বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হল বিদ্যুত। এবারে গিয়েও বুঝলাম - ঢাকার অনেক উচ্চবিত্ত অঞ্চলেও দিনে বেশ কয়েকঘন্টা কারেন্ট থাকেনা। আর ব্যবসার কথা তো ছেড়েই দিলাম, কারেন্ট না থাকলে এসি বন্ধ রেখে অধিকাংশ মার্কেটে জেনারেটর চলে। একি অবস্থা ঢাকার বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতেও। ইউ-পি-এস, ব্যাটারি বা জেনারেটর চলে সর্বত্র।
শুনলাম বাংলাদেশে বিদ্যুত ঘাটতি ২০০০ মেগাওয়াটের মত। মানে, আরো ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াতে পারলে বিদ্যুত সমস্যা মেটানো যাবে। কিন্তু সত্যি কি তাই? এই বক্তব্যের মধ্যে একটা বড় ফাঁক আছে। কি রকম? ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা যায় বাংলাদেশে মাত্র ৪০% (access to electricity) বাড়িতে বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। বাকি ৬০% এর হিসাব কি করা হয় বিদ্যুত ঘাটতি হিসাবের সময়? করা হয় না। অর্থাৎ, আগামী ১০ বছর ধরে পরিকল্পনা করে বিদ্যুত আমদানী করে ও উৎপাদন বাড়িয়েও বিদ্যুত ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে না, যদি বিদ্যুতের কানেকটিভিটি বাড়ানো হতে থাকে। ১০% বিদ্যুত উৎপাদন বাড়িয়ে যদি আরো ১০% বাড়িতে বিদ্যুতের কানেকশন দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যায়।
এই বিদ্যুত ঘাটতিতে জনগণের যখন নাভিশ্বাস ওঠে, তখন তারা আঙুল তোলে সরকারের দিকে। কিন্তু সরকারের করণীয় কি? প্রথমত, যদি হিসাব অনুযায়ী ধরে নিই দেশের ৬০% লোকের কাছে বিদ্যুত পৌঁছয় নি, তাহলে একই কারণে ধরে নেওয়া যায়, ৬০% মানুষের কাছে বিদ্যুত ঘাটতি ভোটের কোনো ইস্যু নয়। কিন্তু নতুন জায়গায় বিদ্যুতের লাইন পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারলে নতুন ভোটব্যাঙ্ক পাওয়া সম্ভব। কারণ যারা একেবারেই বিদ্যুত-বঞ্চিত, তারা দিনে পাঁচ ঘন্টা বিদ্যুত পেলেও বেজায় খুশী হবেন। তাই সরকারের লক্ষ্যই হবে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন কানেক্টিভিটিও বাড়িয়ে ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখা। অর্থাৎ, উৎপাদন বাড়লেও চাহিদাও বাড়বে, মানে ঘাটতিও অপরিবর্তিত থাকবে। এর সাথে যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাৎসরিক দেড় শতাংশ নতুন জনগণ যোগ করেন তো অবস্থা খারাপ ছাড়া আর ভাল হবে না। আর শহুরে জনগণ এসিতে অভ্যস্ত হচ্ছে - তাদের মাথাপিছু বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমবর্ধমান।
আরেকটা ব্যাপার বলতে ভুলে গিয়েছিলাম - সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশে শিল্পায়নের হার অত্যন্ত কম। একমাত্র সফল শিল্প টেক্সটাইল ও গারমেন্টস দেশের রপ্তানী আয়ের ৭৫% এনে থাকে। ঘটনাচক্রে, এই শিল্পেও যথেষ্ট বিদ্যুত (অথবা সরাসরি গ্যাস) লাগে। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই শিল্পকে বঞ্চিত করে বিদ্যুত ডোমেস্টিক সাপ্লাই লাইনে দেবার সাহস থাকবে না - কারণ লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকা এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, সময় গেলে, টেক্সটাইল ও গারমেন্টস শিল্প বাড়াতে গেলে আরো বিদ্যুত চাই। বিদ্যুত চাই পরিবহনেও। বাংলাদেশে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে মেট্রো রেল চালু করা দরকার। কাছাকাছি কয়েকটা শহর গড়ে তুলে তাদের মধ্যে বৈদ্যুতিক রেল যোগাযোগ দরকার। অর্থাৎ বিদ্যুত চাই। একইভাবে, কৃষিতে সেচের জলের জন্যও বিদ্যুত দরকার। তাহলে, বিদ্যুত উৎপাদন বাড়লে গৃহস্থালীর বিদ্যুত ঘাটতির উন্নতি নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত বা পাকিস্তানে মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদনের হার বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ - তাও সেখানেও গৃহস্থালীর কারেন্ট না থাকার সমস্যা যথেষ্টই আছে।
