“ওকে বলে দিবা আরেকদিন যদি দেখি এলাকায় ঘুরঘুর করতে তাহলে থাপড়ায়া হাত-পা ভেঙে দেবো, বদমাইশ কোথাকার”...
“কিন্তু ঝন্টু ভাই, থাপ্পড় দিয়ে হাত পা কিভাবে ভাঙবেন আপনি?”
রিকশার ওপাশ থেকে সুমির ছোটবোন ঝুমুর এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো ঝন্টু। গলা খাকারী দিয়ে সানগ্লাসটা চোখে লাগিয়ে বললো, “শোনো ঝুমু, বড়দের কথায় নাক গলাতে নাই। তোমার স্টুপিড বোন কোথাকার কোন লুইচ্চা বদমাশের সাথে ইটিশপিটিশ করবে আর সেই ছেলে এলাকায় ঘুরঘুর করে এলাকার মানইজ্জতের চৌদ্দটা বাজাবে এইটা মানা যায়না। আর আমি রোজ সকালে জিমে যাই। ইস্পাতের মত শক্ত শরীর। থাপ্পড় না টোকা মারলেই টিবিয়া-ফিবুলা আলগা হয়ে যাবে।”
“এক্সকিউজ মি.। আমি কার সাথে কি করবো না করবো সেটা দেখার আপনি কে? আর অই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফাইজলামী করেন? হিরোগিরী দেখাইতে আসলে আরেকদিন চিৎকার করে পাবলিকের মাইর খাওয়াবো। পাবলিকের প্যাদানী চিনেন তো? রাবিশ ইতর কোথাকার। এই রিকশা, তুমি যাও।” – রিকশার ভেতর থেকে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো সুমি।
“দাড়া তুই, কথা শেষ হয়নাই”। রিকশাঅলাকে ঝাড়ি দিয়ে সানগ্লাসটা আবার খুলো সুমির দিকে তাকালো ঝন্টু। “মেয়েমানুষের এত তেজ ভালোনা। পাবলিকের ভয় দেখাও? এখন ভরা এলাকায় ওড়নাটা টান মেরে নিয়ে গেলে বুঝবা পাবলিক কি জিনিস আর বিয়ে কি জিনিস। যা বললাম মনে থাকে যেন। এলাকায় ভিলেন এন্ট্রি নিলেই হিরোর মাইর খাবে। সহজ সমীকরণ। এখন বাসায় যাও। পড়াশোনা করো ভালমত। প্রেম-পীরিত করে সময় নষ্ট করতে নেই। জলিল স্যারের বাণী শুনোনাই? পেম- পিরিতি ইজ পাট অফ লাইপ। নট এবরিথিং“
রিকশা ছেড়ে সরে দাড়ায় ঝন্টু। একটা সিগারেট ধরিয়ে সেলুনের দিকে রওনা দেয়।
সুমি-ঝুমু এরা এই এলাকায় নতুন। দুই বোনের বয়সের পার্থক্য এক বছর। বাবা সরকারী চাকরি করে। বিরাট ঘুষখোড়। ঘুষের টাকা দিয়ে এই এলাকায় ৫ তালা এক বাড়ি করেছে। দুই বোনই চোখ ধাধানো সুন্দরী। তবে ঝুমুর গায়ের রং একটু শ্যামলা টাইপের। এরা এলাকায় পা দেবার পর ঝন্টু বিপদে পড়ে গেছিলো কার সাথে লাইন মারা যায় এটা নিয়ে। সুমির চাইতে ঝুমু বেশী সুন্দর কিন্তু ঝন্টুর আবার গায়ের রং এর উপর ব্যাপক এলার্জী। ফর্সা মেয়ে দেখলে ঝন্টুর মাথার স্ক্রু দুইটা আলগা হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকেই নিজে বলে, কন্ট্রোল ম্যান কন্ট্রোল।
সুমির উপর ঝন্টু বিরাট এমাউন্টের ক্রাশ খেয়ে খেলেছে। কিন্তু মেয়ে বড় ফাজিল। তাকে দুই পয়সা দামও দেয় না। তাকে মনে করে রাস্তার মাস্তান। কখনোই ভালভাবে কথা বলেনা। এদিক দিয়ে ঝুমু অনেক লক্ষী। তাকে অনেক সম্মান দিয়ে কথা বলে। সুমির ফোন নাম্বারও দিয়ে গেছিলো। সেইরাতে ঝন্টু রাত ১২টায় গায়ে এক্স বডি স্প্রে আর মুখে মাউথফ্রশনার দিয়ে ফোন দিলো সুমিকে। দুই লাইন রবীন্দ্রসংগীত বলে পরিচয় দেয়ার পরপরই সুমি বললো, “হারামজাদা, আরেকদিন ফোন করলে দু পায়ের মাঝে কষে লাথি মারবো। ফাজিল।” যেই মেয়ে এইটাইপ কথা একটা স্বল্প পরিচিত ছেলেকে বলতে পারে তার উপর ক্রাশ খাওয়া বোকামীর কাজ এবং এ ঘটনার পরও সেই ক্রাশ অব্যাহত রাখা আরো বোকামীর কাজ। কিন্ত কবি বলেছেন, প্রেমিকেরা বোকাই হয়। সেই সূত্রানুযায়ী ঝন্টু আর চালাক হওয়ার চেষ্টা করেনা। মাঝেমাঝে অবশ্য মনে হয়, ইশ সুমির উপর ক্রাশ না খেয়ে ঝুমুর উপর ক্রাশ খেলে ভালো হত। এই মেয়েটা আসলেই বড় ভালো। কপাল ভালো যে ঝুমু ছোট। শালী আধে ঘরওয়ালী এই সূত্র সে কাজে লাগাতে পারবে। উদাস নয়নে মুখ থেকে ধোয়া বের করে নাপিতকে অর্ডার দেয়া ঝন্টু, “ক্লিন শেইভ মার ফোম দিয়ে। গাল কাটলে খুন হয়ে যাবি বলে দিলাম।”
