(মরনোত্তর চর্চায় আজ তোকে নিয়ে অনেকেই লেখে...)
কাফি কামাল
আমার বন্ধু আপন। অভিমানী, নিভৃতচারী এবং নির্বিরোধ একজন। অকাল প্রয়াত আপন মাহমুদ বাংলা কবিতায় শূন্য দশকের এক সম্ভাবনাময় স্বর। ১লা জানুয়ারি ১৯৭৬ থেকে ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১২। মাত্র তিনযুগের আয়ুষ্কালে বৈচিত্র্যময় এক জীবনের অধিকারী। বড্ড অসময়ে আপন মাহমুদ চলে গেল না ফেরার দেশে।
সময়কাল ২০০০। আগ্রাবাদের একটি আড্ডায় আমাদের পরিচয়। সে থাকতো সল্টগোলা, আমি পাঠানটুলী। আপন তখন টো টো ঘুরে বেড়ানো বেকার আর আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক শিক্ষার্থী। কবিতায় ডুব সাঁতার কাটছি, প্রথম গল্পের বইটিও প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আড্ডাতেই আমাদের পরিচয় পরিণত হলে বন্ধুত্বে। পরদিন থেকেই গড়ে উঠল তুই-তুকারীর সম্পর্ক। নামের মধ্যেই তার এক অদ্ভুত মাদকতা। দুইসপ্তাহের মাথায় বাসা পরিবর্তন করে সল্টগোলা বেগম জান স্কুল পুকুর পাড়ে মহসিন কলোনীর তার বাসায় গিয়ে উঠলাম। সল্টগোলায় তখন তার বিশাল এক বন্ধুচক্র। মনিরুজ্জামান, কালাম, রিয়াজ, নাজিম, হামিদ, তুষার, টিপু সুলতান, জাহাঙ্গীর, হাশেম, ম্যাক্সিমসহ অনেকেই। প্রত্যেকেই সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ। দু’একজন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের বন্ধুত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। বন্ধুত্বের মাপকাঠিতে কেউ কারও চেয়ে হাল্কা নয়। সল্টগোলার বন্ধুরা ছিল তার ভাইয়ের মতো। তাদের পরিবারে ছিল আপনের অবাধ যাতায়াত। বন্ধুরা দিনে তারা চাকরি করে, আমরা টিউশনী। রাতে আড্ডা জমে উঠে আপনের বাসা কিংবা সল্টগোলার নানা পয়েন্টে। ভোররাত পর্যন্ত তাসের ঘোরে কাটে। আপন সবসময় বলতÑ ‘আমি আপেলের মতো মিষ্টিও নই, কমলালেবুর মতো সুন্দরও নই; আমি হলাম লক্ষীপুরের অলক্ষী সন্তান।’
আপনের মুখে সারাক্ষণই লেগে থাকতো সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান। খৈ-এর মতো ফুটতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও হেলাল হাফিজের কবিতা। আবৃত্তি-উপস্থাপনার জন্য বন্ধুচক্রে ছিল তার আলাদা কদর। আমি জোটার পর আবৃত্তির পাশাপাশি আপনের জীবনে জড়িয়ে পড়ল কবিতা। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে নেভিহল রোডের পাশের গাছগুলো এখন ডালপালায় বিস্তৃত হয়েছে নিশ্চয়। ছোট ছোট সেসব গাছের ছায়ায় বসে, বন্দরটিলার পশ্চিমে তরমুজ খেতের ধারে, গোল্ডেন বীচের বেড়িবাঁধে বসে আমরা পড়তাম শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী ও রফিক আজাদের কবিতা। আপন আবৃত্তি করত আর আমি আলোচনা। কবিতার রূপ, রস, ছন্দ, অন্তমিল... হাবিজাবি তাকে বোঝাতাম। আপন অঙ্কে খুব ভাল ছিল। কিন্তু কবিতার অঙ্ক আর ব্যাকরণে ছিল তার বড্ড অস্বস্তি। প্রকৃতির সান্নিধ্যে আপন হয়ে উঠত অবোধ শিশু। পতেঙ্গা বীচে লাল কাঁকড়ার ধরতে গিয়ে হারিয়ে ফেলত সময়জ্ঞান। বলত, এসব আমার আত্মীয়-স্বজন। সল্টগোলা ব্রীজে বসে কর্ণফুলীর জলে ভেসে যেত। বলত, আমি হচ্ছি ঢেউয়ের তালে তালে দোদুল্যমান সাম্পান। এক একটি আড্ডায় পুড়ে যেত পুরো প্যাকেট সিগারেট।