এবারে নজর ঘোরানো যাক উৎপাদনের দিকে। বাংলাদেশের ৮০% বিদ্যুত আসে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে - অর্থাৎ তাপবিদ্যুত। প্রমাণিত মজুদ অনুযায়ী চললে ২০১৫ সালের পরে গ্যাস উৎপাদন কমবে। সরকার বড়জোর উৎপাদন আরো কিছুবছর ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন, সমুদ্র-বক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান করে। যদি অনেক গ্যাস পাওয়া যায় তো ঠিক আছে, না পাওয়া গেলে, বা গ্যাস বিদেশে রপ্তানী করে দিতে হলে? আবার সেই একই গ্যাসে গাড়িও চলে, ফার্টিলাইজারও তৈরী হয়। গ্যাসের ওপর দাবীও কম মানুষের নেই। কার্যত, গ্যাসই হল বাংলাদেশের একমাত্র বিদ্যুতের উৎস, যা দিনে দিনে ফুরিয়ে আসছে।
সব মিলিয়ে আদর্শ টাইম বোমা। মানুষ বাড়ছে, বিদ্যুত চাহিদা বাড়ছে। অথচ বিদ্যুতের উৎপাদনের মূল উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। সমস্যা জটিল। টেকনলজির কোনো অভূতপূর্ব উন্নতি না হলে কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে বিদ্যুত অথবা গ্যাস আমদানী করতে হবে। আর বিদ্যুত আমদানী যদি ভারত থেকে করা হয় তাহলেই রাজনীতি জটিল হবে। একটা পথ হল ভারত/নেপাল/ভুটান থেকে জলবিদ্যুত আমদানী করা। সেক্ষেত্রে টিপাইমুখের মত জলবিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তিগুলো গুরুত্ব হারাবে। আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধাও কম আসবে না। আরেকটা হল, মায়ানমার থেকে গ্যাস আমদানী করা। কিন্তু মায়ানমার থেকে গ্যাস কিনতে গেলে একরকম চিনের (বা পরে ভারতের) সাথে সরাসরি বিডের লড়াইতে নামতে হবে। অর্থাৎ সে আশাও কম। মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত গ্যাস পাইপলাইন হলেও গ্যাসের মূল ক্রেতা হবে ভারত। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি পেরিয়ে এই পাইপলাইন বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
আর বাকি থাকে অপ্রচলিত বা নবায়ণযোগ্য শক্তি। একমাত্র এই সম্ভাবনাই এখনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সৌর-প্রযুক্তি বা বায়ুশক্তি কাজে লাগানোর যথাসম্ভব প্রচেষ্টা করতে হবে। ইন্টারনেট ঘাঁটলে পাই যে যে কোনো নতুন শক্তির উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করে তা থেকে চাহিদা মেটানোর মত অবস্থায় যেতে অন্তত ৫-৮ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ, আজ একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের পরিকল্পনা করলে যথেষ্ট নিউক্লিয়ার বিদ্যুত পেতে ২০১৮ সাল লেগে যাবে। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর ঝক্কিও কম নয়। প্ল্যান্টের আশেপাশের অঞ্চলের লোকজন আপত্তি তুলবে। তাও বিকল্প হিসাবে এটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাই তাড়াতাড়ির মধ্যে এটাই ভাল সমাধান বলে মনে হয়। আর সেই সাথেই শুরু হয়ে যাক সোলার, উইন্ড, বায়োম্যাস আর টাইডাল পাওয়ার নিয়ে পাইলট প্রোজেক্ট। এগুলো থেকে যথেষ্ট বিদ্যুত পেতে ১০-১২ বছর অপেক্ষা করতে হবে। যখন গ্যাস উৎপাদন কমে আসবে, তখন এগুলো ধীরে ধীরে তার স্থান দখল করে নেবে। তবে সেই সাথে বিদ্যুত আর গ্যাস আমদানীর চেষ্টাও রাখতে হবে।
পরিকল্পনা ঠিকঠাক চললে আগামী দশ-পনেরো বছরের মধ্যে আমি অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হতে পারে। তবে রাতারাতি উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই আমার মনে হয়। সরকারকে গালি দিলে সরকার বলবে আগের সরকারে দোষ, আগের সরকার বলবে তার আগের সরকারের দোষ। কার্যত দোষ কারো নয়। আবার অন্যভাবে বললে দোষ সবারই - কেন এই পরিকল্পনা আরো দশ বছর আগে করা হয় নি। সত্যি হল - বাংলাদেশে যা রিসোর্স আছে, তা দিয়ে শিল্প, কৃষি ও পরিবহনের খাত সহ ১০০% লোকের কাছে ২৪ ঘন্টা ধরে বিদ্যুত সরবরাহ করা সম্ভব নয় - প্রযুক্তির বর্তমান অবস্থায় তো নয়ই। মেনে নিতেই হবে এটা আপাতত। সব সমস্যা রাজনৈতিক নয়, তাই সব সমাধানও রাজনৈতিক ভাবে আসা সম্ভব নয়।
একই সাথে কফি হাউসের আড্ডায় প্রকাশিত।