এম এ জলিল অনন্ত বিষয়ে ভার্চুয়াল বাংলাদেশ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ তার ভুলে ভরা ইংরেজি নিয়ে তামাশা করছে আবার কেউ তার স্বদেশপ্রেম এবং স্বদেশী সিনেমার প্রতি দরদ দেখাতে জলিল সাহেবের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
দ্বিতীয় গ্রুপের মানুষরা যারা বাংলা সিনেমার বন্দনা, জলিল বন্দনায় লিপ্ত খোঁজ নিয়ে দেখুন তাদের বেশির ভাগই কোনোদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনা। বড়জোর ফারুকী’র কোষ্ঠকাঠিন্য মার্কা নানিমা(নাটক+সিনেমা) অথবা হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সিনেমাগুলো পর্যন্তই তাদের বঙ্গ সিনেমা প্রীতি। এরাই টিভিতে অপু বিশ্বাসের “শুনলাম না মোবাইল ফোনে আই লাভ ইউ” চলতে দেখলে ‘রাবিশ’ একটা বলে গালি দিয়ে নিজের স্ট্যাটাসটা ধরে রেখে অন্য চ্যানেলে মালাইকা’র “ঝান্ডু বাম” মালিশে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। এইসব গিরিগিটি সদৃশ বহুরূপী দেশপ্রেমীদের মুখে ঝাঁটার বাড়ি পড়ুক, চোখে ঝান্ডু বাম পড়ুক।
আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা সর্বদলীয় পঁচানো কমিটির সদস্য। অন্যকে হেয় করতে পারলেই তাদের যত সুখ। ঠিক আছে মানলাম এম. এ. জলিল অনন্ত খুবই হাস্যকর কিছু ইংরেজি বলেছে, তা শুনে দু’একবার হাসাহাসি হয়েছে বা হবে তাও মেনে নেয়া যায় তাই বলে যে পরিমান লেবু কচলানো শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সেটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। কাউকে দেখেছি জলিল সাহেবকে নিয়ে নানা রকম কোলাজ কার্টুন তৈরি করতে, কেউ ফটোশপ নিয়ে বসেছে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে ছবি তৈরি করতে। এসবের কোন মানে হয় না। তীব্র নিন্দা জানাই। আসলে জাতি হিসেবেই আমরা একটা অদ্ভুত জাতি। অন্যের বিকলাঙ্গতা, অক্ষমতা, দুর্বলতাকে নিয়ে কটাক্ষ করতে আমাদের কোন তুলনা নেই। রাস্তায় কোন উভয়লিঙ্গ মানুষ (প্রচলিত নাম হিজড়া) হেটে গেলে দেখবেন অনেক আপাত ভদ্দন্নোকও দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করে, টিটকারি মারতে আরম্ভ করে। এমনটা পৃথিবীর কোন উন্নত দেশে আপনি পাবেন না।
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কোন দলের? তখন তারা দুষ্টামি করে উত্তর দেয় আমি সবসময় সরকারী দলের। আর আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কোন দলের তবে আমি বলব – ‘আমি সর্বদা বিরোধী দলে’।
এম এ জলিল অনন্ত প্রসঙ্গে আমার অবস্থান পরিষ্কার। এই লোক খুব সামান্য থেকে অনেক দূর এসেছে। যতদূর জানি সে একটি গার্মেন্টসের আয়রন ম্যান ছিল। সেখান থেকে যে লোক দুটি গার্মেন্টসের মালিক হয় সে অবশ্যই কৃতিত্বের দাবী রাখে। কিছু যোগ্যতা তার অবশ্যই আছে। অনেকে বলছেন জলিলের দেশপ্রেমের তুলনা হয় না, সে তো অন্তত চেষ্টা করেছে বাংলা সিনেমাকে কিছু দিতে। অন্য কোন পয়সাওয়ালা তো এগিয়ে আসে নাই বিনিয়োগ করতে, অন্তত জলিল অনন্ত তো এসেছে! তাদের কথা পুরোপুরি মানতে পারছি না। কারন সে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ত্রাণকর্তা হতে এই লাইনে আসে নাই। সে এসেছে পয়সা