একদিন রাতে আবিস্কার করলাম আপন কবিতা লেখা শুরু করেছে। তার দিনপঞ্জির পাতায় পাতায় ছোট ছোট কবিতা। আবৃত্তির ঢংয়ে লেখা পঙক্তি। এমন গোপন সংবাদে উৎফুল্ল আমাদের বন্ধুরা। দু’একজন টিপ্পিনী কাটতেও ছাড়ল না। যাহোক, এমন দুষ্কর্মের খেসারত হিসেবে পরদিন জল আর হাওয়া পার্টির আয়োজন। আপনের পকেট থেকে উড়ে গেল বেশকিছু নগদ নোট। আমি হলাম তার কবিতার প্রথম পাঠক, আলোচক-সমালোচক। সে আমার তাসের গুরু। আপন তখনও তার প্রত্যাহিত অনুভূতিগুলোই শব্দে ধরতে চায়। একটি পঙক্তি লিখেই চিৎকার দিতÑ দেখ আমার থেকে ‘কবিতা’ বেরুচ্ছে। আমি ‘কবি’ হয়ে উঠছি। দিনদুপুরে, রাতবিরাতে সিগারেটে টান দিয়েই শুরু হত পোস্টমর্টেম। আমি কাটাকুটি করছি আর আপন চোখ মেলে মন খুলে মেনে নিচ্ছে। তখন কবিতা নিয়ে আমাদের স্বপ্ন উড়ে বেড়াতো হিমালয়ের শীর্ষদেশে। কবিতার টানে আপনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি চট্টগ্রাম শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে নানা কবিতা আড্ডায়। এক একদিন হাফিজ রশিদ খান, রিজোয়ান মাহমুদ, হারুন আল নাসিফ, এরশাদ হাফিজের বাসা, চেরাগি মোড়, সবুজ হোটেল সহ কত্ত জায়গায়! কিছুদিনের মধ্যে সল্টগোলায় শূন্যদশকের আরেক কবি সবুজ তাপসের সঙ্গে পরিচয় আমাদের আড্ডাকে নতুন মাত্রা দেয়। সবুজ তাপস সম্পাদিত ‘ঢেউ’-এ তার প্রথম কবিতাও ছাপা হল। এভাবেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ল আপনের শিরা-উপশিরায়। একদিন দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম একটি লিটলম্যাগ বের করব। নামও ঠিক হয়েছিল ‘সাম্পান’। সল্টগোলা আরেক কবি ইশতিয়াক জাহাঙ্গীরকে দিলাম প্রকাশনার দায়িত্ব। কিন্তু তিনি আপনের টিউশনীর পাঁচ হাজার টাকা হাপিস করে উধাও হয়ে গেলেন। ভেঙে গেলে আমাদের একটি স্বপ্ন।
একদিন আমার খুব মনখারাপ। আপনের নেতৃত্বে চারজন ছুটলাম পতেঙ্গা বীচে। জোৎস্নালোকে সাঁতার কাটলাম নীলজলে। আমি ও আপন। জলের মধ্যে মিশিয়ে নিচ্ছি তামাক পোড়া ছাই। আমার মাথা ঘুরছে, প্রলাপ বকছি। চারদিকের ভীষণ কড়াকড়ি এড়িয়ে আপন আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরল। গভীর রাতে আমি উগলে দিলাম দুর্গন্ধযুক্ত বেদনা। কান্ত চোখে দেখছি আপন দু’হাতে আমার বেদনা পরিস্কার করছে। আপনের সঙ্গে বাসায় থাকতেন জাহাজের কয়েকজন কারিগরী শ্রমিক। সবাই ব্যস্ত, লেবু আনো, পানি আনো...। কেউ একজন লেবু সংগ্রহ করে এনেছে। আমি ভাবছি, লেবুর রস পেটে পড়লেই বেরিয়ে আসবে কলজে ছেঁড়া খুন। কিন্তু আপনের হাতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস আমাকে দিয়েছিল পরম স্বস্তি। আমার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ঋতুরঙ্গ’র খসড়া তৈরি করেছিলাম তখন। সীম্যান্স হোস্টেল, সল্টগোলা ব্রীজ, পতেঙ্গা বীচে বসে লেখা এ কাব্যের প্রথম পাঠক, আলোচক এবং প্রেরণাদাতা আমার বন্ধু আপন।
