কল সেন্টারঃ চলুন ঘুরে আসি
গাড়ি কোম্পানী ফিয়াটের মিলানে অবস্থিত কলসেন্টারটি প্রথমেই আপনাকে মুগ্ধ করবে। ভেতরে প্রচুর স্পেস, দেয়ালগুলো বহুরঙা। অসংখ্য তরুণ তরুণী কানে হেড সেটসহ বড় বড় ফ্ল্যাট-স্ক্রীণ মনিটরের সামনে বসে আছে, কেউ হাঁটা চলা করছে আর কেউবা ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বসে কফি খাচ্ছে কিংবা ধূমপান করছে। তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছেঃ ইতালীয়, ফরাসি, জার্মান, স্পেনিশ, পুর্তগীজ, পোলীয়......। দৃশ্যটা দেখে বোঝা দায়- কোথায় এসে পড়লাম- সাইবার ক্যাফে নাকি কোন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের নিউস রুমে।
কাজ শুরুও হয় বেশ রিলাক্সড ভাবে। জয়েন করার পরপরই আপনাকে একটা ট্রেনিং দেয়া হবে। যেখানে বলা হবে কোম্পানী কবে কোন পুরস্কার পেয়েছে, বলা হবে যে এখানে সবাই খুব ভালো, সবার সাথে সবাই ভালো আচরণ করে কেননা এখানে কাজ মানেই আনন্দ। আর আপনাদের কাজ হলো সারাক্ষণ হাসা- এমনকি ফোনে কথা বলার সময়ও- কেননা তাহলেই কাস্টমাররা খুশি থাকবে আর ফিয়াট কিংবা আলফা রোমিও কেনা অব্যহত রাখবে। কাজ শুরুর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলে, যখন আপনি ইতোমধ্যেই কয়েকশ কলের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন এবং চারপাশ থেকে আপনার দিকে স্বাগতম বাণী আসা বন্ধ হয়ে গেছে, তখনই আপনি বুঝতে শুরু করবেন কোথায় এসে পড়েছেন আপনি!
এখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় সাতশ যার অধিকাংশই নারী- সার্বক্ষণিক কিংবা খণ্ডকালীন। এরা প্রায় সবাই দশ মাস বা বার মাসের চুক্তির ভিত্তিতে কর্মরত। এদের একটা অংশ বিভিন্ন প্রাসাশনিক কাজ সামলায় কিন্তু বেশীর ভাগই বসে আছে ফোনের সামনে- ভাষা, কাজের ধরণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তৈরী বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এরা কাজ করছে।
আগমনী বিভাগের কর্মীদের কাজ বাহির থেকে আসা বিভন্ন ফোন রিসিভ করা- প্রাইভেট কাস্টমারের কমপ্লেন কিংবা বিভিন্ন প্রশ্ন-থেকে শুরু করে গাড়ির ডিলার কিংবা গ্যারেজের কর্মচরীদের ওয়ারেন্টি বিষয়ক প্রশ্ন কিংবা স্পেয়ার পার্টসের অর্ডার নেয়া কিংবা বাতিল করার কাজ এদের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। আর বহির্গমন বিভাগের কাজ হলো ফোন করে ইনস্যুরেন্স কিংবা অন্যান্য সার্ভিস বিক্রি করা ।
কলসেন্টার টেকনোলজি হলো অসংখ্য পিসি, টেলিফোনী যন্ত্রপাতি, নতুন পুরাতন অসংখ্য সফ্টওয়ার, ফ্যাক্স মেশিন ইত্যাদির সমন্বয়---- যেখানে তার আর হেডসেট সহ আপনি একজন ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত বন্দী কিংবা একজন মস্তিষ্ক রোগী যার মাথা তারের মাধ্যমে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত। আর দশটা কলসেন্টারের মত এখানেও রয়েছে এসিডি (অটোমেটিক কল ডিস্ট্রিবিউশান) মেশিন যা কল আসার সাথে সাথে হিসাব করে কোন দেশ থেকে এটি এসেছে, কোন ভাষাভাষি কর্মীদলের কাছে এটি দেয়া যায় এবং নির্দিষ্ট ভাবে কোন কর্মীটি এখন ফ্রি আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এর সাথে যুক্ত হয় একটি সিটিআই (কম্পিউটার টেলিফোনী ইন্টিগ্রেশান) মেশিন যার মানে হলো ঐ নির্দিষ্ট কলটি যার কাছে যাবে তার মনিটরে কলার ব্যাক্তির যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠবে। এভাবে কলসেন্টার এজেন্টের কানে সরাসরি কলটি হাজির হবে- ম্যানুয়ালি গ্রহণ বা বর্জনের কোন সুযোগ এক্ষেত্রে নেই। কর্মীটি কেবল একটি বিপ কিংবা মেশিন ভয়েস শুনবে- যার সাথে সাথেই কাস্টমার তার সাথে অনলাইনে চলে আসবে......
