নিন্দুকেরা পৃথিবী ধ্বংসের আগদিন পর্যন্ত তাদের কাজ করে যাবেই। ওদের থামানো যাবে না। থামানোর চেষ্টা করাও উচিৎ নয়। কারন নিন্দুকের নিন্দাই একজন মানুষকে আরও বেশি অমরত্বের দিকে এগিয়ে নেয়।
বিদেশি খেলোয়াড়দের মাঝে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়টি আজ একদিনের ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন। হ্যাঁ শচীনের কথা বলছি। ছোটবেলা থেকেই শচীন এবং শেন ওয়ার্ন ছিল আমার কাছে ক্রিকেট আইকন। ক্রিকেট বলতে আমি এই এদেরকেই বুঝতাম। আরও ছিল মার্ক ওয়াহ, অ্যালান ডোনাল্ড, ওয়াসিম আকরাম। শচীনকে নিয়ে কতবার কতজনের সাথে যে তর্কযুদ্ধ করেছি তার হিসেব নেই। আমার চারদিকে একগাদা পাকিস্তান দলের সমর্থক, আমার বন্ধুরা প্রায় সকলেই। একটা সময় সাঈদ আনোয়ার আর শচীনের সেঞ্চুরি সংখ্যা যখন পাশাপাশি হাঁটছিল তখন সেই বন্ধুরা বলতো সাঈদ আনোয়ার শচীনের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু মানের ব্যাটসম্যান। আমি মুচকি হেসে বলতাম একদিন শচীন এমন উচ্চতায় নিয়ে যাবে নিজেকে যে সাঈদ আনোয়ার তারে মই দিয়েও নাগাল পাবে না। বাকিটা আজ ইতিহাস।
এরপর যখন ধেই ধেই করে শচীন এগিয়ে যেতে লাগল, একে একে বিশ্ব ক্রিকেটের সব রেকর্ড নিজের করে নিতে লাগল তখন সেই সাঈদ ভক্তরা হুট করে ব্রায়ান লারা ভক্ত হয়ে গেল। যতটা না লারার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তার চেয়ে বেশি শচীন বিদ্বেষের কারনে। তাদের কপাল ভাল ছিল যে শচীনের সমসাময়িক আরেকজন মহান ব্যাটসম্যান লারা জন্মেছিলেন। নইলে এইসব শচীন বিদ্বেষীরা কোথায় যেয়ে আশ্রয় নিতো সেটা ভেবে করুণা হয়।
লেখার এই পর্যায়ে শচীনের কিছু অর্জন আরেকবার সবাইকে মনে করিয়ে দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করছি। শচীনের যত রেকর্ড সব লিখতে গেলে আস্ত একটা বই দাঁড়িয়ে যাবে, সেসবের মাঝ থেকে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।
ওয়ানডেঃ
• সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ(৪৬৩), সর্বোচ্চ রান(১৮৪২৬), সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি(৪৯), সর্বোচ্চ হাফ সেঞ্চুরি(৯৬) – এইসব অর্জন সে করেছে ৪৪.৮৩ গড়ে এবং ৮৬.২৩ স্ট্রাইক রেটে!
• সর্বোচ্চ বার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ(৬২) এবং সর্বোচ্চ বার ম্যান অফ দ্যা সিরিজ(১৫)
• ইতিহাসের প্রথম বেক্তি হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০ রানের মাইল ফলক ছোঁয়া।
• কোন আসরের ফাইনাল ম্যাচে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি(৬) এবং এর সবকটিতেই তার দল জিতেছে।
• এক পঞ্জিকা বর্ষে সর্বাধিক রান(১৮৯৪ রান,১৯৯৮ সাল) এবং সর্বাধিক সেঞ্চুরি(৯টি,১৯৯৮ সাল)
• বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বাধিক রান(২১২০), সর্বাধিক হাফ সেঞ্চুরি(১৩), সর্বাধিক সেঞ্চুরি(৬), এক আসরে সর্বোচ্চ রান(৬৭৩ রান,২০০৩ বিশ্বকাপে)
টেস্ট ক্রিকেটঃ
• সর্বাধিক ম্যাচ(১৯৪), সর্বাধিক রান(১৫৬৪৫), সর্বাধিক সেঞ্চুরি(৫১), সর্বাধিক হাফ সেঞ্চুরি(৬৬)... এইসব অর্জন এসেছে ৫৪.৩২ গড়ে।
• প্রথম ও একমাত্র খেলোয়াড় যে ১৫০০০ রানের মাইল ফলক অতিক্রম করেছে।
সম্মিলিতঃ
• ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যে ১০০টি সেঞ্চুরি করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
• টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ৩৩০০০ এর বেশি রান।
সর্বোপরি দীর্ঘ ২৩ টি বছর ধরে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের একটি দেশের আশা আকাঙ্খাকে নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে গেছেন এই লিটল মাস্টার। ২৩ বছর ধরে ক্রিকেট খেলে যাওয়া! মাঝে 'টেনিস এলবো'র সমস্যাটা ছাড়া ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় নিজের ফিটনেস ধরে রেখেছেন সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে।
শচীনের নিন্দুকেরা প্রায়ই একটা কথা বলেন – “ হুম মানলাম সে অনেক রান করেছে কিন্তু সে ম্যাচ উইনার না” কেউ কেউ তো এক কাঠি বেশি সরেস! তারা বলে শচীনের সেঞ্চুরি মানেই দলের হার। এরকমই বলার কথা, কারন মানুষ হিসেবে আমরা গোঁজামিল প্রিয় প্রজাতি; গোঁজামিল দিতে ভালবাসি। কিন্তু পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন কথা বলে!
