সবুজের সমারোহ, পাখির কিচিরমিচির আর নদী-খাল-বিলের টলটল জলের পরশলাগা এক গ্রামে জন্ম আমার। ছবির মতো সেই গ্রাম। এখনও গাড়ীর কালো ধোঁয়া গ্রামের সবুজ পাতাকে ধূসর করতে পারেনি। এখনও গ্রামের সহজসরল মানুষের ভোরের ঘুম ভাঙে কাকের কর্কশ কা-কা ডাক শুনে। মানুষ স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নের বিস্তৃতি এই গ্রামকে ঘিরেই।
------- শুরুটা এভাবেই। পার্থ তালুকদার তার ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’ বইয়ের শুরুতেই আমাদের চোখের সামনে ছবি আঁকছেন এক অপরূপ গ্রামের। যেখানে তার জন্ম। যেখানে তার বেড়ে ওঠা। আর যেখানে মানুষেরা স্বপ্ন দেখে নিজ গ্রামকে ঘিরে। যে গ্রামের শিশুরা মা-মাসীদের কোলে বসে ধামাইল গান শোনে আনমনে। যেখানে বিয়ে বাড়িতে ধামাইল গান শুনে শ্রোতাদের রাত ভোর হয়। আকুল হয় হৃদয়। ভালোলাগায়, তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মন। কিন্তু এই ধামাইল গান কী? কখন গাওয়া হয়? কারা গায়? কী নিয়ে এই গান রচিত?
এসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর পার্থ তালুকদারের বই ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’
পার্থ তালুকদার তার বইটিতে লিখেছেন, সাধারণত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যেমন ঝুলন যাত্রা, রাস যাত্রা, হোলি, শিশুদের অন্নপ্রাসন, সাধভক্ষণ, গৃহপ্রবেশ, সূর্যব্রত ইত্যাদিতে ধামাইল গানের প্রচলন থাকলেও হিন্দু সম্প্রদয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গানের আধিক্য বেশি। বিশেষ করে বিয়ের আগের রাত অর্থাৎ অধিবাসের রাতে ধামাইল গানের প্রচলন বেশ লক্ষণীয়। এই গানগুলো সাধারণত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নির্ভর হয়ে থাকে। যদিও বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন ধরনের অসংগতি তুলে ধরে লেখকগণ অনেক গান রচনা করেছেন।
তার লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি, ধামাইল গানের জগত সম্পর্কে। জানতে পারি রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহনির্ভর এই গানের পেছনে জড়িয়ে আছে কতো কতো নাম, কতো মমতা, ভালোবাসা। ধামাইল গানের ভাব ও বৈচিত্রের উপর ভিত্তি করে বইটি অনেকগুলো ছোট ছোট অধ্যায়ে বিভক্ত। যেমন-
শুরুর কথা---প্রার্থনা---আসর---গৌররুপ---শ্যামরুপ---বিচ্ছেদ---বাঁশি---কোকিল সংবাদ---দূতী সংবাদ---স্বপন---অভিসার---জলভরা---জামাইস্নান---খেদ---সাক্ষাত খেদ---মান ভঞ্জন---প্রভাতী খেদ---চন্দ্রার কুঞ্জ---মিলন---বিদায়---আউট গান।
আমরা বইটি থেকে জানতে পারি যে, ধামাইল গান মূলত সিলেট অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয় হলেও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ বিশেষ করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকটি উপজেলায় এই গানের প্রচলন লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচরে ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে।
আর একটি মজার তথ্য হলো এই গানে ঢোল ছাড়া তেমন কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় না। গুরুবন্দনা বা প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় ধামাইল গানের আসর। এরপর রাঁধা-কৃষ্ণের প্রেম বিরহের বিভিন্ন অবস্থা ও অনুভূতিকে অবলম্বন করে একে একে গান পরিবেশন করা হয় ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত। বিভিন্ন শিল্পী ও গীতিকার তাদের নিজেদের লেখা ধামাইল গানও পরিবেশন করেন। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকেন সেসব আন্তরিক গান শ্রবণে।
আমি ডাকি কাতরে,
উদয় হওরে দীনবন্ধু, হৃদয় মন্দিরে
