মুখ ও মুখোশ ম্যাগাজিনের জন্য লেখা
[http://mukhomukhoshmag.com/2014/03/15/nebraska/]
নেব্রাস্কা সিনেমাটা নিয়ে কথা বলতে একটা কথাই বলতে হয় তা হল “জীবন বুঝি এমনই ”।
সিনেমাটাতে আসলে কি আছে? এর উত্তরে আসতে পারে ব্রুস ডার্ণ আর জুন স্কুইবের অসাধারণ ডুয়ো অভিনয়, চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি সাথে অসাধারন মিউজিক। দিনশেষে নেব্রাস্কার মূল অস্ত্র হলো তার সরলরৈখিক কাহিনী। সিনেমার গল্পে দর্শক টানার তথাকথিতঃ মশলা বলতে গেলে নেই। নাই কোন রগরগে সেক্স, নাই কোনো ধুমধাম অ্যাকশন দৃশ্য, নাই সুপার টুইস্ট, নাই গ্যাং ভায়োলেন্স, নাই ইনসেপশনের মতো কোনো কম্পলেক্সিটি, নাই আল পাচিনোর কিংবা ডিক্যাপ্রিওর ভাষণ,নাই গ্ল্যামারাস নায়িকা,নাই কোন হেভি কমেডি।
নেব্রাস্কায় তবে কি আছে?
নেব্রাস্কা ছবির শুরুতেই কেমন যেনো ধাক্কা লাগে। সাদাকালোয় ধারন করা দৃশ্যপট। ছবির মূল চরিত্র উডি (ব্রুস ডার্ণ) হেঁটে চলছেন রাস্তা ধরে। সাদাকালোয় যা অসাধারন লাগে। এরকম অসাধারন সব দৃশ্য দিয়ে পুরো সিনেমা সাজিয়েছেন ডিরেক্টর আলেক্সান্ডার পেইন ও সিনেমাটোগ্রাফার ফেডন পাপা মাইকেল। সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন বব নেলসন। অনেক আগেই সিনেমার কাজ হওয়ার কথা ছিল তবে ডিরেক্টর আলেক্সান্ডার পেইন তখন Sideways সবে রিলিজ দিয়েছেন। পরপর দুইটি একই ধারার ছবি তিনি বানাতে চাননি। দুটো ছবিই ছিলো ভ্রমন নিয়ে।
imagesসিনেমার কাহিনী সংক্ষেপে বলতে গেলে দাঁড়ায়, মূল চরিত্র উডি একজন বৃদ্ধ, তার স্ত্রী কেটের (জুন স্কুইব) সাথে থাকে। উডি একদিন একটি মেইল পায় যাতে লেখা প্রাপক ১ মিলিয়ন ডলার জিতেছেন। শুধু নাম্বারটা গিয়ে অফিসে ম্যাচ করাতে হবে। কিন্তু উডির ছোট ছেলে ডেভিড (উইলফোর্ট) বুঝতে পারে এই মেইলটা স্রেফ ম্যাগাজিন বিক্রেতাদের ধান্ধাবাজি। যাতে বিভিন্ন ম্যাগাজিন এর সাবস্ক্রিপশন নেয় মানুষ। উডি এত কিছু বুঝে না, তাই বারবার হাঁটা ধরে, সম্পূর্ণ আরেক স্টেটে যেয়ে এই পুরস্কার আনার জন্য। উডির বড় ছেলে রস (বব ওডেনকার্ক) টিভিতে খবর পড়ে। বাবার অবস্থা দেখে সে ইচ্ছে পোষণ করে বাবাকে ওল্ডহোমে দিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাবার এই অবস্থা দেখে ডেভিড ঠিক করে মেইলে দেওয়া ঠিকানাতে বাবাকে নিয়ে যাবে। তারপর বাবা-ছেলে রওনা দেয়, পুরস্কার সংগ্রহের জন্য। পথে উডি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডেভিড ঠিক করে পৈতৃক ভিটায় ফিরে যাওয়ার যেখানে তাদের আত্মীয় স্বজনরা সবাই থাকে। সে তার মা আর বড়ভাইকেও চলে আসতে বলে ওখানে। ছোটখাট একটা ফ্যামিলি রিইউনিয়ন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সবাই চলে আসে। ওই দিকে উডি সবাইকে জানায় তার ১মিলিয়ন ডলারের কথা। আত্মীয় স্বজনরা সবাই তার টাকা নিয়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এভাবেই কাহিনী এগিয়ে যায়।
সিনেমার কাহিনী খুবই সহজ ও সাবলীল গতিতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। যার শেষটা হয় মধুর এক সমাপ্তি দিয়ে। সিনেমার সংলাপগুলো সহজ, সাধারন হাস্যরসে ভরা। সহজ সরল গল্পে গতিশীলতা আনার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল এই ধরনের সংলাপের। এই সহজ সরল গল্পটা আমাদের জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থ ও উদ্দেশ্য সফলভাবে তুলে ধরেছে ভিন্ন ধরনের হাস্যরসের মাধ্যমে। মনে হবে, পরিচালক আলেক্সান্ডার পেইন যেনো জীবনদর্শনের লেন্স তার ক্যামেরায় লাগিয়েছেন। এই সিনেমার স্বার্থকতাও এখানে। জীবনে সৎ ভাবে বেঁচে থেকে, পরিবারকে সময় দিয়ে, মৃত্যুর আগে সন্তানদের জন্য কিছু রেখে যাওয়ার যে আকুতি উডির মাঝে দেখা যায় তা আলেক্সান্ডার পেইনের পরিচালনা ও পাপা মাইকেলের অসামান্য সিনেমাটোগ্রাফিতে এত চমৎকার ভাবে ধরা পড়েছে, দর্শক নিজেও বুঁদ হয়ে জীবনকে য়েন নতুন ভাবে ভাবতে শুরু করবে। ব্রুস ডার্ণ, জুন স্কুইব, উইলফোর্ট, স্টেসি কিচ এদের সবার কাছ থেকে চমৎকার অভিনয় বের করে আনার জন্য আলেক্সান্ডার পেইনের হাততালিটা বরাদ্দ। এর আগেও About Schmidt (2002), Sideways (2004), The Descendants (2011) -এ তিনি চরিত্রদের জীবনদর্শন সহজভাবে বিশ্লেষন করেছেন, তবে নেব্রাস্কায় যেনো সেটাকে ছাড়িয়ে গেলেন বহুদূর।
