somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাগল রাগ করে চলে গেছে, ফিরেও আসনি ... ট্রিবিউট টু সঞ্জীব দা

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না । অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ, অতি সাধারণ একজন মানুষ, যিনি খুব সহজে আপন করে নিতেন সবাইকে, যার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু পাবো বলে আশা রাখেছিলাম আজ সেই মানুষটার চলে যাবার দিন । দেখতে দেখতে ৬ টা বছর কেটে গেল......



" ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে
পার্টস গুলো ক্ষয় হয়েছে
ডায়নামা বিকল হয়েছে
হেডলাইট দুইটা জ্বলে না......... "




২০০৭ সালের আজকেই এই দিনে আমাদের ছেঁড়ে চলে গেলেন দাদা । ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মিরপুরের একটি হাসপাতালে। তারপর সেইদিনই অ্যাপলতে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে । মস্তিকের প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে টানা ৩ দিন মৃত্যুর সাথে লড়েছেন। কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ১৯ তারিখ চলে গেলেন না ফেরার দেশে । রাত ১২:১০ মিনিটে প্রাণোচ্ছল এই মানুষের কৃত্রিম ভাবে বেঁচে থাকার উপায় লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে দিয়ে ডাক্তাররা তাকে শারীরিকভাবে মৃত ঘোষণা করলেন তিনি আমাদের মাঝে রয়ে গেছেন পাকা পুক্ত ভাবে । আজো সেই ৪৩ বছরের সঞ্জীবদা'কে আমরা দেখতে পাই । জীবন ঘড়ি যেন ৪৩ বছরেই থেমে গেছে। দাদা আর বড় হবেন না কিন্তু থাকবেন আমাদের সাথে ।





" আমি তোমাকেই বলে দেবো,
সেই ভুলে ভরা গল্প;
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়...... "



ভুল দরজায় আজীবন কড়া নেড়েও কত মানুষের মনের দরজা দিয়ে ঢুকে গেছেন সেটা তিনি জানতেন কিনা জানি না । কিন্তু জীবনের হিসেব যে একদমই করতেন না সেটা বুঝা গেল যখন বাপ্পা মজুমদার সঞ্জীবদার চিকিৎসার জন্য সবার কাছে হাত পেতেছিলেন । বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল টেলিভিশনে আর পত্রিকায়।





" হাতে উপর হাতের পরশ রবে না ... "



বড্ড খামখেয়ালিতেই পার করলেন জীবন । বলা যায় নিজেকে পুড়িয়ে অন্যকে আনন্দ দিতেই নিতে ব্যস্ত । প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ এতো দ্রুত চলে যাবেন ভাবতে পারিনি । না বলা অনেক কথাই হয়তো পুষে রেখেছিলেন মনের মধ্যে আর ঠোঁটে রেখেছেন হাসি ।



" তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও,
করি প্রেমের তর্জমা ... "




১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে একটা শিশুর জন্ম হয়েছিল । তখনও পরিবারের কেউ জানতেন না তিনি হয়ে উঠবেন একজন কিংবদন্তী । প্রথাবিরোধী এই মানুষ কাজ করেছিলেন মানুষের জন্য । এমনকি মৃত্যু পরেও তার দেহটা দান করে গেছেন মানুষের জন্য । " ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, যায় যায় দিনে " কাজ করেছেন সাংবাদিকতার । লেখেছেন অনেক কবিতা, গান । লিখতে শিখিয়েছেন অনেককে। স্বপ্ন গুলো সংক্রামিত করতে শিখিয়েছেন এবং করেছিলেনও। গানে গানে প্রতিবাদ করেছেন, গানে গানেই ভালোবেসেছেন ।



" আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সন্ধান করিয়া,
স্বপ্নের ঐ পাখি ধরতে চাই;
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই,
আমার অন্তরের কথা বলতে চাই ... "




গানে গানে প্রতিবাদ করেছেন, গানে গানেই ভালোবেসেছেন। । স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাজ করে গেছে একনিষ্ঠ ভাবে । ভালোবেসেছেন মানুষকে কিন্তু পুড়িয়েছেন নিজেকে।



" রেডিও খবর দিছে, দেশে কোন অভাব নাই;
লাইলার ঘরে, কাইলাই ঘরে আনন্দের আর সীমা নাই ।
রইসসার মা কয় ঘইসসার মারে, আমরা কিছু বুঝি না,
চেয়ারম্যান সাবে বগল বাজান, আমরা কিন্তু দেখছি না ...... "




৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাপ্পা মজুমদারের সাথে গড়ে তুলেন " দলছুট "। " আহা " এ্যালবামের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ হয় দলছুটের । অসম্ভব সুন্দর গান নিয়ে হাজির হন শ্রোতাদের সামনে । অনেকটা গানে গানে বলে গেছেন অন্তরের কথা...



