১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জেতার মাধ্যমে এদেশে ক্রিকেট নিয়ে উদ্দামতার শুরু হয়। যার জের ধরে ১৯৯৯ সালে এদেশ প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলে, ২০০০ সালে টেষ্ট ষ্ট্যাটাস পায়, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের আংশিক দায়িত্ব ও ২০১৪ সালের টি - টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পূর্ণ দায়িত্ব অর্জন করে।
আমাদের দেশের মত ক্রিকেট উন্মত্ততা সারা দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই। আইপিএল, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ও বিসিসিআই এর দাপটের কারণে ক্রিকেট এখন অনেকটাই ভারতমুখী। কিন্তু আধুনিক ক্রিকেটের চারণভূমি ভারত হলেও ক্রিকেট নিয়ে কাজ কিন্তু প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে, যাদের মাধ্যমে এখানে খেলাটির প্রবর্তন হয়। প্রথম প্রথম নর্থ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে এই খেলা সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ প্রভৃতির মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। তাই বর্তমানে আইসিসির মেম্বার সংখ্যা ১০৫।
বর্তমান ক্রিকেট যুগ টি - টোয়েন্টির হলেও প্রায় সকল ক্রিকেটার কিন্তু একবাক্যে স্বীকার করে থাকেন যে এই খেলাটির আসল মজা টেষ্টে। কারণ পাঁচ দিনের এই খেলার প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে থাকে রোমাঞ্চ, যার স্বাদ টি -– টোয়েন্টি দূরে থাকুক, ওয়ানডেও দিতে পারে না। তাই ক্রিকেটের এই ধারার এক নাম্বার আসনটির এতটা মূল্য।
আজ আমি এই মজাদার ধারার ক্রিকেট নিয়ে কিছু আলোচনা করব। তবে আমি বেশি খুশি হব যদি একে আলোচনা না ভেবে গল্প মনে করে তার মাঝে ডুবে যেতে পারেন। যদি তা করতে পারেন, তাহলেই আমি মনে করব যে আমার এই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
১.
আমরা বর্তমানে যে ক্রিকেট উপভোগ করে থাকি, তার শুরুটা হয় এঁদের মাধ্যমে। জেমস লিলিহোয়াইট নামক এক ইংলিশ ক্রিকেটার ১৮৭৬ - ৭৭ সালে একটি শক্তিশালী দল নিয়ে নিউজিল্যান্ড - অষ্ট্রেলিয়া সফরে যান। সেখানে তিনি কম্বাইন্ড অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর দল নিয়ে দুটি টেষ্ট খেলেন; যার প্রথমটি স্বীকৃতি পায় ইতিহাসের প্রথম টেষ্ট হিসেবে। সে টেষ্টে অষ্ট্রেলিয়া ৪৫ রানের জয় পায়। খেলাটি ৪ দিনে শেষ হয়। তখন অবশ্য টাইমলেস খেলা হত; অর্থাৎ রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত খেলা। ১৫, ১৬, ১৭, ১৯ মার্চ, ১৮৮৭ সাল - এই ছিল খেলাটির সময়কাল। কিন্তু ১৮ তারিখ কী হয়েছিল? সেদিন রেষ্ট ডে ছিল!
২.
ইনিই সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রথম টেষ্ট ম্যাচটির প্রথম বল সামলান এবং প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরী করেন! দেশের অভিষেক টেষ্টে সেঞ্চুরী করা যত ব্যাটস্ম্যান আছেন (মোটমাট তিনজন), তাদের মধ্যে সবচাইতে বড় স্কোরটা হচ্ছে ১৬৫, যা এঁনার করা। তিনি কিন্তু আরো রান করতে পারতেন, কিন্তু জর্জ ইউলিয়েটের বলে আঙুলে চোট পাবার কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন; নয়ত সম্ভবত প্রথম ২০০ রানও তাঁরই ব্যাট থেকে আসত!
৩.
সময় ১৮৮২, ২৯ আগষ্ট। এইচ এফ বয়েলের বলে যখন ই পিয়েটের ষ্টাম্প এলোমেলো হয়ে যায়, তখন সাথে সাথে এক ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। নিজের মাটিতে ইংল্যান্ড প্রথমবারের মত হারের স্বাদ গ্রহণ করে; প্রতিপক্ষ হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়া। অথচ ৩ দিনের সে টেষ্টের (খেলা হয় দুই দিন) প্রথম ইনিংস শেষে ইংল্যান্ডের পক্ষে অনেক ভাল করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারা ৬৩ রানের জবাবে ২য় ইনিংসে করে মাত্র ১০১ রান। এরপর অষ্ট্রেলিয়া মাত্র ১২২ করলে ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৮৫ রানের। তার জবাবে তারা মাত্র ৭৭ রানে অলআউট হয়ে যায়। তাদের এ সর্বনাশ করে The Demon Bowler খ্যাত এফ আর স্পফোর্থ নামের এক পেস বোলার ৪র্থ ইনিংসে ৭ উইকেট নিয়ে।
ইংল্যান্ডের সংবাদ মাধ্যম এটা ভাল চোখে নেয় না। তাই পরদিন The Sporting Times তাদের পত্রিকায় ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মৃত্যু ঘোষণা করে এবং উল্লেখ করে, “"The body shall be cremated and the ashes taken to Australia."” এরপর নানা ঘটনা মাধ্যমে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন যুদ্ধ শুরু হয় –- The Ashes!