দিনের শুরুতে, সঠিক ভাবে বললে শিফ্টের শুরুতে, কল সেন্টার এজেন্টটিকে তার পিসিতে লগ ইন করে বেশ কিছু সফ্টওয়ার চালু করতে হয়, যেমনঃ কলের বর্ণনা লিখে রাখার সফ্টওয়ার, স্পোয়ার পার্টস অর্ডার দেয়ার সফ্টওয়ার ইত্যাদি। কিছু প্রোগ্রামস উইন্ডোস ভিত্তিক অর্থাৎ ক্লিক করে করে কাজ করা যায় আর কিছু প্রোগ্রাম রয়েছে ডস ভিত্তিক অর্থাৎ কমান্ড লিখে কাজ করতে হয়। প্রত্যেকটি পিসি আবার নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে একটি কেন্দ্রিয় ডাটাবেসের সাথে যুক্ত। একজন প্রথম পর্যায়ের এজেন্টকে কাজের পুরো কাঠামো সম্পর্কে পুরোপুরি না জানলেও চলে। কোন ক্ষেত্রে হয়তো একটা তথ্য খুঁজে দিলেই একটি কলের কাজ শেষ আবার কোন ক্ষেত্রে হয়তো তাকে একটি কলের মাঝে কোন একটি ফ্যা করতে হলো তার আবার কথা, কথা শেষ হওয়া মাত্রই এসিডি মেশিনের জাদুকরী কর্মদক্ষতায় আরেকটি কল.....। সাধারণ ভাবে নিজেই নিজের কাজ শেষ করা যায়, কোন ক্ষেত্রে সহকর্মী কিংবা টিম লিডারের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হয়। যদি কোন সমস্যা সমাধান করা না যায় তাহলে কাস্টমারকে মিস্টি করে বুঝিয়ে বলা যে কিছই করার নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি কেসকে দ্বিতীয় লেভেলে পাঠানোর কাজও করতে হয় যেমন কোন টেকনিক্যাল সমস্যা কিংবা কোন স্পেয়ার পার্টসের অর্ডার ইত্যাদি। প্রথম লেভেলে সমাধান করা যায়নি এরকম সমস্যা দ্বিতীয় লেভেলকে দেখতে হয় এবং তা সমাধান করতে হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
নামে কলসেন্টার হলেও কাজটি কিন্তু কেবল কল করা নয়। কল গ্রহণ করা, লোকের সাথে কথা বলা, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, শোনা, উত্তর দেয়া.... এবং একই সাথে আপনার হাতটিকে কিন্তু ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে কম্পিউটারে নাম্বার এবং তথ্য ঢোকানো, উপযুক্ত বাটনে ক্লিক করা, স্ক্রীণে ভেসে উঠা তথ্য থেকে প্রয়োজনীয়টি খুঁজে নেয়া...... মাঝে মাঝে দেখলে মনে হয় কর্মীটি যেন মনিটরের উপর হামাগুড়ি খাচ্ছে..... সামান্য তথ্যের বিনিময়ে পার পাওয়াগেলে ভাল নইলে কেউ হয়তো ফোন করে ফিয়াটের বিভিন্ন সমস্যার জন্য আপনাকে গালাগালি করবে, কারো কাছে আপনি স্রেফ একজন চাকর যার কাজ দ্রুত, সুন্দর ভাবে এবং বাধ্যগত ভাবে তার প্রয়োজনটি মেটানো, কেউ হয়তো এত রেগে থাকবে যে আপনি তাকে কিছুই বোঝাতে পারবেননা আর কেউ হয়তো রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় থেকে ফোন করবে যার একটি কথাও আপনি বুঝবেননা কিন্তু এদের প্রত্যেককে আপনার সন্তুষ্ট করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই- নইলে সর্বক্ষণ মনিটর করতে থাকা টিমলিডার আপনার হাতে নোটিশ ধরিয়ে দেবে। টিম লিডারের কাজই হলো আপনাকে কন্ট্রোল করা। তাদের একটা প্রোগ্রাম থাকে যার মাধ্যমে তারা মনিটর করে কোন কর্মী ঘন্টায় কয়টা কল ধরল, গড়ে কতক্ষণ সময় প্রতিকলে ব্যয় করলো, কয়টা সমস্যা সমাধান করলো কিংবা কতক্ষণ অলস থাকার চেষ্টা করলো।