ম্যাচ উইনার বলতে আসলে কি বোঝায়? প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বিশাল একটা স্কোর দাড় করানো কিংবা দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নেমে শক্ত একটা ভিত তৈরি করে দেয়া নিশ্চয়ই ম্যাচ উইনিং এফোর্ট? একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে নিশ্চয়ই ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত টিকে থাকা আশা করা ঠিক না? ঐ কাজটা লোয়ার মিড্ল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। এবার তাহলে আসুন দেখি পরিসংখ্যান কি বলে... (ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত)
রান তাড়া করতে নেমেঃ
শচীনঃ ইনিংস-২২৮, রান-৮২২৫, সর্বোচ্চ-১৭৫, গড়-৪৩.০৫, সেঞ্চুরি-১৭, হাফসেঞ্চুরি- ৫১
লারাঃ ইনিংস-১৬২, রান-৫৪২৫, সর্বোচ্চ-১৫৩, গড়-৪২.৭১, সেঞ্চুরি-৯, হাফসেঞ্চুরি-২৮
পন্টিংঃ ইনিংস-১৬০, রান-৫০৭৪, সর্বোচ্চ-১২৬, গড়-৩৮.৪২, সেঞ্চুরি-৮, হাফসেঞ্চুরি-৩২
শচীনের নামে আরেকটি অপবাদ হল চাপের মুখে, বড় ম্যাচে নাকি সে রান করতে পারেনা। যে লোক নিজের পিতার মৃতদেহ সৎকার করে ঠিক পরের ম্যাচেই খেলতে নেমে সেঞ্চুরি করে তার নামে এই অপবাদ হাস্যকর বৈকি। তবু তর্কের খাতিরে সমসাময়িক সেরাদের সাথে একটু তুলনা করা যাক।
টুর্নামেন্ট ফাইনালঃ
শচীনঃ ইনিংস-৪০ রান-১৮৫১ সর্বোচ্চ-১৩৮ গড়-৫৪.৫৪(!) সেঞ্চুরি-৬ হাফসেঞ্চুরি-১০
লারাঃ ইনিংস-১৯ রান-৫০৭ সর্বোচ্চ-১৫৩ গড়-২৮.১৬(!) সেঞ্চুরি-১ হাফসেঞ্চুরি-২
পন্টিংঃ ইনিংস-৪১ রান-১৩৪৫ সর্বোচ্চ-১৪০* গড়-৩৮.৪২ সেঞ্চুরি-২ হাফসেঞ্চুরি-৭
পরিসংখ্যানই স্পষ্ট কথা বলছে শচীনের হয়ে। টুর্নামেন্টের ফাইনাল যদি বড় ম্যাচ না হয় তবে কোনটা সেটা?
