প্রস্তাবনা
ফেসবুকে গল্প পড়ার জন্য ভালবাসার গল্প, কাঁচা হাতের গল্প, ভালবাসার ডাকপিয়ন পেজগুলো আমার দারুণ পছন্দের। সময় পেলেই নতুন লেখা পড়তে ঢুঁ মারি।
হরেক রকম গল্প। ভালবাসার বিচিত্র প্রকাশ তাতে। পড়ি আর মুগ্ধ হই। বুকের মাঝে আঁছড়ে পড়ে বাঁধভাঙ্গা অনুভূতির ফেনিল জলরাশি।
আমি মূলত পাঠক। লেখালেখি আমার কাজ না। কিন্তু হঠাৎ করেই লিখতে ইচ্ছে হল।
লিখবো তো, কিন্তু প্লট? কলেজ আর মেডিকেল ভর্তি কোচিং এর স্মৃতি পুঁজি করেই এই জগাখিঁচুড়ির রন্ধনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পাঠকের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, নিজ দায়িত্বে খাবেন। “পেট নেমে গেলে” কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
পুনশ্চঃ গল্পটা কিছুটা লিখে ''চলবে'' সাইন ঝুলিয়ে দিছিলাম। কিন্তু লিখা আর হয়ে ওঠে না। এই মুমূর্ষু গল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন সাদিয়া আপু। (২) এর সবটাই উনার লেখা। আপুর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা...
(১)
-দোস্ত, ৪১ কোনটা হবে? B না D?
-ঐটা পারি নাই, ৯২ পারছিস?
-হুম, C ।
‘রুপোশ! অ্যানসার শীট নিয়ে আসো’, নাদিম ভাইয়া হুংকার ছাড়লেন।
-সরি, ভাইয়া।
‘তোমাদের আর কতবার বলবো... এক্সামের সময় শিখাশিখি করলে তোমাদেরই ক্ষতি। নিজেকে judge করতে পারবে না’, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকেন নাদিম ভাইয়া।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
“৯৬ বাংলালিংক, ৯৭ ডিজুস,
৯৮ একটেল-বাংলালিংক,
৯৯ ব্ল্যাংক, ১০০ সিটিসেল।
কারো কোন সমস্যা আছে? বাহ! কারো কোন সমস্যা নাই! মারাত্মক পড়াইছি তাহলে!
পরশু Z-5,6,7 পড়ে আসবা। যাও আজ ছুটি”।
হুড়োহুড়ি করে বের হতে থাকে সবাই। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে রুপোশ দেখলো আকাশে মিশকালো মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি আসবে কি না এ নিয়ে বাজি ধরার আগেই শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি।
কোচিং এর নিচে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে সবাই। বেশিরভাগই ছাতা আনে নি। রুপোশ মুঠোফোন বের ফেসবুকে লগ ইন করে। নতুন মেসেজ। “কেমন লাগলো ঝাড়ি?”
একটু খুঁজতেই পেয়ে যায় যে মুখটা খুঁজছিল। মুগ্ধ চোখে বৃষ্টি দেখছে তিতির। রুপশের অদ্ভুত লাগে। ফেসবুকে এত কথা বলে মেয়েটা! অথচ সামনাসামনি কোন কথা নাই। তিতিরের কানে হেডফোন। একটু একটু মাথা দুলছে গানের তালে।
রুপশ চায়ের দোকানের দিকে আগায় তানভীরকে সাথে নিয়ে।
-মামা, দুইটা চা দিও।
নিয়মিত কাস্টোমার দুটিকে দেখে সোহেল পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসি দেয়।
-ছাতি আনেন নাই, মামারা। বরষা দিনের ভরসা নাই। এই ম্যাঘ, এই রইদ। সব সুমায় ছাতি রাখা দরকার।
চা খেতে খেতে রুপশ জিজ্ঞেস করে তানভীরকে, “রেজাল্ট কবে দিবেরে?”