ফলে কল, কল আর কল---- মগজের ভেতর একটা কনভেয়ার বেল্ট ঘুরতে থাকে। একটা কল প্রসেস করার সাথে সাথেই আরেকটা কল তারপর আরেকটা। নির্মম এসিডি মেশিন কাউকে ফ্রি থাকতে দেয়না। কাজটা প্রচন্ড ক্লান্তিকর - যেহেতু একই কাজ আবার করতে হয়, যেহেতু কাস্টমাররা একই প্রশ্ন করতে থাকে আর আপনিও একই উত্তর দিতে থাকেন, যেহেতু একই সফ্টওয়ারের মাধ্যমে একই সিকোয়েন্সে আপনি তথ্য ঢোকাতে থাকেনঃ নাম, নম্বর, আরেকটা নম্বর, আরেকটা.... যেহেতু সারাক্ষণ আপনাকে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, যেহেতু মানুষকে বুঝতে এবং বোঝাতে আপনার বেগ পেতে হয়..... যতক্ষণ না শিফ্টের শেষ হয় আর আপনার মাথা ভনভন করতে থাকে এবং আপনার অবস্থা এমন হয় যে বাড়ি ফেরার বাসে বসে পত্রিকার পাতাতেও আপনি আর মনোযোগ রাখতে পারেননা। (১)
কলসেন্টারের কেন্দ্রীভবন ও আউটসোর্সিং
বিশ্বব্যাপি কলসেন্টারগুলো মূলত পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশে অবস্থিত। আমেরিকার কলসেন্টারে বলা হয় কয়েক মিলিয়ন কর্মী কাজ করছে, ব্রিটেনে অর্ধ মিলিয়ন, জার্মানী, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ায় দেড় লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষ। নব্বই দশকের আগপর্যন্ত ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডেই পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ কলসেন্টার স্থাপিত হতো মূলত ইংরেজীভাষাভাষী কর্মীর প্রাচুর্যের কারনে। একইভাবে কোন একটি দেশের মধ্যেও কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ সুবিধাকে কেন্দ্র করে কলসেন্টার গড়ে উঠে যেমন ভারতের দিল্লী বা মুম্বাই কিংবা ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড, লন্ডন, ওয়েলস্ ও উত্তর ইংল্যান্ড ইত্যাদি।(২)
যেসকল কারনে কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কলসেন্টার গড়ে উঠে সেগুলো হলঃ
# পর্যাপ্ত এবং সস্তায় শ্রমিক প্রাপ্তি (উচ্চ বেকারত্ব, ছাত্র বেশী থাকে এরকম জায়গা)
# কাছাকাছি পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা তথাকথিত কলসেন্টার ট্রেনিং সংস্থাথেকে ট্রেনিং পাওয়া শ্রমিকের প্রাপ্যতা
# কোন কোন অঞ্চলে কাঠামোগত সংস্কারের নামে করা শিথিল শ্রম আইন যেমন জার্মানীতে রবিবার এবং ব্যাংক হলিডেতে কাজের অনুমতি প্রদান
# অন্যান্য টেকনিক্যাল সরবরাহ যেমন যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং রক্ষাণাবেক্ষণ ইত্যাদির সুবিধা কিংবা কাস্টমার যেমন বিভিন্ন মিডিয়া বা সফ্টওয়ার কোম্পানীর সহজলভ্যতা ইত্যাদি
তবে কলসেন্টার ব্যাবসায়ীরা মূলত উচ্চ বেকারত্বের হার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এলাকা যেখানে সহজে এবং সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় সেসব অঞ্চলকে পছন্দ করে। আবার যে কারনে কোন একটি অঞ্চলে কলসেন্টার স্থাপিত হয় ঠিক সেই কারনেই সেটি অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর কে না জানে, মিল-কারখানা কিংবা খনির চেয়ে কলস্থানান্তর কত সহজ; যে কোন কলকেই খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠিয়ে দেয়া যায়- কাষ্টমার বুঝতেই পারেনা সে ঠিক কোন অঞ্চলের কর্মীর সাথে কথা বলছে-কেননা ট্রেনিং এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাচন থেকে আঞ্চলিকতার বিলোপ। আউটসোর্সিং বিভিন্ন ভাবে কাজ করেঃ
