আজ (২২.১০.২০০৮, একটু দেরী হল পোষ্ট দিতে) স্তন ক্যানসার এর জন্য উৎসর্গ জানা ছিলনা। ব্লগে না বসলে হয়ত জানতামওনা। সা ইন ব্লগকে অনেক ধন্যবাদ।
আমার মা, ডাক নাম রেনু । অগ্রনী ব্যাংকে প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ছিলেন। পেশাগত ব্যস্ততায় তাঁকে কখনও মলিন মুখে দেখিনি। সব সময় হাসি মাখা এক মা আমার। মায়ের তিন সন্তানের মাঝে আমি ছিলাম একমাত্র ও কনিষ্ঠ পুত্র। মা বোনের আদরের ভাগটাও তাই সবসময় একটু বেশীই ছিল।
সংসারে সুখের কমতি ছিলনা। সবসময় আনন্দের মাঝে দিন যাপন।
১৯৯৫ সাল। ১৯৯৪ এর ব্যাচে জশাহী কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাশ করে তখন ভর্তির প্রস্তুতি। চোখে অনেক স্বপ্ন। মায়ের ইচ্ছা ছেলে ডাক্তার হবে, বাবার ইচ্ছা আমি ইংরেজী সাহিত্যে পড়ি। শেষে বাবার ইচ্ছা পূরণ হল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই (বাবার এক ছেলে হবার কারনে, রাজশাহীর বাইরে কোথাও এ্যাডমিশান টেষ্ট দিতে পারিনি)
ভীষন খুশির খবরটা মা'ফোন করে জানাই। বিকেলে মা অফিস থেকে বাসায় এসে বলেন, শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মা ১৯৬৮ সাল থেকে কখনও রোগে ভুগে শয্যাশায়ী হননি। এমনিতে ভীষন ডিসিপ্লিন্ড মানুষ ছিলেন। আর আমরা মা কে খুব মিস করতাম। কারন সারাদিন অফিস করে এসেও তাঁর শান্তি নেই। এমন একদিন যায়না যেদিন বাসায় মেহমান থাকেনা আর মা তাঁদের সময় দেননা। সপ্তাহে ঐ এক ছুটির দিন বাদে মা'কে কখনও পাইনা আমরা; তাও যদি দয়া করে কোন মেহমান না আসেন, বা মা এর কোথাও এ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকে তো। তাই বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, আম্মার কখনও হালকা রোগে শোকে ছুটি নিলে আমাদের আনন্দ দেখে কে! এবারও তাই হল। আমরা তিন ভাইবোন খুশি কারন মা ছুটি নিয়েছেন।
কিন্তু মায়ের জ্বর আর সারেনা। আল্ট্রাসনো করা হল। রিপোর্ট এল গলব্লাডারে পাথর। ছোট্ট একটা অপারেশন, ব্যস্।বাসার সবার সিদ্ধান্তে রাজশাহীর বিখ্যাত ডাঃ গোলাম মওলার কাছে অপারেশান করা হল। ডাক্তার ওপেন করেই সাথে সাথে বন্ধ করে দেন, গলব্লাডার আর ফেলেন না। আম্মার লিভার সিরোসিস। অনেক আগেই ছড়িয়ে গেছে পুরো লিভারে, আমার মা আর কয়েক মাসের মেহমান।!!
সময়টা ছিল ১৯৯৫ এর অক্টোবর মাস। আমরা তিন ভাই বোন কিছু জানলামনা। আমরা জানলাম, মাএর অপারেশন হয়ে গেছে। রিলিজ পেলেই বাড়ী আসবে। কিন্তু বাসায় আসার পর জানলাম আর একটু ভাল চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে হবে। আমার বাবা ভীষন দূর্বল চিত্তের মানুষ। তিনি সাথে ঢাকা অব্দি গিয়ে ফিরে আসেন। বাবার সাথে আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড় বোন লাকী, বাসায় থাকি। বড় আপু, লুনা, যায় আম্মার সাথে।
চিকিৎসা চলতে থাকে। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হল আমার মা তাঁর ক্যানসারের কথা জানতেন! প্রেসক্রিপশান ও রিপোর্ট তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু কখনও ভেঙ্গে না পড়া মা আমার এবারও ভেঙ্গে পড়লেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি সুস্থ্য হবেন। বাসায় ফিরবেন। এমনকি বড় আপুকে দিয়ে অফিসের জন্য ব্যাগও কেনালেন ঢাকায়।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। মা কে ছেড়ে রাজশাহীতে রোজার ঈদ করলাম। কে জানতো, তার আগের বছরের কোরবানী ঈদ ছিল আমাদের সাথে তাঁর শেষ ঈদ! এর মধ্যে আমিও জেনেছি মা এর ক্যানসারের কথা। ঢাকায় একদিন বড় আপু আমাকে বললেন, "তুই কি জানিস, আম্মার কি হয়েছে?" খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিলাম, "হ্যা জানি, কিন্তু এও জানি তিনি ভাল হয়ে যাবেন।" আল্লাহর ওপর এত অগাধ বিশ্বাস ছিল যে তিনি কিছুতেই আমার মা কে নিয়ে যাবেন না এত দ্রুত। তাঁকে ঘিরে যে আমাদের অনেক স্বপ্ন!
