১.
ফরাসি বিপ্লবের পর সে দেশের বুদ্ধিজীবিরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে একটা নতুন ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব করেন যেটাতে ১২ মাসে বছর হবে ঠিকই, তবে প্রতিটি মাস আবার তিনটি দশকে বিভক্ত থাকবে। সেই ক্যালেন্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, প্রতিটি দিনের একটি বিশেষ নাম থাকবে; ফলে ৭ ই আগষ্ট লেখার বদলে শুধু ’বেগুন’ বা ’টমেটো’ লিখলেই চলতো! কারো জন্ম তারিখ ৭ ই আগষ্ট হলে তার জন্মতারিখের জায়গায় লেখা হতো 'বেগুন’। ব্যাপারটা একটু কেমন যেন তাই না! যাই হোক, ফরাসিরা ১৮০৮ সালে এসে সেই ক্যালেন্ডার বাতিল করে পুরাতন ক্যালেন্ডারে ফিরে আসে। স্বস্তি! স্বস্তি!
না, অত স্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই! বোধহয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এবার কেন্দ্র হলো যুক্তরাষ্ট্র। ক্যালেন্ডারের প্রায় প্রতিটা দিনই এখন একটা ’দিবস’, প্রতিটা দিনই এক একটা নামে পরিচিত। তবে ফরাসি তারিখের নামের সাথে বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রের এই দিবসের নামের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো এই যে, এই দিবসগুলোর উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক হলো বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানি। যেমন: ন্যাশনাল হিস্টরি ডে’র স্পন্সর হলো ’হিস্টরি চ্যানেল’, আমাদের আলোচ্য ’ভ্যালেন্টাইনস ডে’ কিংবা ফ্রেন্ডশিপ ডে’র স্পৃষ্ঠপোষক হলো হলমার্ক, আর্চিস, ডিজনিল্যান্ড ইত্যাদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।(১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ডে’র স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ ’উইনি দ্য পুহ’ কে অ্যাম্বাসেডর অব ফ্রেন্ডশিপ ঘোষণা করে। এখানে লক্ষণীয় যে, উইনি দ্য পুহ হলো একটি কার্টুন চারিত্র যেটিকে ওয়াল্ট ডিজনি সাহেব ১৯৫৮ সালে তার ডিজনি ওয়ার্ল্ড এর অন্তর্ভুক্ত করেন।)
’ফারেনহাইট ৯/১১’ খ্যাত পরিচালক মাইকেল মুর তার একটি টিভি শো'তে দেখিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিভাবে কোনো একটি বিশেষ পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কংগ্রেসম্যানদের টাকা খাইয়ে ঐ পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন একটা দিবস ঘোষণা করা হয়। আর আমাদের দেশে তো আমরা দেখছি ভালেন্টাইনস ডে কিংবা ফ্রেন্ডশিপ ডে'তে হলমার্ক কিংবা আর্চিস গ্যালারির কার্ড বিক্রি কি পরিমাণ বেড়ে যায়!
২.
১৯১০ সালে জয়েস সি হলমার্ক যখন হলমার্ক নামের দোকান খুলে কার্ড ব্যাবসা শুরু করেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে- বদলে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু পরিবার। যেখানে পুঁিজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চাপে দু’মুঠো অন্ন যোগাড় করতে গিয়ে মানুষকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে; রুটি রুজির পেছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ এক সময় দেখে যে, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ছেড়ে সে একা। অন্যদিকে যান্ত্রিক জীবন যাপন করতে গিয়ে সে হারিয়ে বসে আছে তার মননশীলতা, কেননা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির চৌহদ্দি থেকে সে অনেক দূরে। ফলে সে তার নিজের গভীর আবেগ আর আগের মতো প্রকাশ করতে পারছে না। হলমার্ক সাহেব (এবং তার মতো আরো অনেক বুদ্ধিমান ব্যাবসায়ী) ঠিক এই অবস্থাটির সুযোগ নিল। হলমার্কের একটা বিশেষ গুণ ছিল যে, সে আবেগ অনুভুতির ব্যাপারগুলো অল্প কথায় বেশ গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারতো। ফলে দারুণ দারুণ সব ডায়লগ লেখা কার্ডে বাজার ছেয়ে গেল এবং সেই কার্ডগুলো বিক্রয়ের উপলক্ষ তৈরী করতে আবির্ভূত হলো বিভিন্ন দিবস বা হলিডে।
৩.
কোন পণ্যের বিজ্ঞাপণ দুই পদ্ধতিতে দেয়া যায়। একটা পদ্ধতি বেশ সরাসরি- অমরা বেশ পরিস্কার বুঝি যে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন চলছে যখন কোন মিডিয়া স্টার নেচে গেয়ে কোন পণ্যের গুণকীর্তন করে এবং এক সময় বলে ’আমার সাফল্যের গোপন রহস্য’ হলো এই পণ্য কিংবা ’আমার আছে আপনার আছে কি?’ ইত্যাদি। এটাকে বলে ’পুশ’ করা , কোন পণ্যকে ক্রেতার চাহিদার তালিকায় ধাক্কা দিয়ে ঢোকানো।
আরেকটা পদ্ধতি হলো পরোক্ষ পদ্ধতি যেটাকে বলা হয় ’পুল’ করা- ক্রেতাকেই কোন বিশেষ ধরণের পণ্যের দিকে টেনে আনা। এর জন্য প্রয়োজন এমন একটা পরিবেশ তৈরী করা যেন ক্রেতা মনে করে যে ঐ সময়ে ঐ নির্দিষ্ট ধরণের পণ্যের ক্রেতা না হলে যেন তার তারুণ্য বা আধুনিকতা ইত্যাদি ইমেজ গুলো আর থাকে না! বিভিন্ন দিবস ঘোষণা করে এবং এগুলোকে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণার মধ্যে এনে ঠিক এই কাজটিই করা হয়।
এভাবে দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে, ভ্যালেন্টাইনস ডে কিংবা ফ্রেন্ডশিপ ডে এগুলো আসলে এক একটা গোপন বিজ্ঞাপন!
৪.
এখন প্রশ্ন হলো, এই যে দিবসগুলো যেগুলোর সাথে আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে কোন সত্যিকারের সম্পর্ক নেই এবং যেগুলো আসলে এক একটা গোপন বিজ্ঞাপন, সেগুলোকে আমরা ঠিক কি ভাবে দেখব? এক্ষেত্রে খুব সহজেই দুটো পক্ষ পাওয়া যায়। এক পক্ষ বলে, প্রেম-ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব কি এক দিনের ব্যাপার যে ঘটা করে বছরের একটা দিনে পালন করতে হবে? অপর পক্ষের পাল্টা জবাব, মানলাম, এগুলো একদিনের নয়, বিচ্ছিন্নতার এই যুগে, একটি বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে আমাদের ভালোবাসা বা বন্ধুত্বকে যদি একটু ঝালিয়ে এবং রাঙিয়ে নেয়া যায় তাহলে ক্ষতি কি?
এ বিষয়ে যেটুকু বলবার, তা হলো: হতে পারে, কোন একটি বিশেষ দিনে আমরা আমাদের বন্ধুত্ব বা ভালোবাসাকে উদযাপন করতে পারি। কিন্তু সেটা কবে করবো, কিভাবে করবো, কি উপহার দেব( বা আদৌ উপহার দেব কি-না- কেননা অনেকেই মনে করতে পারেন টাকা দিয়ে কেনা পণ্যের মাধ্যমে আর যাই হোক সম্পর্ক গভীর হয় না!) উপহারের গায়ে কি লেখা থাকবে, সেটাতো আমরা বন্ধুরা মিলেই ঠিক করতে পারি, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? সেটা কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ঘোষণা করবে কিংবা হলমার্ক বা আর্চিস গ্যালারি বলে দেবে? কেন আমরা আমাদের ব্যাক্তিগত আবেগ অনুভূতি নিয়ে কোন ব্যাবসায়িক কর্পোরেশনকে মুনাফা লোটার এবং তার মাধ্যমে আমাদের মানবিক সম্পর্কগুলোকে বাণিজ্যিক সম্পর্কে পরিণত করার সুযোগ করে দেব?
আবার কিছু দিবস আছে যেগুলো ঐতিহাসিক- যেমন: আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি যৌথভাবে সবাইকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আরো বেশি করে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু এ দিবসটিও এখন বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার হাতিয়ার। যেমন: বর্ণবাদি কোম্পানি ইউনি লিভারস আজকে নারী দিবসের অন্যতম স্পন্সর। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা নারীর মর্যাদা বিষয়ে এর সামান্য মাথা ব্যথাও নেই, থাকার কথাও নয়- মুনাফার প্রয়োজনে নারীকে পণ্য বানানোর দিকেই এর সমস্ত প্রচেষ্টা( ’সৌন্দর্য্য সাবান’ লাক্স কিংবা ’ফেয়ার এন্ড লাভলি’র বিজ্ঞাপন দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় নারীর শরীর এবং শরীরি সৌন্দর্য্যকে এরা কিভাবে পণ্য বানাচ্ছে)। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে- নারী দিবস ক্রমশই তার ঐতিহাসিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে দূরে এবং বিপরীত দিকে সরে যাচ্ছে।
আবার, কিছু দিবস আছে যেগুলোকে এখনও কর্পোরেট হাউসগুলো মুনাফার হাতিয়ার বানাতে পারেনি যেমন- মে দিবস, হিরোশিমা দিবস ইত্যাদি। দিবসগুলো এমন কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এমন সব চেতনা বা সংগ্রামকে সামনে নিয়ে আসে যেগুলো মুনাফালোভীদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ। কর্পোরেট হাউসগুলো সরাসরি এসব দিবসের বিরোধীতা না করলেও, এদের দ্বারা স্পন্সরড দিবসের প্রচারণার ডামাডোলে পড়ে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে যেমন: সারা বিশ্বেই ফ্রেন্ডশিপ ডে’র আড়ালে চাপা পড়ে যায় হিরোশিমা দিবস আর আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইনস ডে’র আড়ালে চাপ পড়ে যায় ১৪ই ফ্রেব্র“য়ারির স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস- ১৯৮৩ সালের এই দিনে তৎকালিন সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের অবসান ও গণবিরোধি মজিদ খান শিক্ষাকমিশন বাতিলের দাবিতে তীব্র আন্দোলন রচনা করেছিল তৎকালিন ছাত্রসমাজ। ১৪ই ফেব্র“য়ারি তারিখে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে যাত্রা শুরু করে কার্জন হল ও শিক্ষাভবনের সামনে পৌছানো মাত্রই আর্মি-পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জাফর-জয়নাল-দিপালী সাহা। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সারা দেশেই তীব্র হয়ে উঠে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যার ফলশ্র“তিতে ’৯০ এর গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে সামরিক শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। আজ সামরিক শাসক ক্ষমতায় নেই কিন্তু কর্পোরেট সংস্কৃতির এমনই মহিমা যে, ১৪ই ফেব্র“য়ারি তারিখে যে তারুণ্য একদিন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস রচনা করেছিল সেই তারুণ্যেরই একটা অংশ এখন চলমান শোষণ নির্যাতন প্রতিরোধের বদলে কর্পোরেট স্পন্সরড ’ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে বুঁদ হয়ে থাকে!
আসুন আমরা ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে স্বৈরচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করি।