# কাস্টমারদের সব কলই পাঠিয়ে দেয়া হয় এঙ্টার্নাল সার্ভিস প্রদান কারী কোন কলসেন্টার কোম্পানীতে।
# সাধারন জিজ্ঞাসা মূলক কলগুলোকে আউটসোর্সিং করে দেয়া হয় কিন্তু গুরুত্বপূণ কলগুলোকে নিজস্ব কলসেন্টার বা কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের কাছে পাঠানো হয়।
# নিজস্ব কলসেন্টার কাজ করে শুধু সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে এবং অফিস আওয়ারের মাঝে। এর বাইরের সময়ের কলগুলো সামলায় ভিন্ন টাইম জোনে অবস্থিত কোন দেশের কলসেন্টারের সস্তা শ্রমিকেরা।
এরকম বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিং বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে আউটসোর্সিং শুরু হয় তখনই যখন দেখা যায় দেখা যায় নিজস্ব কলসেন্টার কিংবা কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের এঙ্টার্নাল কলসেন্টারের শ্রমিকের মজুরী বাড়াতে হচ্ছে। যেমনঃ
# নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ তাদের কলসেন্টারটি দক্ষিণ লন্ডন থেকে গ্লাসগোতে স্থানান্তôর করে দেয় যার মূল কারণ ছিল মজুরী।
# নব্বই দশকের শেষের দিকে শোনা যেতে থাকে যে আমেরিকান কোম্পানীগুলো ভারতীয় কলসেন্টার দিয়ে তাদের কাস্টমার সার্ভিস চালিয়ে নিচ্ছে যেমনঃ জিই ক্যাপিটাল(ফাইনান্স) কিংবা আমেরিকান এপ্রেস(ক্রেডিট কার্ড ) ইত্যাদি।
# স্প্যানিস টেলিকম কোম্পানী টেলিফোনিকার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এতেন্তেôা টেলিকমিউনিকেশান ২০০১ সালে তাদের কলসেন্টার স্থাপন করে মরোক্কতে কেননা সেখানে প্রচুর স্প্যানিশ ভাষী শস্তôা শ্রমিক রয়েছে।
# একই ভাবে জার্মানীতে ডাক সরবরাহকারী কোম্পানী অট্টো হুমকী দেয় যে এসেন এর কমীরা যদি ৫০০ ডয়েস মার্ক মজুরী হ্রাস মেনে না নেয় তাহলে তারা তাদের কলসেন্টারটিকে পূর্ব জার্মানীতে সরিয়ে নেবে। অন্যদিকে পূর্ব জার্মানী থেকে কলসেন্টারগুলো সরে যায় পশ্চিম পোল্যান্ডে।
কলের পর কল-বাড়ে শ্রমের মাত্রা, গড়ে উঠে মুনাফার পাহাড়
“অফিসে মাত্র ঢুকেছি। পিসিতে লগইন করে বসা মাত্রই টিম লিডার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বললঃ ‘এই নাও তোমার গতকালকের পরিসংখ্যান। তুমি নির্ধারিত সীমার চেয়ে একমিনিট পচিঁশ সেকেন্ড বেশী বিরতি নিয়েছ।’ আমি মনে মনে বলছি মহিলা মরেনা কেন! কিন্তু এটা কেবল শুরুঃ ‘তাছাড়া তোমার অপ্রস্তুত থাকার সময় অন্যান্য এজেন্টদের চেয়ে ১০% বেশী আর তুমি গড়ে প্রতি ঘন্টায় ২০টি কলের টার্গেট ও ধরতে পারনি। কাজেই তুমি আর বোনাস পাচ্ছনা।’ মহিলা চলে যাচ্ছে না কেন যেন আমি এক কাপ কফি খেতে পারি? কিন্তু তিনি বলেই চলেছেনঃ ‘আমরা তোমাকে সাহায্য করবো। আগামীকাল তোমার ট্রেইনার এসে তোমার কথোপকথন শুনবেন এবং তোমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।’ ট্রেইনার আসবে! অসহ্য! সে আবারও ঘ্যান ঘ্যান করবে কাস্টমারের সাথে কথাবলার সময় আমার হাসির অনুপস্থিতি নিয়ে এবং পরামর্শ দেবে কথার মাঝে আমি যেন ’সমস্যা ’ শব্দটি যেন উচ্চারণ না করি.......।” (৩)
কলসেন্টারে কাজের স্ট্রেস বা চাপের দুটি ধরন আছেঃ
১। কাজটি একঘেয়ে যেহেতু একই কাজ বারবার করতে হচ্ছে
২। কাজটি প্রচন্ড কষ্টকর যেহেতু একের পর এক কাজ আসতেই থাকে