মার্চের শেষের দিকে মা ফেরত আসলেন। ঢাকায় যে আমার মায়ের কত শুভাকাঙ্খি ছিল, বিদায়ের দিন তিনি জেনেছেন। পরে আমরা শুনি। রাজশাহী এয়ারপোর্টে মা কে যখন নামানো হল তখন হাঁটার শক্তিটাও তাঁর নেই। কেমো দিতে দিতে শেষ।
জলে ডোবা মানুষ যা পায় আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। এরপর শুরু হল কবিরাজী চিকিৎসা। নওগাঁর এক আধ্যাত্বিক কবিরাজের নাম শুনে সেখানে গেলাম। আশা , এবার মা ভাল হবেনই। তিনিও তাঁর সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই হলনা।
২রা এপ্রিল, ১৯৯৬, আর মাত্র ৬ দিন পরে আমার ২০ তম জন্মদিন। আমার মা মাত্র ৪৫ বৎসর তখন। সকালে বড় আপু বললেন, এখনই কবিরাজের কাছে যেতে। নওগাঁ, সে অনেক দুর। মোটর সাইকেল যোগে গেলাম সেখানে। কবিরাজ আর আশার কতা বললেন না। বাসায় ফিরে এলাম। সন্ধ্যার আগে নাগাদ তিনি বললেন তিনি চোখে কিছু দেখছেন না। সবাই কালেমা পড়তে লাগল। আমার মা আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলেন তখন। মা আমার কোলে মাথা দেয়া। মাগরিব হয় হয়। সবাই মাকে পানি খাওয়াবার চেষ্টা করল। আমি পানি দেবার সাথে সাথে মা আমার নাই...
ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজীউন পড়লাম। মায়ের মাথাটা বালিশে শুইয়ে বাইরে এসে খুব শান্ত গলায় বললাম, 'আব্বা, কোন চিন্তার কারন নাই, আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন।""
কি ভাবে অমন অদ্ভুত সহ্য ক্ষমতা পেয়েছিলাম জানিনা কিন্তু অনেক্সন চোখে জল আসেনি সেদিন। পরে যকন সম্বিত ফিরে পেলাম, বুঝলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদটা আজ হারিয়ে গেছে আমার। এমন এক সম্পদ, সারা দুনিয়া খুঁজে যা আর পাওয়া যাবেনা। আমার সমস্ত কিছুর বিনিময়েও ঐ মুখ আর দু'চোখ ভরে একবারের জন্যএ দেখতে পাবনা। সারা দুনিয়াতে কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে তাকে একবারের জন্যেও দেখতে পাবনা। এ এক এমন অনুভুতি যা ভাষায় বলে বোঝান সম্ভব না।
শুনেছি রমজান মাসে আত্মারা ছাড়া পায়, প্রিয় জনের আশেপাশে থাকে। তাই এই মাসটা আমার ভাল লাগে। আর যখন সবাই ঈদ মুবারক বলে শুভেচ্ছা দেয়, আমার চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।
দোই করি, তিনি যেন জান্নাতবাসি হন। পৃথিবীতে আমাদের জানামতে কাউকে কখনও কোন কটু কথা পর্যন্ত তিনি বলেন নি।
আজ ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। আরেক টা মা (আমার মেয়ে পূণ্য) আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তবু মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে আমার মায়ের জন্য হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।
দোআ করি, এই মরণ ব্যাধী যেন কোন সন্তানকে মা হারা না করে। আমীন।
(একটানা লিখেছি, বানান ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৫১