতুল বাড়িতে কতটি বাতি কতটি বাথরুম আছে এবং আরও ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ... ...! কিন্তু চিকিৎসক খুন হয়েছে তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। এই নিয়ে যখন প্রতিবাদ করে লেখা লিখি তখন 'আর টিভি'র এক সাংবাদিক এসে সেখানে জ্ঞান কপচায়, সাংবাদিকতা শেখায়। বলে যে খবর পাবলিক খাবে বেশি সেটা প্রচার করাই নাকি তাদের প্রথম কর্তব্য! আমি ভাষাহীন, সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকি।
একুশে টিভির হাত ধরে এক দল আশা জাগানিয়া সংবাদকর্মী এসেছিল আমাদের মাঝে। শাকিল আহমেদ, মোস্তফা ফিরোজ, সুপন রায়, জ ই মামুন, শাহানাজ মুন্নি, মুন্নি শাহা এবং আরও কয়েকজন। ওদের ক্যামেরা-মাইক্রোফোনের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করেছিল কোটি বাঙ্গালীর স্বপ্নসাধও। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু। একুশে টেলিভিশন তার সৌন্দর্য হারাল আর আমরা হারালাম নিবেদিত প্রাণ কিছু সংবাদকর্মী। আজকে তারা একেকজন বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদ বিভাগের হর্তা কর্তা। কার চ্যানেলের খবরের স্টুডিওটি আরেকজনের চেয়ে সুন্দর হবে, ব্যাতিক্রমী হবে সে প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই আরও আছে সংবাদ পাঠক পাঠিকাদের পোশাক ও সাজ বিলাসের বৈচিত্র্য। আহা বড় মোহনীয় দৃশ্য বটে! মুন্নি সাহাদের এখন আর পথে নামতে হয় না, রাত বাড়ার সাথে সাথে দেশের কিছু পেশাদার বুদ্ধিবেশ্যাজীবীদের সাথে বসে দেশ বিদেশের সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ হা হুতাশ করেই খালাস!
আমরা বাঙ্গালী। সকাল সন্ধ্যা পাকিস্তান ভারতের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে না পারলে আমাদের পেটের ভাত যে হজম হতে চায়না। ‘সুপার ভ্যাজমল ৩৩’ দিয়ে মাথার পাকা চুল কাল করে, গায়ে কাশ্মীরি শাল চড়িয়ে, হায়দ্রাবাদি মশলা দিয়ে একটা খিলিপান মুখে দিয়ে স্টার প্লাস দেখতে দেখতে আমরা বলি "বুঝলি মমিন দেশটা ভারতের দালালে ভরে গেছে! যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেশটারে ভারতের কব্জা থেকে বাঁচাতে হবে। হাতে সময় কম।"
অন্যের গীবত গেয়েই আমাদের দায়িত্ব সাড়া। তাদের ভাল কিছু থাকলে সেটা থেকে শিক্ষা নেবার প্রবণতা বুঝি কোনোদিন আর হবে না আমাদের। ওরা যদি পারে সব শ্রেণীর মানুষ এক কাতারে নেমে ঐ মেডিক্যাল ছাত্রীর সম্ভ্রমহানির প্রতিবাদে মুখর হতে আমরা কেন পারিনা? তাদের মিডিয়া যদি পারে অসহায় মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে আমাদের মিডিয়া কেন পারে না? জানি উত্তর আসবেনা কোনদিন। আমার অরণ্যে রোদন করার বদভ্যাস, আমি করেই যাবো। কার কি আসে যায় তাতে?