এই দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিপতির একটি মাত্র উদ্দেশ্য কাজ করে। আর তা হলো কাজকে যতটা সম্ভব উৎপাদনশীল ও লাভজনক করে তোলা যায়। এই উদ্দেশ্যে সে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলে এবং প্রত্যেক কর্মীকে ছোট্ট একটি ভাগের দ্বায়িত্ব দেয়। শ্রমিকের কাজকে পর্যবেক্ষণ এবং কাজের সময় পরিমাপের মাধ্যমে এই ছোট কাজগুলোকে ভালো করে বিশ্লেষণ করা হয় এবং একটা নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স বা পর্যায়ক্রমও ঠিক করে রাখা হয়। কলসেন্টারে এটা করা হয় কল হ্যান্ডল করার প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি নির্ধারিত পর্যায়ে বিভক্ত করা এবং কলার বা কাস্টমারের সাথে কথা বলার প্রমিত বাগধারা বা স্টান্ডার্ড ফ্রেজ ঠিক করে দেয়ার মাধ্যমে। এই ভাবে কলসেন্টারগুলোতে কাজকে পরিমাপ এবং তুলনাযোগ্য করে তোলা হয়- যা কলের নির্দিষ্ট ছন্দ নির্ধারন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ(যেমনঃ প্রতি ঘন্টায় ২০টি কল করতে হবে বা ধরতে হবে)।
শ্রমের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য মালিকেরা আরেকটা জিনিস ব্যবহার করে তা হলো টেকনোলজি। এরা সেই টেকনলজিই ব্যবহার করে যার মাধ্যমে একাধারে শ্রমের মাত্রা বাড়ানো এবং শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ দুটোই করা যায়। কম্পিউটার এবং টেলিফোনের সংযোগের ফলে কলের ছন্দ দ্রুত করা এবং শ্রমিককে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দুটোই সম্ভব হয়েছে (কলের পরিমাণ, বিরতি, সময় ইত্যাদি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে)। নির্দিষ্টি সফ্টওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের ক্রমধারা স্থির করা সম্ভব হয়েছে কেননা এর বাইরে গেলেই সফ্টওয়ার কাজ করবেনা। এসিডি মেশিনের ব্যবহারের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফোন সরাসরি কর্মীর কাছে চলে আসে- কর্মীকে ম্যানুয়ালি ফোন রিসিভও করতে হয়না। এইভাবে ম্যানেজমেন্ট কলগ্রহণের পরিমাণের উপর থেকে কর্মীর নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দিয়েছে। এতো গেল ইনকামিং কলের কথা। আউটগোয়িং কলের ক্ষেত্রেও রয়েছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পাওয়ার ডায়ালিং যার মাধ্যমে কর্মী একটি কল শেষ করে নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকটি কল করা হয়ে যায়। জার্মানির একটি কলসেন্টার শ্রমিকের অভিজ্ঞতা শোনা যাকঃ
“আমি কোয়েলেতে কাজ করি আর প্রতিদিন লক্ষ করি কেমন করে তারা আমাদের ৮ ঘন্টার কাজকে যত বেশী সম্ভব শ্রমঘন করার চেষ্টা করে। তারা ২০০০ সালের জুলাই মাস থেকে নির্দিষ্ট প্রমিত বাক্যাংশ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেছে এবং এর জন্য আমাদের উপর নজরদারীও করে। শুধু বাইরে থেকে আসা কলই নয় তারা নিজেরাও সময় সময় আমাদের পারফরমেন্স পরীক্ষার জন্য কল করে। এরপর এগুলো দলগত ভাবে বিশ্লেষণ করা হয় এবং আমাদের সামনে ডকুমেন্টেশান করা হয়। আমাদের নিজেদের ক্যাসেট প্লেয়ার মনে হওয়া দিয়ে তাদের কিছুই যায় আসে না। আর আমাদেরকে বলা হয় আমরা যেন আমরা যেন কোয়ালিটি রক্ষা করি, কাস্টমারকে প্রয়োজনীয় সময় দেই, কথপোকথনের সময় একটা উষ্ণ পরিবেশ তৈরী করি এবং সবসময় যেন কন্ঠে সেই নন্দিত হাসির ছোঁয়া ধরে রাখি। কোয়ালিটি ম্যানেজাররা এগুলো দিয়েই আমাদের পারফরমেন্সের মূল্যায়ন করে। সুতরাং আমাদেরকে প্রমিত বাগধারা ব্যবহার করতে হবে, সর্বোচ্চ গুনাগুন রক্ষা করতে হবে এবং একই সাথে ঘন্টায় গড়ে ২২টি কলের টার্গেট ছুঁতে হবে। এরপরও চাপে ভেঙে না পড়ার কোন কারণ আছে?”(৪)
মানব সম্পদের কি দারুণ ব্যবহার!
ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে মাষ্টার্স পাশ করা আমার এক বন্ধু অনেক দিন বেকারজীবনের অভিশাপ বহনের পর অবশেষে সিটিসেলের কলসেন্টারে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে তার বেকারত্বে অভিশাপ মোচন করে। কলেজ জীবনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় কবিতা আবৃত্তিতে তাকে কখনও দ্বিতীয় হতে দেখিনি। তার সুললিত কণ্ঠ আর শুদ্ধ বাচন ভঙ্গিমার কি দারুন ব্যবহার সে এখন করতে বাধ্য হচ্ছে! আরেক বন্ধু ইতিহাসে অনার্স পাশ করার পর চাকরী করছে গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ার ডিপার্টমেন্টে কাস্টমার ম্যানেজার হিসাবে- ম্যানেজার হলেও কাজ কিন্ত একই- অভিনয় এবং আবৃত্তিতে অর্জিত দক্ষতা দিয়ে ফোনের অপর প্রান্তের রাগী কাস্টমারকে ম্যানেজ করা। তালিকা আরও বড় করা যায়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই চিত্রটি মোটামোটি একই। পুঁজিপতিরা নাকি মানুষকে সম্পদ হিসাবে ভাবতে ভালবাসে- অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্তই, যতক্ষণ পর্যন্ত তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকে মুনাফার পাল্লায় পরিমাপ করা যায় এবং লাভজনকভাবে বিক্রি করা যায়। আর এই কেনা-বেচার খেলায় ‘বেচারা সম্পদ’ তার প্রকৃত মূল্য হারিয়ে কখন যে হাতুড়ি বা স্ক্রু-ড্রাইভারের মত স্রেফ একটা সরল যন্ত্রে পরিণত হয়, যাকে খুব সহজেই আরেকটা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়! পুঁজিবাদী অর্থনীতির এ সাধারণ চিত্র সবচেয়ে বেশী প্রকট মনে হয় যখন দেখি আমার সেই বন্ধুদের মত অসংখ্য মেধাবী তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর কিছু অর্থের বিনিময়ে স্রেফ কথা বলে বলে তার,মেধা ও জীবনি-শক্তির অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বন্ধুদের আমি যখনই ফোন করেছি দুই মিনিট কথা বলার জন্য আমাকে কমছেকম দশমিনিট লাইনে থাকতে হয়েছে- কেননা একটু পরপরই কাস্টমারের ফোন এসে বাগড়া দেয়। এখানে যেসব কম্পানির নাম উল্লেখ করেছি সেগুলো সহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং, হাসপাতাল, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি যেসব খাতে কলসেন্টার চালু রয়েছে তার সবগুলোই কিন্তু ইনহাউস অর্থাৎ কোম্পানির নিজস্ব কলসেন্টার-এদের মুনাফার মূল উৎস কলসেন্টার নয়, কলসেন্টার মুনাফা অর্জনে সহায়ক মাত্র। তাতেই যে অবস্থা, বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয়না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশান(বিটিআরসি)কতৃêক যে কোম্পানিগুলোকে কলসেন্টারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে এবং লাইসেন্স পাওয়ার পর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সস্তা! সস্তা! বলে যে প্রচারণা এরা শুরু করেছে , এসব কলসেন্টারের অবস্থা কেমন হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন কলসেন্টারকে কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুনাফা অর্জনের একটি নতুন উপায় হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে, আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে ভারতেও ঠিক একই প্রচেষ্টা হয়েছে। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পর আজ যখন কলসেন্টার,সেখানকার কাজের পরিবেশ, কর্মীর উপর তার প্রভাব ইত্যাদির দিকে তাকানো শুরু হয়েছে, ততদিনে পুরো একটা প্রজন্ম কখনও ভোর, কখনও বিকাল, কখনও বা মধ্যরাত্রির শিফ্ট ডিউটি পালন করতে করতে, একটার পর একটা ফোনের চাপ সহ্য করতে করতে, একঘেয়ে কাজ একটানা করতে করতে...... কানে এবং মস্তিস্কে নিদারুণ ক্ষত সহ, তিরিক্ষি মেজাজ ধারনকারী, খিটখিটে, অসহিষ্ণু, অস্থির ও অমনোযোগী একটা সমাজ-বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের শ্রমমন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ভি•ভি গিরি জাতীয় শ্রম সংস্থা কলসেন্টার সম্পর্কিত একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।