আপনের ছোট্ট জীবনে রয়েছে তিনটি প্রধান শহর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ভূমিকা। লক্ষ্মীপুরের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিল আমার বন্ধু আপন। পিতা একজন নির্মাণ শ্রমিক। লক্ষ্মীপুর থেকে এসএসসি পাসের পর আপন পড়তে গিয়েছিল সিলেটে। থাকতেন মামার বাসায়। সিলেটেই আপনের বোহেমিয়ান জীবনের সূচনা। ভাল ছাত্র এবং পরিবারিক স্বচ্ছলতার আশা-আকাঙ্খার প্রতিক আপন ফেল করে বসে এইচএসসি পরীক্ষায়। এ ফল তার জীবনকে এক চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। বাবা খেদানো, মামা তাড়ানো আপন ছুটে এসেছিল স্বজনবিহীন চট্টগ্রামে। মেধাবী আপন চট্টগ্রামে নিজের চেষ্টায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনসহ একটি বিশাল বন্ধুচক্র গড়ে তুলেছিল। আমিও ছিলাম সে চক্রেরই একজন। আপন ছিল বাড়ির বড় ছেলে। অসুস্থ বাবা-মা, গতিহীন ছোট ভাই ও দরিদ্র সংসার নিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত উৎকণ্ঠায় ভুগত সে। একটি ভাল চাকরির জন্য তার আকাঙ্খা ছিল। কিন্তু বোহেমিয়ান জীবনাচারণের কারণে চাকরি অনুসন্ধানে সিরিয়াস হতে পারেনি। মাঝে-মধ্যে টিউশনীর আয় থেকে কিছু টাকা বাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করত। প্রায় বলত, বন্ধু আমার দূর্ভাগা জন্মদাতার জন্য খুবই কষ্ট লাগে। লোকটিকে বুড়ো বয়সেও একটু স্বস্তি দিতে পারছি না। পারিবারিক জীবনে আমরা ছিলাম কাছাকাছি অবস্থানের। আপনকে পারিবারিক দারিদ্র এবং আমাকে পারিবারিক ঘটনা-দূর্ঘটনা সে সময় ব্যথিত করত মুহুমুর্হু। অনেকদিন আমরা লুকিয়ে অশ্রু ঝরিয়েছি পতেঙ্গা বীচে। পারিবারিক দারিদ্র আপনকে কখনও হীনমন্য করেনি। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলত টিউশনীর আয়ে। দিনের অর্ধেক সময় তার পেরিয়ে যেত মানুষের বাচ্চা পড়িয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে সব আয়োজনেই তার ছিল সরব উপস্থিতি, সক্রিয় ভূমিকা। সঞ্চয় শব্দটির সঙ্গে আজীবন পরিচিত হতে পারেনি আমার বন্ধু। তার ধাতে সইত না কঞ্জুসপনা, কিপ্টামি। অন্যের বিপদে-আপদে আপনের সহযোগীতার হাত ছিল প্রশস্ত। নিয়মিত আর্থিক ক্ষতির শিকার ছিল তার নিয়তি। একবার আপন, এরশাদসহ পাঁচজন মিলে সিটি ব্যাংকের রিয়াজউদ্দিন বাজার তিনপুল শাখায় একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলেছিলাম। কিন্তু সঞ্চয়বিমুখ আমরা দ্রুতই ভুলে গিয়েছিলাম সে কথা। অনেক আগেই হয়তো বিলুপ্ত হয়েছে সে হিসাব। আপন যে কেমন ছিল তার সে গল্প শেষ হবে না। একদিন পাবলিক লাইব্রেরী এলাকায় আড্ডা দিয়ে ফিরছি। আপনের কণ্ঠে পথশিশুদের জন্য উপচে পড়ছে দরদ। কে একজন বলল, পথশিশু সাজতে পারবি? শিবলুর হাতে ক্যামেরা। পাশে অপর্ণাচরণ স্কুলের পেছনে স্তুপ করে পড়ে আছে আখের তাজা ছোবড়া। মুহুর্তের মধ্যেই শহরের ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাতে শরীরের ভদ্রজনোচিত পোশাক খুলে হাফপ্যান্টে বসে পড়ল আপন। মেশিন নিষ্পেষিত সে ছোবড়া তুলে নিল হাতে-মুখে। ছবি উঠল ফটাফট। হয়তো শিবলুর অ্যালবামে সে ছবি এখনও অমলিন।
হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসা করব। আমার সিদ্ধান্ত জানাতেই আপন মৃদু হাসল। তার সে হাসিতে কি ছিল পরে কখনও জানা হয়নি। আমি বাসা পরিবর্তন করে সল্টগোলা থেকে বাকলিয়া চলে গেলাম। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। সপ্তাহে অন্তত দুইবার আমাদের দেখা-সাক্ষাত হত। কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যবসা লাটে উঠল। খালি হাতে, ভাঙা মনে আমি ঘুরে বেড়াই চট্টগ্রাম শহরে। কিছুদিন একটি কঠিন রোগ থেকে আমি সদ্য আরোগ্য। চোখে ড্রপ দিয়ে ছুটছি পরীক্ষার হলে। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় খবর এলÑ আমার অশীতিপর বৃদ্ধ দাদা সড়ক দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত। হাঁটুর নিচে একটি পা দ্বিখণ্ডিত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এমন বিপদের মূহূর্তে আপনকে ফোন করতেই সে ছুটে এল হাসপাতালে। বলল, দাদার জন্য আমিই রক্ত দেব। কিন্তু ততক্ষণে রক্ত যোগাড় হয়েছে। আপনের ভীষণ মন খারাপ। তখনই ইর্মাজেন্সীতে এলো একটি দরিদ্র পরিবারের শিশু সন্তান। সড়ক দূর্ঘটনায় আট-নয় বছরের ছেলেটির একটি হাত ও একটি পা কেটে গেছে। জরুরি রক্তের দরকার। আপন সে ছেলেটিকে কেবল রক্তই দিল না, সঙ্গে প্রাথমিক খরচাপাতির আটশ’ টাকাও। তারপর একটি মাস প্রায় প্রতিদিন আপন ছুটে আসত হাসপাতালে। আমার দাদার বুকের পাশে বসে থাকত। আমরা দু’জন ঘুরে ঘুরে ওই ওয়ার্ডের রোগীদের ছোট খাট সহযোগীতা করতাম। ওষুধপত্র, এটা-সেটা এনে দিতাম। আমার প্রেরণা ছিল আপন। আজ আমার দাদা নেই, আপনও নেই, হয়তো আপনের রক্ত দিয়ে পঙ্গু সে ছেলেটি বেঁচে আছে।
আপন ও আমি তখন রীতিমতো বাউন্ডেলে। সেজ চাচার বিয়ে উপলক্ষে গভীর রাতে বাড়ি গেলাম দু’জন। আমার বাবা-মা’র সঙ্গে আগেই পরিচয়পর্ব সেরেছে আপন। পরদিন বরযাত্রী হয়ে গেলাম পাশের থানায় সেজচাচার শ্বশুর বাড়ি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলেও আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছে দেখে আমরা হাঁটছি গ্রামের মেঠোপথে। ঘন অন্ধকার রাত। মনের ঘোরে কখন যে দূরের এক বিরাণ-নির্জণ বিলের পারে ছোট্ট একটি ব্রীজের উপর চলে এসেছি। একটির পর একটি সিগারেট পুড়ছে আর আমাদের গল্পের ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ আমাদের পাশকাটিয়ে গেল কয়েকটি তরুণী। একজন ‘জনৈক স্যার’-এর নাম ধরে সালাম দিল। আমাদের পরিচয় দিতেই ‘স্যরি’ বলে তারা চলে গেল। কয়েক মুহুর্ত পর হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো আপনের মুখে, আমাদের অবাক করে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো সে মেয়েটি। নির্জন বিলের মধ্যখানে অন্ধকার রাতে দুইটি তরুণের সামনে একটি তরুণী। কি চায় মেয়েটি? ভয়ে কাঁপছে আপন, হতবাক আমার মুখ দিয়েও শব্দ বেরুচ্ছে না। মেয়েটির নানা প্রশ্ন আমাদের সতর্ক উত্তর হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা যতই এড়াতে চাই, মেয়েটি ততই জড়িয়ে পড়ে। শুদ্ধ উচ্চারণ ও সুন্দর শব্দ চয়নের জন্য আপনকেই তার বড্ড মনে ধরেছে। পকেটে কলম নেই, অবশেষে ব্রীজের রেলিংয়ে মাটির ঢেলায় মুঠোফোন নম্বর লিখেই দু’জনের রেহাই। আরও একটি বিয়ে উপলক্ষে আমার বাড়িতে গিয়েছিল আপন।