দিয়ে কিছু খ্যাতি কেনার জন্য। তা না হলে তার প্রতিটি সিনেমার নায়ক নায়িকা সে এবং তার বউ না হয়ে অন্য কেউও হতে পারতো। তার আসল উদ্দেশ্য হল তার চেহারাটাকে সবার সামনে তুলে ধরা, আর কিছু না। ঠিক একই রকম আরেকজন বান্দাকে আমরা পেয়েছিলাম অতীতে নিজের টাকায় সিনেমা বানিয়ে যার নায়ক হবার খুব শখ হয়েছিল। হয়তো অনেকের মনে আছে তার কথা, সম্ভবত হেলাল খান নাম ছিল তার। ঐ যে 'আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে আর মাটি ছুঁয়েছে পাতালকে' – করতে করতে কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল একটা সময়। তার গায়ে কিন্তু দেশপ্রেমিকের তকমা লাগেনি, বেচারার কপাল খারাপ ছিল কারন তার সময়ে দেশে তবু দুএকজন ভাল মানের চিত্রাভিনেতা ছিল কিন্তু এম. এ. জলিল অনন্ত খুব দ্রুত নজর কেড়েছেন কারন আমাদের হাতে অপশনের খুব অভাব। অনেক দিন ধরেই এক শাকিব খানের ঘাড়ে চড়ে আছে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, তাই রুচির একটু পরিবর্তন পেয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তবে সম্প্রতি একটা খবর শুনলাম সে (জলিল অনন্ত) নাকি দেশের সব বড় জেলাগুলোতে একটা করে মান সম্মত সিনেপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তাই যদি হয় তবে তাকে একরাশ ধন্যবাদ দিতেই হবে। বাংলা সিনেমা অবশ্যই তার কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবে সেজন্যে। কিন্তু যদি বলা হয় ‘খোঁজঃ দ্যা সার্চ’ ‘গতিঃ দ্যা স্পীড’ এবং ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ নামের তিনটি সিনেমা বানিয়ে সে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কাণ্ডারি বাবা হয়ে গেছে তবে অবশ্যই তা মানব না। এখানে দেশপ্রেমের কিছু নেই, শিল্প প্রেমেরও কিছু নেই। যদি থাকতো তবে তার সিনেমাগুলোর নাম ইংরেজিতে না হয়ে মাতৃভাষা বাংলাতেই হত, টক শো তে কথা বলতে গিয়ে বাংলা ভাষাকেই প্রাধান্য দিত, অদ্ভুতুড়ে ইংরেজি বলে হাসির খোঁড়াক হত না।
তবু এম. এ. জলিল অনন্ত একটা পরিবর্তন তো বটেই। তার ভুলে ভরা ইংরেজি, অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ অথবা হাস্যকর সিনেমা - যে কারনেই হোক বেশ কিছু মানুষের সমর্থন সে ইতোমধ্যে সে লাভ করেছে। তার প্রতি এক ধরনের মমতা আমি নিজেও বোধ করিনা বললে ভুল বলা হবে। এখন তাকে এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। নতুন কিছু ভাল আর্টিস্টকে উঠে আসতে সাহায্য করতে হবে, তার নিজের অভিনয়ের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে দিয়ে ডাবিং করিয়ে নিতে হবে যতদিন পর্যন্ত তার নিজের উচ্চারণ ঠিকঠাক না হচ্ছে। আরও অনেক দিক আছে উন্নতি করার যেগুলো তারা সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন যারা সিনেমার নিয়ে কাজ করছেন।
অনেক অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষও অনেক ছোট অবস্থান থেকে সুবিশাল হয়ে একটা সময় দুনিয়াকে চমক দেখিয়েছে, নিজেদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও অধ্যবসায় দিয়ে দুর্বলতা যত আছে সব কাটিয়ে উঠেছে। আশা করি এম এ জলিল অনন্ত হারিয়ে যাবে না, চেষ্টা করে যাবে...