somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মমতাময়ী মা, যাকে আজীবন মিস করব।

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ (২২.১০.২০০৮, একটু দেরী হল পোষ্ট দিতে) স্তন ক্যানসার এর জন্য উৎসর্গ জানা ছিলনা। ব্লগে না বসলে হয়ত জানতামওনা। সা ইন ব্লগকে অনেক ধন্যবাদ।

আমার মা, ডাক নাম রেনু । অগ্রনী ব্যাংকে প্রিন্সিপ‌্যাল অফিসার ছিলেন। পেশাগত ব্যস্ততায় তাঁকে কখনও মলিন মুখে দেখিনি। সব সময় হাসি মাখা এক মা আমার। মায়ের তিন সন্তানের মাঝে আমি ছিলাম একমাত্র ও কনিষ্ঠ পুত্র। মা বোনের আদরের ভাগটাও তাই সবসময় একটু বেশীই ছিল।
সংসারে সুখের কমতি ছিলনা। সবসময় আনন্দের মাঝে দিন যাপন।

১৯৯৫ সাল। ১৯৯৪ এর ব্যাচে জশাহী কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাশ করে তখন ভর্তির প্রস্তুতি। চোখে অনেক স্বপ্ন। মায়ের ইচ্ছা ছেলে ডাক্তার হবে, বাবার ইচ্ছা আমি ইংরেজী সাহিত্যে পড়ি। শেষে বাবার ইচ্ছা পূরণ হল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই (বাবার এক ছেলে হবার কারনে, রাজশাহীর বাইরে কোথাও এ্যাডমিশান টেষ্ট দিতে পারিনি)

ভীষন খুশির খবরটা মা'ফোন করে জানাই। বিকেলে মা অফিস থেকে বাসায় এসে বলেন, শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মা ১৯৬৮ সাল থেকে কখনও রোগে ভুগে শয্যাশায়ী হননি। এমনিতে ভীষন ডিসিপ্লিন্ড মানুষ ছিলেন। আর আমরা মা কে খুব মিস করতাম। কারন সারাদিন অফিস করে এসেও তাঁর শান্তি নেই। এমন একদিন যায়না যেদিন বাসায় মেহমান থাকেনা আর মা তাঁদের সময় দেননা। সপ্তাহে ঐ এক ছুটির দিন বাদে মা'কে কখনও পাইনা আমরা; তাও যদি দয়া করে কোন মেহমান না আসেন, বা মা এর কোথাও এ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকে তো। তাই বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, আম্মার কখনও হালকা রোগে শোকে ছুটি নিলে আমাদের আনন্দ দেখে কে! এবারও তাই হল। আমরা তিন ভাইবোন খুশি কারন মা ছুটি নিয়েছেন।

কিন্তু মায়ের জ্বর আর সারেনা। আল্ট্রাসনো করা হল। রিপোর্ট এল গলব্লাডারে পাথর। ছোট্ট একটা অপারেশন, ব্যস্।বাসার সবার সিদ্ধান্তে রাজশাহীর বিখ্যাত ডাঃ গোলাম মওলার কাছে অপারেশান করা হল। ডাক্তার ওপেন করেই সাথে সাথে বন্ধ করে দেন, গলব্লাডার আর ফেলেন না। আম্মার লিভার সিরোসিস। অনেক আগেই ছড়িয়ে গেছে পুরো লিভারে, আমার মা আর কয়েক মাসের মেহমান।!!

সময়টা ছিল ১৯৯৫ এর অক্টোবর মাস। আমরা তিন ভাই বোন কিছু জানলামনা। আমরা জানলাম, মাএর অপারেশন হয়ে গেছে। রিলিজ পেলেই বাড়ী আসবে। কিন্তু বাসায় আসার পর জানলাম আর একটু ভাল চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে হবে। আমার বাবা ভীষন দূর্বল চিত্তের মানুষ। তিনি সাথে ঢাকা অব্দি গিয়ে ফিরে আসেন। বাবার সাথে আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড় বোন লাকী, বাসায় থাকি। বড় আপু, লুনা, যায় আম্মার সাথে।

চিকিৎসা চলতে থাকে। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হল আমার মা তাঁর ক্যানসারের কথা জানতেন! প্রেসক্রিপশান ও রিপোর্ট তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু কখনও ভেঙ্গে না পড়া মা আমার এবারও ভেঙ্গে পড়লেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি সুস্থ্য হবেন। বাসায় ফিরবেন। এমনকি বড় আপুকে দিয়ে অফিসের জন্য ব্যাগও কেনালেন ঢাকায়।