সময়টা ২০০৩ সালের শেষপ্রান্ত। কিছুদিন গ্রামে অবস্থান শেষে একটি পারিবারিক দূর্যোগে খাবি খাচ্ছি আমি। কয়েকবার আত্মহত্যার পরিকল্পনাও করেছি। একরাতে আপনের বাসায় ঢু মারলাম। পরদিন আপনের একটি চিঠি নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা। কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। না বন্ধু না পরিবার। বগুড়ায় মাস কাটিয়ে ফের চট্টগ্রামে, সঙ্গোপনে। লুকিয়ে চাকরি করি। আপনকে বলি চট্টগ্রাম ফিরেছি কিন্তু ঠিকানা বলি না। ফোনে কথা হয়। একদিন খবর পেলাম, আপন হাসপাতালে। ঘটনা কি? শুনলাম তার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। রাস্তা থেকেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেমেছিল তার বন্ধু থেকে বন্ধুদের আত্মীয়-স্বজনদেরও ঢল। ফুলে ফলে ভরা থাকতো তার বেড। জাহাঙ্গীর ছিল হাসপাতালে তার সার্বক্ষনিক সঙ্গী। বন্ধুরা বুঝতে দেয়নি চট্টগ্রামে আপন ছিল অভিভাবকহীন। যাহোক, দেখলাম আপনের মধ্যে ভয় ঢুকেছে। দু’জনের পরিস্থিতি এমন কেউ কাউকে সান্তনা জানাতে পারি না। স্বপ্নগুলো মিইয়ে আসে। কিছুদিন পর আমি চলে যাই কক্সবাজার। একদিন ফোনে জানলামÑ সেও অভিমানে চট্টগ্রাম ছেড়েছে। ধূপপোলের বাসা থেকে সোজা শাহবাগের পিজি বস্তি। একটি বছর শেষে ভাগ্যান্বেষনে আমিও রাজধানীর পিচঢালা পথে। উঠলাম তার পিজি বস্তির খুপড়িতে। আপন তখন বিলুপ্ত আজকের কাগজ এবং পাক্ষিক অন্যদিন-এ খাটছে উদয়াস্ত, আমি ঘুরছি থিতু হওয়ার সন্ধানে। তিনযুগের আয়ুষ্কালে অল্পকিছু কবিতা লিখেছে আপন মাহমুদ। তার কবিতার জগত স্বপ্নালু, রোমান্টিকতায় ভরপুর। নিজের জীবনের মতোই সহজ-সরল শব্দে, অনুসঙ্গে, কল্পনায় কিছু অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করেছে সে। নাগরিক শঠতা কিংবা কষ্টকল্পনা স্থান করতে পারেনি তার কবিতায়। বিশ্বাস করি কবিতায় পাঠকের মনে বেঁচে থাকবে আমার বন্ধু আপন।
কেন চট্টগ্রাম ছেড়েছিল আপন মাহমুদ? নেপথ্যে ছিল বন্ধুচক্রের সঙ্গে একটি কঠিন অভিমান। সে অভিমানের পোস্টমর্টেম করব না। তবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সল্টগোলার সে বন্ধুসার্কেল থেকে দূরে ছিল আপন মাহমুদ। পুরোপুরি ভুলে যেতে চেয়েছিল চট্টগ্রামকে। একমাত্র ব্যতিক্রম আমি। এ ঢাকা শহর আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে বসিয়েছিল নীরব দুরত্বের ছুরি। আপন ভুলে ছিল চট্টগ্রামের সে বন্ধুদের কিন্তু তারা ভুলেনি। দূর থেকে তার খোঁজ রেখেছে, ভালবেসেছে। আপনের সঙ্গে এ ঢাকা শহরে অবস্থান করেও আমি তার মৃত্যু সংবাদটি পেয়েছি চট্টগ্রামের মনিরের কাছে। যখন স্মৃতির এ জাবর কাটছি তখনও ফোন করছে চট্টগ্রাম থেকে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কালাম, হাসেম, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এরশাদ। বড্ড অসময়ে আপন তুই চলে গেলি। কিন্তু তোর স্মৃতি অনন্তকাল জেগে থাকবে আমাদের মনে।