(৫) গবেষণা রিপোর্টে কলসেন্টারে কাজ করা তরুণ-তরুণীদের স্রেফ সাইবার কুলি হিসাবে অভিহিত করে বলা হয়ঃ “এই কলসেন্টার এজেন্টদেরকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এর মধ্যে এমন একটি জঘন্য পরিবেশে কাজ করতে হয় যার সাথে কেবল ঊনবিংশ শতকের কয়েদখানা কিংবা প্রাচীন রোমক দাস-জাহাজের পরিবেশের তুলনা চলে..... এখানে ক্যাফে, পপকর্ণ বুথ কিংবা পিংপং টেবিল ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে একদিকে কাজকে আনন্দায়ক বলে অভিহিত করার চেষ্টা করা হয় অন্যদিকে প্রতি ঘন্টায় ইমেইল বা কলকরা বা গ্রহণ করার হার এমন উঁচু মাত্রায় বেঁধে দেয় হয় যার ধারে কাছে পৌঁছতে গিয়েও কলসেন্টার এজেন্টটিকে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে হয়।” রিপোর্টটিতে বিনিতা রাওয়াত নামের ইংরেজী সাহিত্যে মাষ্টর্স এক তরুণীর কথা তুলে ধরা হয় যে মনে করে রবার্ট ব্রাউনিং কিংবা জেন অস্টিনকে বোঝার মাধ্যমে ব্রিটিশ সোসাইটি সম্পর্কে তার একটি অন্তদৃষ্টি তৈরী হয়েছে যা সে তার থেকে ৪০০০ মাইল দুরের কোন ব্রিটিশ কাস্টমারকে ম্যানেজ করতে কাজে লাগাতে পারে। বিনিতার মত উচ্চশিক্ষিত কর্মীরাই কলসেন্টারগুলোতে কাজ করছে। এ বিষয়ে রিপোর্টটি বলা হয়ঃ “বিনিতা ভারতের সাইবার কুলিদের প্রাইম উদাহরণ- জনগণের অর্থে ব্যায়বহুল শিক্ষায় শিক্ষিত একজন উচ্চমেধার গ্রেজুয়েট, যে কলসেন্টার ইনডাস্ট্রির জন্য নিজেকে নিঃশেষ করা এবং বুদ্ধিহীন পুনরাবৃত্তিমূলক একটি কাজ করার মাধ্যমে নিজের মেধার অপচয় করছে।” রিপোর্টটিতে কাজের ধরণ এবং চাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জামিনী নামের ২০বছর বয়সী একতরুণী যে কিনা এইচ.সি.এল নামের একটি কলসেন্টার কোম্পানীতে কাজকরে, তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ “কাজের কঠিন চাপ। এত বিপুল পরিমাণ কল আসে যে আমরা নিঃশ্বাস নেয়ারও সময় পাইনা অথচ কাস্টমাররা প্রায়ই বিরক্ত যে তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। ঘন্টাগুলো ভাগ করা। যদি আপনার বাথরুম চাপে, তবে আপনার জন্য বরাদ্দকৃত পিরিয়ড আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমার বাবা মা চান যেন আমি এ কলসেন্টারের চাকুরী ছেড়ে দেই কেননা তারা দেখছেন কেমন করে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে।” শুধু ভারত নয় শ্রীলংকা, নেপাল, ফিলিপিন সব দেশেই একই অবস্থা। তরুণ-তরুণী কাজে যোগ দেয়ার পর ভীষণ কাজের চাপ, উচ্চ শ্রম-শোষণ আর হতাশার কারণে যারা পারে তারা দ্রুতই অন্যত্র চলে যায়। যেমনঃ নেপালের কাঠমুন্ডুতে বসবাসকারী তরুণ সঞ্জয় দাস। সে চার বছর ধরে কাঠমুন্ডুর বিভিন্ন কলসেন্টারে কাজ করার পর অবশেষে গত বছর চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে। সঞ্জয়, যে একজন সুপারভাইজার হিসাবে মাসে ২০,০০০ রূপী বেতন পেত, বলেছে, শতকরা আশিভাগেরও বেশী নতুন যোগদানী তরুণ কয়েক মাসের মধ্যেই চাকুরী ছেড়ে দেয়। নেপালী তরুনরা কলসেন্টারে কাজ করে মাসে ৬,০০০ থেকে ৪০,০০০ রূপী পর্যন্ত অর্জন করতে পারে। কলসেন্টারের কাজের পরিবেশ সম্পর্কে সঞ্জয়ের বক্তব্যঃ “এখানে ঢোকা মাত্রই আপনি টের পাবেন এটা ঠিক স্বাভাবিক পরিবেশ নয়.... বেতনটা ভাল পেলেও তার বিনিময়ে স্বাস্থ্যটা আপনাকে ত্যাগ করতে হবে••••।” সঞ্জিবের মতো মাসে ২০,০০০ রূপী বেতনভোগী একজন সুপারভাইজারের কাছে বেতন ভালো মনে হলেও ২১ বছর বয়সী সুশান্ত কৈরালা, যে কাঠমুন্ডুর রেড ক্যারিয়টে ৪ মাস কাজ করেছে, তার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলেঃ “লোভনীয় অফার দেখে চাকুরীতে ঢুকি। কিন্তু প্রতিশ্রুত বেতন না পেয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছি। তারা আমাকে ৬,০০০ রূপী দেবে বললেও বাস্তবে দিচ্ছিল মাত্র ৪,০০০ রূপী করে.....”(৬)