৪.
১৮৯০ থেকে ১৯১৪ -– এই সময়কালকে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সে সময়ে তরুণেরা ক্রিকেটে ‘ষ্টাইল’ শব্দটার প্রবেশ ঘটায়। ফলে খেলাটা অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। এসকল যুবক ক্রিকেট খেলাটার উপর ভিত্তি করে নিজেদের রুটি - রুজির ব্যবস্থা করত না। তাই তারা অনেক টেনশান ফ্রি ভাবে খেলাটা খেলত। কিন্তু এ স্বর্ণকাল বেশিদিন টিকতে পারেনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হবার কারণে।
সে সময়ে যে সকল ক্রিকেটার চমৎকারভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন অষ্ট্রেলিয়ার ভিক্টর ট্রাম্পার। যেকোন পরিস্থিতিতে রান তোলার এক অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর, বিশেষ করে বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পিচে তাঁর মত ভাল ব্যাটিং তখনকার সময় আর কেউ করতে পারত না। তখন বৃষ্টি হলে পিচ ঢাকার ব্যবস্থা করা হত না। ফলে বোলাররা রীতিমত উইকেট উৎসবে মেতে উঠত বৃষ্টির পর। সেরকম বিরুদ্ধ পরিস্থিতে রান তিনি সহজেই করতে পারতেন। তাঁর এ রান করার অসীম ক্ষমতাকে স্মরণে রেখে তাঁকে ব্র্যাডম্যানের থেকেও অনেকে শক্তিশালী ব্যাটস্ম্যান মনে করেন।
৫.
ক্রিকেট নিয়ে অনেক কৌতুকের ভিড়ে একটি হচ্ছে এরকম -
ইংল্যান্ডের এক নামকরা ব্যাটস্ম্যান এক প্রীতি ম্যাচ খেলতে এসেছেন। সে ম্যাচে ব্যাটিং এর জন্য মাঠে আসার পরপরই তিনি বোল্ড হয়ে যান কোন রান না করেই। বোলার এমন মূল্যবান উইকেট পেয়ে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠে, দলের সকলের সাথে আনন্দ শেয়ার করতে থাকে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে যে আউট হওয়া ব্যাটস্ম্যানটি তাঁর ছিন্ন ভিন্ন হওয়া উইকেট তিনটি ঠিক করে আবার ব্যাটিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বোলার অবাক হয়ে এমন অদ্ভূত কান্ডের জন্য তাঁকে প্রশ্ন করলে ব্যাটস্ম্যানটি বলেন, "“গ্যালারিতে বসা মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছ? এরা সব গাঁটের পয়সা খরচ করে এখানে এসেছে আমার ব্যাটিং দেখবে বলে, তোমার বোলিং দেখবে বলে না! যাও, আবার বোলিং কর!"”
ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সময় যিনি সবচাইতে বেশি বিখ্যাত ছিলেন এবং ক্রিকেটকে একটি মানসম্মত আন্তর্জাতিক খেলায় রূপান্তরিত করতে যার অবদান সবচাইতে বেশি, তিনি হচ্ছেন ‘ক্রিকেটের অমর বুড়ো’ খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস। পেশায় ডাক্তার ছিলেন এই ভদ্রলোক, কিন্তু ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটীয় পরিবেশে বড় হবার কারণে সখ হিসেবে বেছে নেন ক্রিকেটকেই। প্রথম দিকে তিনি তাঁর বড় ভাই ই এম গ্রেসের বদলি হিসেবে বিভিন্ন দলে খেললেও প্রতিভার জোরে দলে স্থায়ি হতে তাঁর তেমন সমস্যা হয়নি। অবশ্য তিনি "“ক্রিকেটাররা কখনো জন্মায় না' -”– এমন মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি প্রতিভার উপর আস্থা না রেখে প্র্যাকটিসের উপর জোর দিয়েছিলেন যার সুযোগ তিনি ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত পেতেন।
ই এম গ্রেস বড় ব্যাটে খেলত বিধায় ষ্ট্রেট শট খেলতে পারত না। তাই গ্রেস ভাইদের কোচ ডব্লিউকে ছোট ব্যাট তৈরি করে দিয়েছিলেন যাতে তিনি বড় ভাইয়ের দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন। পরবর্তীতে তিনি এই শটটি খুব ভালো খেলতে পারতেন। তাই তাঁদের মা মার্থা একবার এক বিখ্যাত খেলোয়াড়কে তার এই ছেলে সম্পর্কে লেখেন -
“I am writing to ask you to consider the inclusion of my son, EM Grace – a splendid hitter and most excellent catch – in your England XI. I am sure he would play very well and do the team much credit. It may interest you to learn that I have another son, now twelve years of age, who will in time be a much better player than his brother because his back stroke is sounder, and he always plays with a straight bat.”