-কি জানি! যে এক খান পরীক্ষা দিলাম... বাপ রে, বাপ! আমার নাভিশ্বাস উঠায়া দিছে। হরতাল ডাকার আর টাইম পায় নাই।
(দুই বন্ধুতে চা খাক। শ্রাবণধারায় ধুঁয়ে যাক নাগরিক কলুষতা। এই ফাঁকে আমরা মহাকালকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভূতভ্রমন করে আসি।)
ডাচ বাংলা ব্যাংক আন্তঃ কলেজ সায়েন্স ফেস্টিভাল
ভেন্যুঃ ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ
নিজেদের প্রজেক্ট নিয়ে শহরের সেরা কলেজগুলো এসেছে। নটর ডেম কলেজ থেকে যে প্রজেক্টগুলো এসেছে তার মধ্যে রুপশ-তানভীর এর একটা প্রজেক্টও আছে।
সবাই প্রজেক্ট দেখছে, প্রজেক্ট নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে প্রতিযোগীদের, মন্তব্য খাতায় মন্তব্য লিখছে। বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। রুপশ বেশ মজা পাচ্ছে। এরকম বড় ফেস্টিভালে এর আগে অংশ নেয়নি ও। তাই মজার মাত্রা কিছুটা বেশি। অন্যদের প্রজেক্টগুলোর দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে ওর চোখে পড়লো শ্যামলা মতন কোঁকড়া চুলের একটা মেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে নিজের প্রজেক্ট সম্পর্কে বলছে এক দর্শনার্থীকে। পাঠকের নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নাই এই শ্যামলা বরণ মেয়েটিই হচ্ছে তিতির। হলিক্রস কলেজের প্রতিনিধিত্ব করছে সে। রুপশ এগিয়ে যায় ওদের স্টলের দিকে। জিজ্ঞেস করে ওদের প্রজেক্ট সম্পর্কে। তিতির বেশ আগ্রহ নিয়ে বুঝাতে শুরু করে। সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেটা কিনা চালকদের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার আগাম সতর্কতা জানাবে....
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
দ্বিতীয় দিন। আজ ফলাফল জানানো হবে।
নিপাতনে সিদ্ধের মত আমার গল্পতেও সেরা প্রজেক্ট এর পুরস্কার পাবে তিতিরের প্রজেক্টটাই। সবাই অভিনন্দন জানালো ওকে। রুপশও এলো।
-কংগ্র্যাটস! আপনার প্রজেক্টটা বেশ সময়োপযোগী। কাজে লাগাতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
-থ্যাংকস। আপনার প্রজেক্টটাও তো বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে। অভিনন্দন আপনাকেও।
তারপর ফেসবুক আই ডি শেয়ার, মেসেজ চালাচালি। বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায় দুজনের।
(২)
তখন থেকে অপেক্ষা করছে রুপোশ। তিতিরের অনলাইনে আসার নামগন্ধ নাই।
রাত বেড়ে যাচ্ছে । কাল আবার মডেল টেস্ট । এই এডমিশন কোচিংয়ের মত পেইনফুল, জঘন্যতম ,নিকৃষ্টতম, বিশেষণবিহীন জিনিস আর নাই । লাইফটাকে একেবারে ত্যানা ত্যানা বানিয়ে দিয়েছে ।
অবশেষে রাত ১টায় তিতিরের অনলাইনে আগমন এবং রুপোশের তত্ক্ষণাত্ মেসেজ।
-কি রে মহারানী ? পড়তে পড়তে তো উল্টায় দিলি ...
ভেংচি কাঁটা ইমো দিয়ে তিতির টাইপ করতে থাকে, "তোর মত নাকি ? তুই তো ভিটামিন সমৃদ্ধ ঝাড়ি খাস"।
খুঁনসুটি চলতে থাকে অনেক রাত অবধি । রাত বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে সম্পর্কের গভীরতা। নিত্যদিনের খুঁনসুটির আড়ালে হয়তো দুইএকবার দীর্ঘশ্বাসও পড়ে, কিন্তু অপর পক্ষের নির্লিপ্ততায় তা নিতান্তই বেমানানরূপে অগ্রাহ্য হয় ।
(৩)
হামাগুড়ি দিয়ে সময় চলে যায়, নিঃশব্দে, খুব গোপনে।
দেখতে দেখতে ভর্তি পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে। ফেসবুকে খুব বেশি সময় দেয়ার উপায় নেই। বিদ্যুৎ স্যার বলতেন, ‘কাছা বেঁধে পড়তে হবে’ । সেটাই চেষ্টা করছে রুপশ।
তিতিরের ইচ্ছা বুয়েট, আর রুপশের লক্ষ্য মেডিকেল। তবে তিতিরের বাবার ‘এইম ইন লাইফ ইন হার লাইফ’ মেয়ে ডাক্তার হোক। তাই মেডিকেল কোচিং করা। যেহেতু রুপশ ছিল, তিতিরও মেডিকেল কোচিং এ যেতে আপত্তি করে নি।
যথারীতি কোন এক শুক্রবারে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেল। তারপর অপেক্ষা... অস্বস্তিকর অপেক্ষা।
পরীক্ষা খারাপ হয় নি। তবে সবারই ভাল হয়েছে তাই কিছু বলা যাচ্ছে না। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে কেউই বলে নাই যে আশিটার কম দাগাইছে।
আজ রেজাল্ট দেয়ার কথা।
রুপশের মাথায় ভোঁতা এক ধরনের ব্যাথা করছে। টেনশনে বুকের মধ্যে এত জোরে ঢিব ঢিব করছে যে রুপশের মনে হল আশেপাশের সবাই বুঝি সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এদিকে তিতির বিন্দাস; ‘খেলাধুলায় অংশগ্রহনই বড় কথা’ নীতি মেনে সে এটেন্ড করেছে পরীক্ষায়। খুব বেশি এক্সপেকটেশন নাই।
“You have a message”
রুপশের হার্ট একটা বিট মিস করলো। লম্বা একটা দম নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো সে। মুহূর্তেই সব কিছু যেন সুপার স্লো মোশনে চলছে মনে হল রুপশের। নিজেকে ওজনশূন্য মনে হল, হাল্কা পালকের মত।
মুঠোফোনের ডিসপ্লেতে ভাসছে -
‘’Congratulations…… Merit Position 143….. Allotted medical college: Dhaka Medical College…”
কাঁপা কাঁপা হাতে মুখস্ত নাম্বার চেপে মুঠোফোন কানে ধরলো...
- হ্যালো!
- আম্মাআআআআ! DMC
- আলহামদুলিল্লাহ! তোর আব্বাকে দেই দাড়া... (শুনতেছো... ছেলে ঢাকা মেডিকেলে টিকছে...)
- হ্যালো, আব্বা
- Congratulations, ব্যাটা!!! তুই এক্ষুণি বাড়ি চলে আয়। খুব দেখতে ইচ্ছা করতেছে তোরে...
Incoming তিতির>>>
- দোস্ত, কংগ্রাচুলেশন্স
- থ্যাঙ্কস! তুই জানলি কেমনে? নেটে ঢুকতে পারছিস? তোর কি অবস্থা?
- আমার কথা ছাড়। আমি তোর রোল দিয়া রেজাল্ট দেখার জন্য রেজিস্ট্রেশন করছিলাম কই খাওয়াবি বল?
- হা! হা! কোচিং এর ওখানটায় আসবি?
- ওকে। চলে আয়। তোর চাঁদ মুখখান দেখায়ে কৃতার্থ কর।
তিতিরের পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। খুব ভাল্লাগছে ওর। মেডিকেল ছেলেটার প্যাশন ছিল। ঐ তো দেখা যাচ্ছে ওকে...
রুপশ তিতিরকে দেখে রীতিমত দু’পাটি দন্ত বিকশিত একটা হাসি দিল রাস্তার ও পাড় থেকে।
হঠাত তিতিরের মনে হল অভিকর্ষকে উপেক্ষা করে ওর হৃদপিণ্ডটা বুঝি মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে। কোলাহোলপূর্ণ চারপাশ নিমিষেই শব্দশূন্য হয়ে গেল ওর জন্য...
বিপদজনক গতিতে আসা বাসটা একদম খেয়াল করেনি রুপশ... রক্ত... টকটকে লাল... জটলা... অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন... সবকিছু ভয়ঙ্কর কোন এক দুঃস্বপ্নের মত মনে হয় তিতিরের।
................................................................................................
রুপশের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। ওর বাবা ওকে দেখার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। ওর মা, ছেলে বাড়ি আসছে জেনে গুড়ের পায়েশ করেছিলেন। রুপশের খুব পছন্দের।
যখন রুপশ এলো, গুড়ের পায়েশের উপর ভনভন করছিল নীলাভ কতগুলো মাছি...