"সব নিষিদ্ধ, কষ্ট নিষিদ্ধ, কষ্ট নাই; দুঃখ নিষিদ্ধ, দুঃখ নাই;
আমাদের কষ্ট থাকতে নাই, দুঃখ পাওয়ার আদেশ নাই ..."




উনার সাথে আমার পারিবারিক কোন সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক ছিল আত্মার । সঞ্জীবদা'কে এখনো অনুভব করি আত্মায়। মন খারাপ হলেই সঞ্জীব দা এখনো আমার ভরসা, বন্ধুদের আড্ডায় এখনো সঞ্জীবদা আমাদের মাঝে সরব, হঠাৎ করেন গেয়ে উঠতে হয়।



" কার ছবি নেই, কেউ কি ছিল;
এই ভেবে ডুবে গেছে রাত... ”




সঞ্জীবদা ছিলেন আত্মপরিচয় বিমুখ একজন মানুষ। এড়িয়ে চলতেন ফ্রেম, পরিচিতি। কিন্তু মেলে ধরতেন আড্ডায়, গানে। উজার করে গেয়েছিলেন না। প্রাণের গান। নিজেকে পুড়াতে বড্ড ভালোবাসতেন তিনি। উনার চলে যাবার পর মনে হয়েছিল বড্ড অভিমান করেই উনি চলে গেছেন হয়তো...



“কথা বলবো না আগের মতো কিছু নেই
পিছু ডাকবো না পিছু ডাকার কিছু নেই
সর্বনাশী ঝড় বুকে, উড়ে যাবার কিছু নেই
আগুনে পুড়েছি এ হাত বাড়িয়ে,
পুড়ে যাবার কিছু বাকি নেই...”




এখন আমার প্রায় প্রতি রাতেই সঞ্জীবদা সাথী হয়ে যান। কানে কানে কথা হয় এখন। চোখের সামনে নিজের অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে। পরোক্ষণেই অনেক কিছু বলে যান উনি।


" ঐ কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না,
থমকে থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না
তুড়ির তালে নাচতে থাকা ভালো লাগে না,
এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভালো লাগেনা ...."




সঞ্জীব চৌধুরী থেকে ক্রমেই হয়ে গেলেন " সঞ্জীব দা "। মানুষের মনে জায়গা করে নিলেন দাদার । ঠিক এখন পর্যন্ত মানুষটা অনেকেরই সুখ দুঃখের সাথী। তপ্ত দুপুর কিংবা শীতল রাতে অথবা ভালোবাসার মানুষের হাতে হাত ধরে থাকা মুহূর্তে সঞ্জীবদা উপস্থিত ।


" চোখটা এতো পুড়ায় কেন,ও পুড়া চোখ সমুদ্রে যাও;
সমুদ্র কি তোমার ছেলে, আদর দিয়ে চোখে মাখাও ... "




একটা সময় অভিনয় করেছিলেন কয়েকটা নাটকেও। কবিতা, গান, নাটক, আড্ডা, আন্দোলন সব কিছুর সাথেই সঞ্জীবদা মিশে আছেন। প্রচণ্ড সাধারণ বলেই হতো সাধারণ মানুষদের মনের মাঝে বেঁচে আছেন তিনি এখনো। তার কাজ আজো রয়ে গেছে জীবন্ত। কিংবদন্তী হয়ে আছেন, থাকবেন ...


" রিক্সা যাচ্ছে হাওয়ায় উড়ে,আমার হৃদয় তুচ্ছ করে;
হায় পরমা, হায় পরমা মুখ ঘুরিয়ে একটা কিছু বলে না,
রিক্সা কেন আসতে চলে না ... "





জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন " প্রজ্ঞা নাসরিন'কে "। " কিংবদন্তী " নামের একমাত্র মেয়েটা আজ ১০ বছরের হয়ে গেল । আর পাগল সঞ্জীব চৌধুরী দলছুট হয়ে গেলেন ...