১৮৮০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি জাতীয় দলের পক্ষে প্রথম টেষ্ট খেলার সুযোগ পান। প্রথম সুযোগেই তিনি ১৫২ রানের একটা চমৎকার ইনিংস খেলেন। প্রথমেই সেঞ্চুরী করলেও তিনি কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ারে আর মাত্র একটি সেঞ্চুরী করতে পেরেছিলেন, যেটি ছিল সে সময়কার ইংল্যান্ডের ব্যাটস্ম্যানদের পক্ষে সর্বোচ্চ; ১৭০ রান।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি রানের বন্যা বইয়ে দিতেন প্রায়ই। যার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ১২৪টি সেঞ্চুরীর এক অবিশ্বাস্য রেকর্ডের কথা। শুধু মাত্র ব্যাটিং - ই নয়, তিনি হাত ঘুরাতেও ওস্তাদ ছিলেন। তাই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১২৪৮৩১টি ডেলিভারি করে উইকেট তুলে নিয়েছেন ২৮০৯টি, যার মধ্যে আছে ৬৪ বার ১০ উইকেটের প্রাপ্তি!
ক্রিকেটের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অনেক বেশি। তাই জাতীয় দলের হয়ে তিনি ৫০ বছর বয়সেও ব্যাটিং করেছেন, ৬৬ বছর বয়সেও ঘড়োয়া ক্রিকেট খেলেছেন। তবে বর্তমানে ‘ব্যাটস্ম্যানশিপ’ বলতে আসলে যা বোঝায়, তার প্রবর্তন হয় এই চ্যাম্পিয়ানের মাধ্যমেই। ক্রিকেটে তাঁর আগমনের আগে ব্যাটস্ম্যানরা সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট শট খেলে থাকত। গ্রেস এসে এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেন। তাই তাঁকে বলা হয় ‘The bible of batsmanship’।
১৯১৫ সালের ২৩ অক্টোবর সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ‘পারফেক্ট’ ব্যাটস্ম্যান এবং আমাদের উপরোক্ত কৌতুকের নায়কটি হার্ট অ্যাটাকের ফলে মারা যান। তাঁর এই “'ডব্লিউ জি গ্রেস'” নামটিকে অবলম্বন করে তাঁরই বড় ছেলে কিছুদিন ক্রিকেট খেলে, কিন্তু বাবার কীর্তির ধারে কাছেও সে যেতে পারেনি। তাই ১৮৯৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে আবির্ভূত হয়ে ১৯০৩ সালে বিদায় নেয় ছেলে, যখনও বাবা দাপটের সাথে ক্রিকেট খেলে চলেছে!
ছবিসমূহের ক্যাপশান::
১. ২০০৫ সালে সংঘটিত সাউথ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেষ্টের এক মুহূর্ত
২. প্রথম টেষ্ট খেলা অষ্ট্রেলিয়া দল
৩. প্রথম টেষ্ট খেলা ইংল্যান্ড দল
৪. চার্লস ব্যানারম্যান
৫. Ashes এর সূচনা ঘটা সেই বিখ্যাত টেষ্টটি
৬. ‘দ্য ডেমন’ এফ আর স্পফোর্থ
৭. The sporting time এর পাবলিশ করা বিখ্যাত পেপারটি
৮. রঞ্জি ও সি বি ফ্রাই –- ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের দুই সৈনিক
৯. ভিক্টর ট্রাম্পার
১০. ডব্লিউ জি গ্রেস
১১. ডব্লিউ জি গ্রেসের ব্যাট নিয়ে আঁকা একটি কার্টুন
১২. গ্রেসের অভিষেক হওয়া টেষ্টের আগ মুহূর্তে তোলা ছবি
১৩. ১৮৯৯ সালের ইংল্যান্ড জাতীয় দলের একটি গ্রুপ ফটো; এই টেষ্টেই গ্রেস অবসর নেন জাতীয় দল থেকে
১৪. গ্রেসের প্রিয় ব্যাটটি; ২০০৯ সালের ১২ মে এটি নিলামে তোলা হয়েছিল
ছবি সংগ্রহে : ক্রিকইনফো, উইকিপিডিয়া ও গুগল ইমেজ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৫৩