আমি নিজে দু'জন কিংবদন্তীর মধ্যে তুলনা করতে পছন্দ করি না। বিশেষ করে শচীন ও ব্রায়ান লারার তুলনা আমার খুবই না পছন্দ। আসলে শিল্পের মাঝে কোন তুলনা চলেনা আর তাঁরা দু'জনই ব্যাট হাতে নিপুণ শিল্পী। একজন যদি হয় অনুপম কোন চিত্রকলা তবে আরেকজন সুরের মূর্ছনা। তবু যারা শচীনের নিন্দা করেন তারা প্রায়শই বলেন যে লারা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক এবং ম্যাচ উইনার। কে বেশিবার নিজের দলকে জিতিয়েছেন সে কথা তো আগেই বলেছি এবারে আসুন দেখি কে বেশি আক্রমণাত্মক। ৪৬৩ টি ম্যাচ খেলার পরেও শচীনের স্ট্রাইক রেট ৮৬.২৩ আর ব্রায়ানের ২৯৯ ম্যাচে ৭৯.৫১। টেস্ট-ওয়ানডে দুটাতেই শচীনের গড় লারার চেয়ে ঢের বেশি। তবে দুজনেরই যে অসাধারণ গুনটি ছিল তা অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ছাড়া আর কারো মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়না। শচীনকে তার ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার আম্পায়ারের অনেক জঘন্য সিদ্ধান্তের বলি হতে দেখেছি। ১৯৯৮ সালের শারজাহ কাপে পাকিস্তানী আম্পায়ার জাবেদ আখতার তাকে এলবিডাব্লিউ আউট দিয়েছিল যা আমার দেখা এযাবতকালের সবচেয়ে হাস্যকর একটি সিদ্ধান্ত, লেগ স্ট্যাম্পের আধফুট বাইরে বল লেগেছিল পায়ে তিনটা স্ট্যাম্প পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল এমন একটি সিদ্ধান্তে আউট হয়ে ফিরে যাবার সময় শচীন একটিবার মাথাও ঝাকায়নি, আম্পায়ারের দিকে চোখ তুলে তাকায়ও নি। ঠিক একই ব্যাপার হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতে আম্পায়ার হার্পার যখন গ্লেন ম্যাকগ্রার বল শচীনের কাঁধে বল লাগার পরেও এলবিডাব্লিউ(পড়ুন শোল্ডার বিফোর উইকেট) আউট দিয়েছিল। এদিক দিয়ে ব্রায়ান লারা তো আরেক কাঠি বেশি এগিয়ে। নিজে যদি বুঝতে পারত যে আউট হয়েছে তবে আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করতনা। সোজা প্যাভিলিয়নের দিকে হাটা ধরত।
শচীন টেন্ডুলকার দৃশ্যত একটা জায়গায় পিছিয়ে আছে লারা বা অন্য গ্রেট ব্যাটসম্যানদের চেয়ে; সেটা হল টেস্ট ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি করতে না পারা। লারার সাথে, পন্টিং এর সাথে তুলনায় এখানে তাকে পিছিয়ে পড়তে হয়। এখানে একটা ব্যাপার সবার চোখ এড়িয়ে যায় যে একটানা এতো লম্বা দৈর্ঘ্যের ইনিংস খেলতে হলে যে ধরনের স্ট্যামিনা থাকা প্রয়োজন সেটা উপমহাদেশীয় আবহাওয়ায় থেকে অর্জন করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। সেক্ষেত্রে ক্যারিবিয়ানরা, ইংলিশ- অস্ট্রেলিয়ানরা শারীরিক কাঠামোর দিক থেকেই অনেকটা এগিয়ে থাকে।
অনেক লম্বা হয়ে গেল লেখাটা। এবারে শেষ করব। আজকে আমার শৈশবের ক্রিকেট আইকন ওয়ানডে থেকে বিদায় নিয়েছে। বিশ্বাস করি আরও কিছু দেয়ার ছিল তার ওয়ানডে ক্রিকেটকে। মনে মনে চাইছিলাম ওয়ানডেতে ৫০টি সেঞ্চুরি পূরণ করেই অবসর নেক কিন্তু বোধকরি নিন্দুকের কটুকথার স্রোতের কারনেই তা হয়ে উঠলো না। আশার কথা সে আরও কিছুদিন টেস্ট ক্রিকেট খেলে যাবে। আরও কিছু দুর্লভ মুহূর্ত হয়তো আসবে তার হাত ধরে। এতো এতো অর্জন সাফল্যের শিখর ছোঁয়া এই মানুষটি দিনশেষে কি নিদারুন নিরহঙ্কারী! কত বিনয়ী! কিংবদন্তীরা এমনই হয়। শতায়ু হও শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তোমার খেলা দেখতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি। বেঁচে থাকলে বুড়ো বয়সে নাতি নাতনীদের সাথে বুক ফুলিয়ে গল্প করবঃ “একজন খেলোয়াড় ছিল বটে ছোকরা। তোদের দুর্ভাগ্যরে দাদুভাই তার খেলা দেখতে পারলিনা। শচীনরা যে পৃথিবীতে বারবার আসে না!”