" পাগল রাগ করে চলে যাবে, ফিরেও আসবে না,
পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে, খুঁজেও পাবে না…”




গান গেয়ে সেই গানে নেশা দিয়ে গিয়েছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী । একেকটা গান একেকটা নেশা আজ।


" তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, দেখেছিলাম বায়স্কোপ,
বায়স্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না ... "




কিছু মানুষ আছেন যাদের জন্য কিছু লিখতে গেলে কিংবা তাদের স্মৃতি রোমন্থন করলে সেই সময়টা শেষ হতে চায় না। বার বার বলতে ইচ্ছা করে, আরো কিছু লিখতে ইচ্ছা করে। যেন অনেক কিছুই বলার বাকি, অনেক কিছুই লিখার বাকি রয়ে গেছে। সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন ঠিক সেই রকম একজন মানুষ। হেসে হেসে কথা বলতেন, নিজের কষ্টটা কাউকে বুঝতে দিতেন না। খুবই সাধারণ মানুষ। আর এক কথায় অসাধান। তিনি এখনো আমাদের মাঝে আছেন । আমাদের অন্তরে আছেন ।


" দুঃখ ব্যথায় মুখটায়ে নীল, তোমার আমার না হলো মিল,
নীল দুঃখের সেই মেয়েটা পরের পরিমিতা,
বুকের ভেতর জ্বলে শুধু ভালোবাসার চিতা......"




২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সঞ্জীবদার শারীরিক প্রাস্থান হয়েছে। দেহটা দান করে গিয়েছিলেন " ঢাকা মেডিকেল কলেজে "। এখনো কঙ্কালটা রয়ে গেছে ঢাকা মেডিকেলে আর সঞ্জীবদার ছড়িয়ে পড়েছেন স্বপ্নের মতো কোটি প্রাণের মাঝে ।





দাদা, তুমি আমাদের হৃদয়ে আছো, ছিলে , থাকবে। আজীবন । ভালো থেকো ...

ক্ষুদে গানরাজ ২০০৮। ট্রিবিউট টু সঞ্জীব চৌধুরী ।


অনেকদিন আগে সঞ্জীবদা'র " আমি তোমাকেই বলে দেব " গানটা ৪ লাইন চেষ্টা করছিলাম গাওয়ার ।





সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫০
২৫টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম বিহীন বিশ্ব গড়ার চেষ্টা বিশ্ব জনসংখ্যা অনেক কমিয়ে দিবে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৫০



নেতানিয়াহু বলেছে তাদের সাথে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে। সে মুসলিম বিশ্বকে বড় রকমের হুমকি দিয়েছে। সে গণহত্যা চালাচ্ছে। আত্মরক্ষায় মরিয়া মুসলিমরাও গণহত্যা চালাবে। তখন আর সভ্যতার বাণীতে কাজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মিরর ডোল, নিজের মনের অশান্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩৫

ব্লগার মিরর দৌলাকে বলছি।
আপনাকে কিছু কড়া কথা আজ বলবো। ব্লগে বর্তমানে আপনার কোন অবদান নেই। সামুর যে ব্লগপেইজটা আপনি চালান, সেখান থেকে সব পোষ্ট আপনি ড্রাফটে নিয়েছেন। সেটা আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এনসিপিনামা - যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১


জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল আত্নপ্রকাশ করেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) কে নিয়ে। জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিয়ে এই দল গঠিত হয়েছে। প্রচলিত রাজনৈতিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

হারিয়েছি অনেক কিছু....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৫৪

হারিয়েছি অনেক কিছু....

আমি প্রতিদিন নিয়ম করে বেশ কয়েক কিলোমিটার হাটি। তবে ইদানিং হাটাহাটিতে অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন হচ্ছে! এই যেমন, হাটাহাটির টার্গেট মিসিং! যে পথে হাটার কথা, সে পথে না গিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ২০০০ বছরের পুরনো মরদেহের ডিএনএ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:১৫



২০০০ বছরের পুরনো মরদেহের ডিএনএ থেকে জানা গেলো যত চমকপ্রদ তথ্য।


পল্লব ঘোষ
Role, বিজ্ঞানবিষয়ক সংবাদদাতা
Reporting from লন্ডন
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×