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। মা কে ছেড়ে রাজশাহীতে রোজার ঈদ করলাম। কে জানতো, তার আগের বছরের কোরবানী ঈদ ছিল আমাদের সাথে তাঁর শেষ ঈদ! এর মধ্যে আমিও জেনেছি মা এর ক্যানসারের কথা। ঢাকায় একদিন বড় আপু আমাকে বললেন, "তুই কি জানিস, আম্মার কি হয়েছে?" খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিলাম, "হ্যা জানি, কিন্তু এও জানি তিনি ভাল হয়ে যাবেন।" আল্লাহর ওপর এত অগাধ বিশ্বাস ছিল যে তিনি কিছুতেই আমার মা কে নিয়ে যাবেন না এত দ্রুত। তাঁকে ঘিরে যে আমাদের অনেক স্বপ্ন!

মার্চের শেষের দিকে মা ফেরত আসলেন। ঢাকায় যে আমার মায়ের কত শুভাকাঙ্খি ছিল, বিদায়ের দিন তিনি জেনেছেন। পরে আমরা শুনি। রাজশাহী এয়ারপোর্টে মা কে যখন নামানো হল তখন হাঁটার শক্তিটাও তাঁর নেই। কেমো দিতে দিতে শেষ।

জলে ডোবা মানুষ যা পায় আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। এরপর শুরু হল কবিরাজী চিকিৎসা। নওগাঁর এক আধ্যাত্বিক কবিরাজের নাম শুনে সেখানে গেলাম। আশা , এবার মা ভাল হবেনই। তিনিও তাঁর সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই হলনা।

২রা এপ্রিল, ১৯৯৬, আর মাত্র ৬ দিন পরে আমার ২০ তম জন্মদিন। আমার মা মাত্র ৪৫ বৎসর তখন। সকালে বড় আপু বললেন, এখনই কবিরাজের কাছে যেতে। নওগাঁ, সে অনেক দুর। মোটর সাইকেল যোগে গেলাম সেখানে। কবিরাজ আর আশার কতা বললেন না। বাসায় ফিরে এলাম। সন্ধ্যার আগে নাগাদ তিনি বললেন তিনি চোখে কিছু দেখছেন না। সবাই কালেমা পড়তে লাগল। আমার মা আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলেন তখন। মা আমার কোলে মাথা দেয়া। মাগরিব হয় হয়। সবাই মাকে পানি খাওয়াবার চেষ্টা করল। আমি পানি দেবার সাথে সাথে মা আমার নাই...

ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজীউন পড়লাম। মায়ের মাথাটা বালিশে শুইয়ে বাইরে এসে খুব শান্ত গলায় বললাম, 'আব্বা, কোন চিন্তার কারন নাই, আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন।""

কি ভাবে অমন অদ্ভুত সহ্য ক্ষমতা পেয়েছিলাম জানিনা কিন্তু অনেক্সন চোখে জল আসেনি সেদিন। পরে যকন সম্বিত ফিরে পেলাম, বুঝলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদটা আজ হারিয়ে গেছে আমার। এমন এক সম্পদ, সারা দুনিয়া খুঁজে যা আর পাওয়া যাবেনা। আমার সমস্ত কিছুর বিনিময়েও ঐ মুখ আর দু'চোখ ভরে একবারের জন্যএ দেখতে পাবনা। সারা দুনিয়াতে কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে তাকে একবারের জন্যেও দেখতে পাবনা। এ এক এমন অনুভুতি যা ভাষায় বলে বোঝান সম্ভব না।

শুনেছি রমজান মাসে আত্মারা ছাড়া পায়, প্রিয় জনের আশেপাশে থাকে। তাই এই মাসটা আমার ভাল লাগে। আর যখন সবাই ঈদ মুবারক বলে শুভেচ্ছা দেয়, আমার চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।

দোই করি, তিনি যেন জান্নাতবাসি হন। পৃথিবীতে আমাদের জানামতে কাউকে কখনও কোন কটু কথা পর্যন্ত তিনি বলেন নি।

আজ ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। আরেক টা মা (আমার মেয়ে পূণ্য) আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তবু মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে আমার মায়ের জন্য হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।

দোআ করি, এই মরণ ব্যাধী যেন কোন সন্তানকে মা হারা না করে। আমীন।

(একটানা লিখেছি, বানান ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১২:৫১
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×