তোমার ভক্তের সঙ্গে প্রেম তরঙ্গে করুণা কইরে।।
---------- ভাবুককবি রাধারমণ
প্রথমে বন্দনা করি গুরুপদ স্মরি
গুরুতো মনুষ্য নয় গো প্রকাশ গোলক হরি।।
অখণ্ড মন্ডালাকার যিনি জগত ভরি।
তাহাঁর পদ দেখান গুরু তাকে প্রণাম করি
----------- কাশীনাথ তালুকদার
‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান' বইটির একটি অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে – এতে যেমন অসংখ্য শিল্পীর রচিত ধামাইল গান উল্লেখিত হয়েছে তেমনই সেসব স্বল্পপরিচিত প্রচারবিমুখ শিল্পীদের সম্পর্কেও গল্পের ভঙ্গিতে কথাচ্ছলে বেশ অনেক তথ্যই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন প্রিয় পার্থ তালুকদার।
শ্রদ্ধেয় কাশীনাথ তালুকদার, সুনীলচন্দ্র দাশ, লেখক স্বপন কুমার, দ্বীজেন্দ্র দাশ তালুকদার, আশীষ দেব, লেখক রবীন্দ্র, ধামাইলপ্রেমিক প্রতাপরঞ্জন, শরতচন্দ্র দাস, রামজয় দাশ, প্রবীর দেবনাথ, শিখা রাণী দাশ, আবদুর রহমান, আব্দুল আজিজ, অরুণ বাবু, ফকির শিতালং শাহ, শ্রী অধরচান্দ, হরিপদ চন্দ, সুজিত কুমার চৌধুরী, মহেন্দ্র বাবু, রামজীবন, কাঙাল দয়ানন্দ, আরকুম শাহ, বাউল সম্রাট আবদুল করিম, রাধারমণসহ আরো অনেক চেনাজানা-অচেনা-অজানা শিল্পীর হৃদয়ছোয়া ধামাইল গান বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেগুলো পাঠে আমাদের মন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে। আর আমরা ডুবে যাই বাংলার এক অসাধারণ ঐতিহ্যবাহী গানের জগতে।
তবে ধামাইল শিল্পীরা স্বভাবতই প্রচারবিমুখ। তারা নিভৃতে থাকতেই ভালবাসেন। প্রচারবিমুখ ধামাইল শিল্পীদের সম্পর্কে পার্থ তালুকদার বলেছেন, আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, অধিকাংশ গীতিকারের প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ কোনো ডিগ্রী না থাকলেও শুধু মনের টানে ও সাধনার মাধ্যমে পল্লীতে বসেই আমাদের প্রাণোপ্রিয় এই ধামাইল গানগুলো সযতনে রচনা করেছেন। যা গ্রামের কাদামাখা দুষ্টু ছেলে কিংবা সাধু জনেরাও তাদের মনের অজান্তেই গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন।
কোকিল কইও গো কইও গো বন্ধেরে
তার লাগিয়ে বিষম জ্বালা,
আমার অন্তরে।।
মনে থাকে মনের কথা
বুকটা জুড়ে প্রেমের ব্যথা গো
আমার হৃদয় পুড়ে পিরীতেরও জ্বরে
আসো বন্ধু শেষবারে, দেখি নয়ন ভরে ।।
--------- সঞ্জয়নাথ সঞ্জু
রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনীকে উপজীব্য করে রচিত এই ধামাইল গান বহুবছর ধরে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাঙালির প্রাণ। বাঙালির ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে চুনিপান্নার মত জ্যোতিতে উজ্জ্বল এই গানগুলো। আধুনিক ব্যস্ত সময়েও তাই গানগুলোর আবেদন ফিকে হয়ে পড়ে না। বরং আমরা নাগরিক ব্যস্ততার অবসরে এ গানের সুরে মনকে ভাসিয়ে নিতে পারি অনায়াসেই। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এই গানকে ছড়িয়ে দেবার ও আনুসাংগিক কিছু তথ্য দেবার প্রয়াস থেকেই পার্থ তালুকদার লিখেছেন তার এই গবেষণাধর্মী অনন্য বই ‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’।
বইটি সম্পর্কে –
নাম: ঐতিহ্যের ধামাইল গান
লেখক:পার্থ তালুকদার
প্রচ্ছদ: মোবারক হোসেন লিটন
প্রকাশনী: রোদেলা প্রকাশনী
মূল্য: ১৫০ টাকা
যেখানে পাওয়া যাবে –
‘ঐতিহ্যের ধামাইল গান’ বইটি একুশে বইমেলায় ‘রোদেলা প্রকাশনী’র স্টলে পাওয়া যাবে।
পরবর্তীতে বিভিন্ন জেলাশহরের বইয়ের দোকানে পাওয়া যাবে।
এছাড়াও সরাসরি লেখক পার্থ তালুকদার এর সাথে যোগাযোগ করা যাবে।
লেখকের মোবাইল নং – ০১৯১৯৮৮৬২২২
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৬