ছোটবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙুক্লাবের হর্তাকর্তা ছিলাম, পোলাপান উড়োজাহাজে আইসা অফলোড হইলে ফোর্ড ফিয়েস্তাতে মানুষ ও তাহাদের স্যুটকেস উঠাইয়া ক্যাম্পাসে আইনা ফিট কইরা দিতাম। ক্লাস, বাসা, কাজ - এই তিন জিনিস ঠিক করার পরে পোলাপানরে দিয়া দেশে ফুন দেওয়াইতাম, " জ্বী আম্মা ভাল আছি, আপনের লাইগা পেট পুড়ে"।
তখন ইস্কুলে বাঙালীর জয়জয়কার, পারলে সরকারীভাবে নামডারে পাল্টাইয়া "ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ" বানাইয়া দেই। হরেদমে পোলাপান আসে প্রতি সেমিস্টারে, বেশিরভাগ ঢাকার ঝাল খাওয়া পোলাপান, তয় মাঝে সাঝে পুরা মফস্বল থেইকাও দু' একটা ইস্পিশাল স্মার্ট পোলপান আইসা পড়তো। এরকম এক পোলা আইলো, বাড়ির বড় পোলা, বাপে জায়গা-জমি বেইচা আম্রিকা পাঠাইছে। পোলাও বেশ বুঝদার, প্রতি জুম্মায় রেগুলার জামাতে যায়, হেরপরে মাথায় টুপি দিয়াই ক্লাস করতে যায়। দেখা হইলে আদব সালাম পাই।
একদিন স্কুলের ফরেন ইস্টুডেন্ট অফিসের সামনে দিয়া যাইতেছি, আমারে একজন ডাক দিলো। গিয়া দেখি ভিতরে একটা কাগজ নিয়ে বিশাল গবেষনা চলতাছে, কে জানি অফিসে একটা ফ্যাক্স করেছে, কিন্তু ভাষাডা ইংরেজী না, সো কেহই বুঝতাছে না ঝামেলাডা কার মাথায় দিবো। কাগজটা হাতে নিতেই বুঝলাম বাংলায় লেখা, হাতে লেখা চিঠি একটা, যেই পোলার কথা কইলাম, ওর বাপে পাঠাইছে, নাম-ধাম লিখছে ইংরেজীতে, তয় ডাকনাম লিখছে দেইখা কেউ বুঝতে পারে নাই কার জন্য এই পত্র। জানি অন্যের চিঠি পড়তে নাই, তয় সোশ্যাল সার্ভিস করার জন্য পড়ে দেখলাম। মোটামুটি টিপিক্যাল পোলার কাছে উপদেশ দিয়া বাবার চিঠি, মা তোরে ছাড়া অসুস্থ, বোনের পরীক্ষা চলতাছে, বাড়ীর গাই দুধ দিতাছে ঠিকমতো, পড়াশুনা করিস, শরীরের যত্ন নিস এসব লেখা। তবে যে জিনিসটা ফট করে চোখে পড়লো, সেটা এখনও মনে আছে। বাবা লিখেছে পোলারে, "তুমি বিদেশীদের থেকে সাবধানে থাকবা, মনে রাইখো তারা খুব সেক্সী"।
তখন আমার প্রত্যেকদিন ক্লাবে যাইয়া লাফঝাপ করার বয়স, এই পত্র পইড়া বেশ হাসি পাইছিলো, পোলাডারে পত্রডা সরবরাহ করার আগে ইয়ারদুস্তগো লগে এক্টু হাসাহাসিও করছিলাম। তয় ১৬ বছর পরে এখন সেই কথা স্মরণ কইরা লজ্জা লাগে। যে পোলারে নিয়া এত কান্ড, বেচারা বাপের উপদেশ বেশিদিন মনে রাখে নাই। আস্তে আস্তে জুম্মা কাজা দিয়া সে ফ্রাইডে নাইটে ক্লাবে যাওয়া শুরু করেছিলো, সেক্সী বিদেশীও জুটছিলো মনে হয় দু'একজন, কারণ বিয়াও করছিলো বিদেশী একজনরে, এখন ডিভোর্স্ড। বাপ মইরা গেছে, এখন তাই তার কামাই দিয়া দেশের পরিবারের খাওয়া-পড়া চলে। জীবনে সে করছে বহুত কিছুই, তয় বাপের সেই বিদেশীদের থেইকা সাবধান থাকার কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারে নাই।
সেদিন এই গানটা শুনতেছিলাম,
জীবনে যে কত লোকসান বুঝলি না মনা
দিলি চিড়ার দামে হীরা-কাঞ্চন, কাঁচের বিনিময়ে সোনা
এই পোলার মতো আমিও বাপের কথা না শুইনা বহুৎ তাফালিং মারছি। নেশায় টং হইয়া ইন্টারস্টেটে গাড়ি হাকাইছি, উল্টাপাল্টা জিনিষের জন্য ক্রেডিট কার্ড ম্যাক্স আউট করছি, সুন্দরী রমনীর সাথে নির্ঘুম একরাত্রি যাপনের জন্য টার্ম ফাইনালে ডাব্বা মারছি, তালিকা দিলে শেষ করা যাইবো না। তয় দিনের শেষে মাঝবয়সে আইসা মনে হয়, আহারে, বুইড়া বাপের কথাডা যদি এক্টু শুনতাম, আজকে ফলাফলটা অন্যরকম হইতো।
আজকাল আমার পোলারেও আমি ভুরি ভুরি উপদেশ দেই। বেশিরভাগই পিচ্চিদের উপযুক্ত উপদেশ, স্কুলে গেলে ঠিকমত খেলার মাঠে খেলবা, হিসু করতে গেলে টয়লেটে ঠিকমত তাক করবা, ক্লাসের মেয়েরা ফাজলামী করলে টিচারের কাছে নালিশ দিবা ইত্যাদি। কিছু কিছু জিনিষ সে মানে, বাকিটা তার চার বচ্ছরের কান দিয়া ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া ফালাইয়া দেয়। এই বয়সেই সে টাংকি মারতে উস্তাদ, কয়দিন আগে ক্লাসের কোন মাইয়া তার রূপেগুণে মুগ্ধ হইয়া পাজামা-পার্টি'র প্রস্তাব দিছে
এই পোলা বড় হইয়া যেদিন ইউনিভার্সিটি যাবে, ঘরের বাইরে পা রাইখা বাইরের পৃথিবীরে আকড়ায় ধরবে, আমি হয়তো পিছের থেইকা সেই বাঙাল ক্ষ্যাত বাপের মত কমু, "বাবা, সাবধানে থাকবা, বিদেশীরা বড়ই সেক্সী"। আমার কথা সেদিন সে শুনবো কি শুনবো না, উপরওয়ালা জানে। খালি প্রার্থনা করি, সে যাতে ভাল থাকে, জগতে দুঃখগুলা যাতে তারে স্পর্শ না করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:১৭