পুঁজির ধর্মঃকলসেন্টার স্থাপনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা
একটি কলসেন্টার যেভাবে কাজ করে তা কোন দুর্ঘটনা নয়, কোন মহাপরিকল্পনার ফসল নয় কিংবা নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরীর জন্য মহান পুঁজিপতিদের কোন প্রকল্পও নয়। বরং বিগত কয়েক দশকের ক্রমহ্রাসমান মুনাফার হার, শ্রেণী সংগ্রাম এবং পুঁজির আপন ধর্মের প্রতিক্রিয়ায় এর উদ্ভব। উদাহরণ স্বরূপ আমরা যদি ব্যাংকিং সেক্টরের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে ব্যাংকিং সেক্টরে কলসেন্টার মানে হলো শ্রমিকের নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাবহার এবং অবস্থান ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমে শোষণের হার বৃদ্ধি করণ। একজন ব্যাংকারকে ট্রেনিং দেয় বেশ সময় এবং খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার।আবার ব্যাংক কর্মীর দক্ষতা যত বাড়তে থাকে তার দাবীদাওয়া এবং উচ্চাশাও তত বাড়তে থাকে। যেকারণে ব্যাংকিং সেক্টরের মজুরী বেশ বেড়ে যায় এবং কাজের উপর ব্যাংক কর্মীদের নিয়ন্ত্রণও বেশ জোরদার হতে থাকে। আশির দশকের শেষে এবং নব্বই দশকের গোড়ারদিকে ইতালি, জার্মানি এবং আরো অন্যান্য দেশে লাগাতার ধর্মঘটের মাধ্যমে শোষণের হার বাড়ানোর জন্য ইতিপূর্বে নেয়া বিভন্ন পদক্ষেপ যেমন মজুরী হ্রাস, শ্রমের আরো বিভাজন কিংবা কাজের ইন্টেনসিটি বা মাত্রা বাড়ানোর পদক্ষেপ বেশীদূর যেতে পারেনি।
এধরনের দক্ষ শ্রমিকের ক্ষমতা কমানোর জন্য শুরু করা হলো কাজের নতুন ধারাঃ ব্রাঞ্চ অফিস। এসব কলসেন্টারে একজন দক্ষ শ্রমিকের কাজকে বেশকয়েকজন কলসেন্টার কর্মীর মাঝে ভাগকরে দেয়া হলো। এক্ষেত্রে একজন কর্মীকে তার নির্দিষ্ট কাজটি শেখাতে সময় লাগে এক বা দুসপ্তাহ কেননা কাজের সম্পূর্ণ প্রসেসটিকে ভেঙে কয়েকটি সরল ধাপে ভাগকরে এক একেজন কলসেন্টার কর্মীকে তা শেখানো হয়। এই পদ্ধতিতে পুঁজিপতির পক্ষে শ্রমের মাত্রা বা ইন্টেনসিটি বাড়ানো (বিভিন্ন নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে) সম্ভব হলো এমন পর্যায়ে যেখানে একদিনে একজন কলসেন্টার কর্মী শতশত কাস্টমাররের একাউন্ট ইনফরমেশান প্রদান করে। পুঁজিপতিরা এভাবে একদিকে কলসেন্টারের কাজকে ‘অদক্ষ’ ও ‘হালকা’ বলে কম মজুরী প্রদান করে, অন্যদিকে শ্রমের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষনের হার বৃদ্ধি করে চলে। কলসেন্টারগুলোকে ’ব্যাটারি কারখানা’ এবং ‘কমিনিউকেশান এসেম্বলি লাইনে’র সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এই তুলনা এসেছে শ্রমিকের প্রতক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেঃ শব্দময় বড় বড় অফিস, কল প্রতি পিস রেট, কাজের চাপের ধরণ ইত্যাদি কারণে।
তথ্যসূত্রঃ
১) hotlines - call centre,2002
Click This Link
২) ঐ
৩) ঐ
৪) ঐ
৫) Painful truth of the call centre cyber coolies, Graduates burnt out by dreary work, unsocial hours and Big Brother-style observation - all at the end of your telephone
Click This Link
৬) Call centre workers: a disillusioned lot, By Baburam Kharel
Click This Link