images.1jpgব্রুস ডার্ণ এই ছবির জন্য জিতে নিয়েছেন কান উৎসবের সেরা অভিনেতার পুরষ্কার আর জুন স্কুইব অস্কারের সেরাপার্শ্বঅভিনেত্রীর জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন।ব্রুস ডার্ণের চরিত্রটির না ছিল বিশাল বিশাল মনোলগ অথবা ভাষন, শুধু ছিল নাম্ব হতবিব্হল এক্সপ্রেশন। চরিত্রের সাথে মিশে গিয়ে এভাবে অভিনয় করে তিনি আবারো নতুন করে প্রমাণ করলেন অভিনয়ে অভিব্যক্তি, চরিত্রের প্রয়োজনে শারীরিক পরিবর্তন ও মুখভংগির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জুন স্কুইব ছিলেন প্রাণবন্ত আর এককথায় অসাধারন। বয়স্কা স্ত্রীর রাগ-বিরক্তি মিশ্রিত ভালোবাসা জুন স্কুইবের প্রতিটা এক্সপ্রেশন ফুটে উঠছিল। ছেলের ভূমিকায় স্যাটারডে নাইট লাইভের ম্যাক গ্রুবার খ্যাত উইলফোর্ট ছিলেন বেশ ভালো। উডির পুরনো বন্ধু, সেই সাথে সিনেমার খলচরিত্রদের একজনের অভিনয়ে স্টেসি কিচ যতক্ষন পর্দায় ছিলেন সবাইকে মাতিয়ে গিয়েছেন। সবাই মিলে সিনেমাটিকে শৈল্পিকভাবে উন্নততর করেছেন।
জীবনের গল্পই আছে এই সিনেমাতে। এই জ়ীবনের গল্পকে সাদাকালো পর্দায় শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য সিনেমাটোগ্রাফার পাপা মাইকেল কৃতিত্ব দেওয়া দরকার। আমেরিকান গ্রাম ও উপশহর অঞ্চলগুলো যে কতটা সুন্দর তা এই সিনেমাতে আমরা ভালোমতই দেখতে পাই। পাপা মাইকেলের দৃশ্যায়ন ছিল অসাধারন। বাবা ছেলের ভ্রমন এর সময় আশপাশের মাঠ,ফসলের ক্ষেত সাদা-কালোতেও এতোটা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার যা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদাকালোতে করার সিদ্ধান্তটাও ছিলো বেশ সাহসী। সাদামাটা একটা গল্পকে অন্যরকম আবহতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকটাই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো এই সাদাকালো রঙের ব্যবহার। আবহ সৃষ্টিতে সবসময় আরো একটি ব্যাপার প্রভাবক হিসেবে থাকে তাহলো সংগীত। হোক সে আবহ সংগীত হোক সে গান। নেব্রাস্কার সংগীতে ব্যবহার করা হয়েছে আমেরিকান ফোক মিউজিক। মার্ক ওর্টনের সাউন্ডট্র্যাকগুলো ছিল অসাধারন মানের। সিনেমার সাথে প্রচন্ডভাবে মানিয়ে গিয়েছে। খুবই সাধারন কিন্তু মনগ্রাহী কিছু সুর।
সবমিলিয়ে জীবনদর্শন ও জীবনবোধের মহাকাব্য বলা হয়তো ঠিক হবেনা, গল্প বলাটাই সর্বসম্মতিক্রমে সঠিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ২০১৪ এর একাডেমী আ্যওয়ার্ডে ৬টি নমিনেশন পেয়ে একটিও না জেতার কারণ ও ঠিক একই। এতটা সাদামাটা কাহিনীর বাস্তবসম্মত ছবিকে তারা আসলে পুরষ্কার দেওয়ার ঝুকি নিতে চায়নি। জীবনবোধের দর্শনের এরকম বাস্তবসম্মত প্রকাশ হয়তো আ্যওয়ার্ড কমিটির কাছে যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তাই বলে,পুরস্কারের ঝুলিটা মোটেও খালি নয় নেব্রাস্কার। ব্রুস ডার্ণ কান উৎসবের সেরা অভিনেতার পুরষ্কার জিতে এসেছেন। এছাড়াও নেব্রাস্কা ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্পিরিট আ্যওয়ার্ড এ সাফল্যের মুখ দেখেছে , আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ২০১৩ এর সেরা সিনেমার লিস্টেও আছে নেব্রাস্কার নাম।
বাস্তবসম্মত চিত্রনাট্য,চমতকার অভিনয়,প্রাণবন্ত সিনেমাটোগ্রাফি এবং অসাধারন পরিচালনা মিলিয়ে নেব্রাস্কা শুধু সিনেমা হিসেবে নয় জীবন বোধের অসাধারন এক চিত্রকল্প হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে।