হঠাৎ করেই ছোট মাঠ থেকে বড় মাঠে খেলার সুযোগ পেয়ে আমি তখন খুব খুশি। ছোট মাঠে খেলার অনেক হ্যাপা আছে। তার ওপর যেখানে আগে খেলতাম সেটাকে ছোট মাঠ বলাও ভুল হবে। কারণ সেটা আসলে একটা একতলা বাড়ির সামনের একটা চলাচলের রাস্তা। সেখানেই ছোট থেকে খেলে আসছি। তাই ব্যবস্থা খারাপ হলেও আমি এ রাস্তাটাকে অনেক পছন্দ করতাম। তবে অনেক ঝামেলাও হত। কোন বাউন্সারকে যদি কেউ সপাটে মেরে একটা ফোর বা সিক্স আদায় করত, তাহলে তাতে হাততালি পাবার বদলে বকা খাবার সম্ভাবনা থাকত বেশি! কারণ সে শটে যদি বলটা সেই একতলা বাড়ির কোন খোলা বাসার সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেত, তাহলে আমাদের সে বল উদ্ধার করতে খবর হয়ে যেত। সে বাসার আন্টি কিছুতেই বল দিতে চাইত না, দিলেও তার ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে হত। "বদমাশ ছেলে”" ... "“বড়দের সম্মান দিতে জানে না"” ... "“কত বড় বেয়াদব!"” ... এরকম কত যে বকা খেতে হয়েছিল! পাশাপাশি সেখানে জমিয়ে রাখা লোহালক্কড়ের প্যাচে পড়ে যে কত বল হারিয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাই সে রাস্তা বা ছোট মাঠ ছেড়ে যখন বড় জায়গায় খেলার সুযোগ পেলাম, তখন মন খানিকটা খারাপ হলেও সবমিলিয়ে খুশিই হয়েছিলাম। সেখানে বড় ভাইদের ঝামেলা পোহাতে হলেও সেই ডেঞ্জারাস আন্টির বকা কিংবা বল হারানো - এসব নিত্য নৈম্যত্তিক ব্যাপারে ছাড় পাব, এটা ভাবতেই ভাল লাগছিল।
বড় মাঠে যাবার পর প্রথম কয়েকদিন বেশ খেলে কাটালাম। কিন্তু সেখানে যাবার পর একটা নতুন সমস্যা হল; সেটা হল আমি আমার ফর্ম হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেললাম! যে আমি আগের মাঠে ব্যাটিং এ বোলাদের পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলতাম, সেই আমিই বড় মাঠে এসে একটাও সিক্স মারতে পারলাম না! পাশাপাশি বোলিং এও অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আগে প্রতি ম্যাচেই কমপক্ষে এক উইকেট পাওনা থাকত আমার। কিন্তু এখানে আসার পর সকলে আমার বল বেশ মজা করে মারতে থাকল। আগে আমি ডানহাতি ফার্ষ্ট বোলার থাকলেও এখানে আসার পর নির্বিষ মিডিয়াম ফাষ্ট বোলারে পরিণত হলাম। তাই - ই সকলে বেশ মজা পেয়ে গেল আমার বোলিং এ।
সব মিলিয়ে তখন বেশ খারাপ অবস্থা। আমি আর খেলে মজা পাই না। অন্যদিকে ক্লাস এইটে উঠেছি বলে ইংলিশে ভাল করার জন্য একজন প্রবীণ টিচার প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় আসতেন। তাঁর অত্যাচার আর আমার ফর্মহীনতা - সব মিলিয়ে আমি বেশ বেকায়দায়। খেলা শুরু হবার কিছু সময় পরই বুয়া বাসা থেকে ছুটে এসে আমাকে ধরে নিয়ে যেত। কারণ কী? উত্তর -– টীচার বাসায় বসে আছেন! কিছু বলাও যেত না বাসায়। কিছু বললেই বলত, "“বাবু, এটা ক্লাস এইট। আগের মত ঢিলেমি দিয়ে পড়লে হবে না। বৃত্তি পেতে হলে জোরে সোরে পড়তে হবে ... ... ...”" হাবিজাবি হাবিজাবি! কাজেই স্পিকটি নট!
এভাবে এক মাসের মত সময় চলে গেল। মাঠে আমার ফর্ম আবার উঠতে থাকল। ব্যাটিং মোটামুটি হচ্ছিল, মাঝে মধ্যে দুই একটা ফোরও মারতে পারতাম। বোলিং এ ততদিনে লেগ স্পিনার হয়ে গেছি। এতে বেশ সুবিধা হল। অন্য টিমের সাথে ম্যাচ খেলার সময় আমার মত এরকম একজন স্পেশালিষ্ট (!) লেগ স্পিনার দেখে তারা থতমত খেয়ে যেত। কারণ পুরো মাঠে এরকম আলাদা কোন স্পিনার ছিল না কোন দলে। ফলশ্রুতিতে উইকেট পেতে থাকলাম নিয়মিত। আর এরকম ম্যাচ খেলাকালীন উইকেট কিপার হিসেবে প্রত্যাবর্তন - সবমিলিয়ে দিন ভালোই কাটছিল; যদিও ঐ দিকের টীচারের সমস্যা তখনো মেটেনি। তা না কমে বরং দিন দিন বাড়তে থাকল। অবস্থা একসময় এমন দাঁড়াল যে আমাকে হয় বিকেলে খেলতে হবে নয়তো বাসায় বসে সেই এককালীন জাঁদরেল টীচারের সামনে বসে ইংলিশের মডেল কোয়েশ্চেন করতে হবে।
এই সমস্যার মাঝে পড়ে অবশেষে আমাকে একটা অপশন বেছে নিতেই হল। "“লেখাপড়া করে যে - ই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে –- ই”", এই প্রবাদ বাক্যকে মেনে নিয়ে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিলাম। অন্য অর্থে আউটডোর গেম খেলাই ছাড়তে হল আমাকে। কারণ সময় না পাওয়া। স্কুল, বৃত্তি কোচিং, প্রাইভেট – এ সবগুলো আমার সকল সময় শুষে নিল। ফলশ্রুতিতে দেশের একজন অতি সাধারণ ছেলের খেলোয়াড়ি জীবনের মৃত্যু হল এবং তার সে বছর সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি প্রাপ্তি হল।
প্রথম প্রকাশিত আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:২৭