
মজার ব্যাপার হলো এই একই দিনের প্রথম আলোর ৫ম পৃষ্ঠায় গ্রামীণ ফোনের আরেকটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয় যার বিষয় বস্তু ছিল ”১০০ টাকার বোনাস টক টাইম”; এই বিজ্ঞাপনটির এক কোণায় বরাবরের মতোই গ্রামীণ ফোনের কর্পোরেট শ্লোগান ”কাছে থাকুন। গ্রামীণ ফোন” কথাটি লেখা থাকলেও আমাদের আলোচ্য ”দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট” শীর্ষক বিজ্ঞাপনটির কোথাও কিন্তু ”কাছে থাকুন। গ্রামীণ ফোন” কথাটি লেখা ছিল না।[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/dinmojurblog_1266695941_2-20022010474.jpg
বিষয়টা কি? গ্রামীণ ফোন কি তার কর্পোরেট শ্লোগান দিতে ভুলে গিয়েছিল নাকি এটা ছাপার ভুল? এর উত্তর মেলে তার দুইদিন পর ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রথম আলোতে ছাপা গ্রামীণ ফোনের দু্টি বিজ্ঞাপন দেখে। এখানেও একই ব্যাপার- পৃষ্ঠা ২৩ এ ছাপা প্রিপেইড কার্ডের বিজ্ঞাপণটির এক কোনায় ”কাছে থাকুন। গ্রামীণ ফোন” কথাটি লেখা থাকলেও ৩য় পৃষ্ঠার প্রায় অর্ধেক জুড়ে ছাপা ”দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট” শীর্ষক বিজ্ঞাপনটিতে আগের মতোই এই কথাগুলো লেখা ছিল না- ফলে বিষয়টি পরিস্কার যে এটা নিছক কোন ছাপার ভুল বা অবহেলা নয় বরং খুব সুনির্দিষ্ট কারণেই এই শ্লোগানটি বিজ্ঞাপনে দেয়া হয় নি। আর সেই কারণটি হলো- একুশের ৩০ মিনিট কে কেন্দ্র করে দেয়া গোটা বিজ্ঞাপনটিরই গ্রামীণ ফোনের কর্পোরেট শ্লোগানে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া- ফলে ঐ বিজ্ঞাপনে আলাদা করে আর ”কাছে থাকুন। গ্রামীণ ফোন” শ্লোগানটির কোন প্রয়োজন থাকলো না!
এই পর্যন্ত পড়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন - ঠিক আছে, বুঝলাম, গ্রামীণ ফোন, প্রথম আলো এবং অন্যান্য মিডিয়াগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের কাজে ২১ শে ফেব্রুয়ারির সেই ৩০ মিনিট কে ব্যাবহার করছে। কিন্তু তাতে সমস্যা কি? সেই ৩০ মিনিটের ঘটনাকি ভাষা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার দিকে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি? কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যাবহার করলেও তো তারা ভাষা আন্দোলনের মহান ইতিহাসের একটা অংশকেই তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে- তাতে কি সমস্যা? আপাত দৃষ্টিতে কোন সমস্যা মনে না হলেও আমাদের দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনকে এভাবে পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্রেফ ৩০ মিনিটের একট স্বতস্ফুর্ত ঘটনার ফলাফল হিসেবে দেখানোর কর্পোরেট প্রকল্পটি চুড়ান্ত বিচারে ইতিহাস বিকৃতি এবং ইতিহাস বিক্রির প্রকল্প- এতদিন আমরা দেখেছি শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো কেমন করে তাদের দলীয় স্বার্থে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছে, এইবার দেখলাম স্রেফ বাণিজ্যের স্বার্থে কর্পোরেটরা কি সুন্দর জোট বাঁধে এবং ইতিহাসের বিকৃতি ও খন্ডায়ন ঘটায় । সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে চলুন মতিউর রহমানের আরো কিছু কথা শুনি- তিনি তার তত্ত্বটিতে বলছেন- ”সেই দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিটই নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের মহান মাতৃভাষা আর জাতির ভাগ্য, যা কিনা স্ফুলিংগ হিসেবে কাজ করেছে। সেই স্ফুলিংগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল শহর থেকে গ্রামে, প্রতিটি জনপদে।”- এই যে ভাষা আন্দোলনের ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ’৩০ মিনিটই’ কথাটির ব্যাবহার এবং মতিউর রহমানের পুরো লেখাটির কোথাও সেই ৩০ মিনিটের আগের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কোন ধরণের উল্লেখ-ই না থাকা- এই দুইয়ে মিলে এমন একটি ধারণা তৈরী করে যে, মনে হয়, সেই ৩০ মিনিটের সাথে বুঝি পুর্বাপর কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কোন সংযোগ ছিলনা কিংবা সেই ৩০ মিনিটের আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন বোধহয় কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরই ব্যাপার ছিল। কেবল হঠাৎ করে ঘটা এই ৩০ মিনিটের ঘটনায় সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের আত্মত্যাগের ফলেই ভাষা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল!
চলুন দেখা যাক, এই স্ফুলিংগ ও দাবানল বিষয়ে ভাষা আন্দোলনের প্রধানতম ভাষ্যকার বদরুদ্দীন উমর তার ”ভাষা, শ্রেণী ও সমাজ”(১৯৮৫) বইয়ে কি বলেছেন:
”১৯৫২ সালের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলি কোন দাবানল সৃষ্টি করতে না পারলেও ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনা দাবানল সৃষ্টিকারী স্ফুলিংগের কাজ করেছিলো কারণ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এই সময়ের মধ্যে ব্যাপক ও গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কোন অত্যাচার নির্যাচতন, তা যতই নির্মম হোক, সব সময়ে দাবানল সৃষ্টিকারী স্ফুলিঙ্গের কাজ করতে পারেনা। সেটা সম্ভব হয় তখনই যখন দাবানল সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র জনজীবনে তৈরী হয়। এই ক্ষেত্রটিই তৎকালীন পূর্ব-বাঙলায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্বে তৈরী হয়েগিয়েছিল এবং ঠিক সে কারণেই ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ড এমন এক স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছিল যা জনগণের রাজনৈতিক জীবনে প্রজ্জ্বলিত করেছিলো এক অদৃষ্টপূর্ব দাবানল।”
আবার ২১শে ফেব্র“য়ারির সাধারণ ধর্মঘটের ডাকে সারাদেশের মানুষের অংশগ্রহনের ব্যাপারে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সংকলন ’একুশে ফেব্রুয়ারি’ তে কবির উদ্দিন আহমদ তার ’একুশের ইতিহাস’ নামক লেখায় বলেছেন-
”৪ঠা ফেব্রুয়ারি থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের জন্য প্রচার প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঢাকার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে সমগ্র প্রদেশের জনমনে তখন বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। স্বরাজোত্তর কালে সরকার বিভিন্ন উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে যে প্রাণধবংসী ক্ষতির ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল, তারই প্রত্যক্ষ আঘাতের ফলে জনসাধারণের দৃষ্টি খুলে গেছে, অন্ধমোহ কেটে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভাষার কণ্ঠরোধ করার নতুন ষড়যন্ত্র তাদের অসন্তোষকে দ্বিগুণতর করে দিয়েছে। সমগ্র প্রদেশ তখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। দিন দিন অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনও পরিলতি হচ্ছে।”
কাজেই এই ”দুনিয়া কাপানো ৩০ মিনিটের” ঘটনার আগে থেকেই সারাদেশের মানুষ ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল এবং সেই সাথে শোষণ বঞ্চনার বারুদ-ই হলো ভাষা আন্দোলনের মূল নিয়ামক- ’৩০ মিনিটের স্ফুলিংগ’ নয়। তাহলে কি কারণে মতিউর রহমান আর গ্রামীণ ফোন চক্র এই বারুদ ঢেকে রেখে স্রেফ ৩০ মিনিটের স্ফুলিঙ্গের দিকে দৃষ্টি দিলেন? এর কারণ হলো কর্পোরেটরা যখন কোন কিছুকে তাদের ব্র্যান্ডিং এর কাজে ব্যাবহার করে তখন সেটাকে তাদের সুবিধা মতো যথেষ্ট নির্বিষ করে নিয়েই ব্যাবহার করে- যেকারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী চেগুয়েভারা তাদের কাছে হয়ে উঠে একজন রোমন্টিক বিপ্লবী তারুণ্যের প্রতীক যার ছবি টি-শাটের্র শোভা বাড়ায় কিংবা যাকে নিয়ে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে সুশীল স্মরণ সভা করা যায়, যেকারণে তাদের কাছে একাত্তরের গণসংগীত হয়ে উঠে ”জাগরণের গান” যেগুলোকে রাজনৈতিক সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যাবহারের বদলে ড্রয়িংরুমে বসে সিডিতে উপভোগ করা যায় কিংবা ক্যাম্প ফায়ারের রোমান্টিক পরিবেশের উষ্ণতা বাড়ানোর কাজে ব্যাবহার করা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি হয়ে প্রতœতাত্ত্বিক ”একাত্তরের চিঠি” কিংবা ভাষা আন্দোলন তার রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিপ্রেতি হারিয়ে হয়ে যায় ”৩০ মিনিটের স্ফুলিঙ্গ”। এখন, ভাষা আন্দোলনকে যদি তার পুরো প্রেক্ষাপট সহ তুলে আনতে হয় তাহলে সেটা আর তাদের ব্র্যান্ডিং এর জন্য যথেষ্ট নিরাপদ থাকবে না কারণ এর সাথে যুক্ত হয়ে উঠে আসবে শোষণ বঞ্চণার প্রশ্ন, শ্রেণীর প্রশ্ন এবং শ্রেণী শোষনের আবসানের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশ্ন-যে প্রশ্ন ১৯৫২ সালের অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় পার করে এসেও আজকের বাংলাদেশে সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক এবং সমান ভাবেই শাসক শ্রেণীর এবং সেই শাষক শ্রেণীর অংশ হিসেবে প্রথম আলো কিংবা গ্রামীণ ফোন ওয়ালাদের ভয়ের কারণ।
এই ভয়ের ব্যাপারটি ছাড়াও ইতিহাস বিক্রির এই প্রকল্পের সাথে আরেকটা বিষয় যুক্ত- প্রতিনিয়ত সাবান-শ্যাম্পুর মত পণ্যের মোড়ক নবায়ন, একই পণ্যকে বিভিন্ন রুপে হাজির করে বাজার ধরে রাখার মতই নিত্যনতুন সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে সংযুক্ত হয়ে এবং প্রয়োজনে নয়া সাংস্কৃতিক উপাদান নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে কর্পোরেট ব্র্যান্ড ইমেজ নবায়ন ও মানুষের মনে তার একটা স্থায়ী আসন স্থাপনের তাগিদ। মতিউর রহমান তার মন্তব্য প্রতিবেদনটিতে ভাষা দিবসকে নতুন ভাবে উদ্যাপনের কারণ সম্পর্কে বলছেন-”একুশ নিয়ে অনেক বছর ধরে আমরা প্রায় একই ধরনের অনুষ্ঠান করে চলেছি। এ কারণে আমরা এবার নতুন কিছু করতে চেষ্টা করছি... ... আমরা আশা করি, আমরা স্বপ্ন দেখি, এই ’দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট’ স্মরণের অনুষ্ঠান আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের স্থায়ী অংশে পরিণত হবে।” তাদের এই আশা ও স্বপ্নের মাজেজা হলো-রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সাথে সাথে ছায়ানটের নামটি যেমন বাঙালী মানসে একটা স্থায়ী আসন লাভ করেছে, তেমনি ভাবে এদের আকাংখা অনুসারে ’দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিট’ অনুষ্ঠানটি যদি আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের স্থায়ী অংশে পরিণত হয়, তাহলে এ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এসব কর্পোরেটও আমাদের ইতিহাস ও জাতীয় সংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন গেড়ে বসবে। নতুন ভাবে উদযাপন করার নামে ইতিহাস ও সংস্কৃতির জমিনের এই দখল নেয়ার পায়তারা চলতেই থাকবে যতদিন রাষ্ট্র ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংরক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার ঐতিহাসিক ভূমিকাটুকু এড়িয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ২:২৯