ঝুমু বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিন্দী মুভি দেখছে আর ডায়লগ হিসাবে শুনছে ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসা সুমি আর মায়ের সম্মিলিত চিৎকার চেচামেচি। সুমির মত গর্দভ মেয়ে দুনিয়াতে আর নাই এ ব্যাপারে ঝুমুর কোন সন্দেহ নেই। ঝন্টু ভাইয়ের মত মানুষকে ফেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে কোনখানের একটা গর্দভ ডাক্তারকে। ভালই হবে। গাধা-গাধীর সংসার। বাচ্চাটা হবে আরকটা গাধা। ইশ ঝন্টু ভাইটা যদি সুমিকে পছন্দ না করে তাকে পছন্দ করতো। দুইজনের নামই ঝ দিয়ে শুরু। বাচ্চার নাম রাখতো ঝিঝি। ভাবতে ভাবতে ঝুনুর শ্যামলা গালে একটু লাল আভা পড়ে গেলো। উঠে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
দেখতে সে যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্ত গায়ের রংটা একটু ময়লা। রাস্তায় ছেলেরা তাকে দেখলে সুমির চাইতে বেশী লাইন মারার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে একটু মৃদু অহংকারবোধ কাজ করে মাঝে মাঝে। কিন্ত রাস্তার ছেলেপেলে দিয়ে কি হবে। ঝন্টু ভাইকে সে পাগলের মত ভালবাসে। প্রায় সময়ই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সেই কথা ঝন্টু ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সুমির মত একটু ন্যাকামী করার চেষ্টাও করে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়না। হাতে একটা লাঠি থাকলে শিউর ঝন্টু ভাইয়ের মাথায় একটা বাড়ি মেরে মেমোরী রিসেট করে দিতো। শালা কানা কোথাকার। কিন্তু সাহস পাবে কিনা সেইটা বাবার ভাষায় একটা জলন্ত প্রশ্ন।
একদিন ঝন্টু ভাইকে গলির মোড়ে রেস্তোরায় দেখে গায়ে পড়ে কথা বলতে গিয়েছিলো। ঝন্টু ভাই তখন কানে হেডফোন, চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গান শুনছে আর সিগারেট খাচ্ছে। ঝুমুকে দেখে বসতে বলে কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করলো। ঝুমু বললো, “সুমিকে কি আপনি খুব ভালবাসেন?”
- সেইটা কি আর সুমি বুঝলো শালী? পারলে ওর জন্য পদ্মার পারে সুমিমহল বানাইতাম একটা। তোমাদের দুই বোনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। দুইজনের মন এক্সচেন্জ করতে পারলে ভালো হইতো।
- আচ্ছা ঝন্টু ভাই, আমাকে আপনার কেমন লাগে?
- আরে শালী, তুমি তো অনেক ভালো একটা মেয়ে। গায়ের রংটা একটু কালো হলেও মনটা ভালো। শালী কিন্ত আধে ঘরওয়ালী। জানো তো? হাসতে হাসতে ঝন্টু বলে উঠে।
কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিতে দিতে ঝুমু বলে উঠে, “আপনি সিগারেট খান কেন ঝন্টু ভাই? ছেড়ে দেন।”
- দেবো, দেবো। তোমার বোন বললেই ছেড়ে দেবো।
- না, আপনি এখনই ছেড়ে দেবেন। আমি বলছি।
ঝন্টুর মুখ থেকে সিগারেটটা টান মেরে ফেলে দিলো ঝুমু আর সাথে সাথে ঝন্টু তাকে একটা চড় মেরে বসলো।
- শোনো, আমার সাথে রং করবা না। কালো মেয়েদের ন্যাকামী মানায়না। ন্যাকামী করবে সুন্দরী মেয়েরা। তুমি সিগারেটে টান মারলা কোন সাহসে? আরেকদিন এমন করলে থাপাড়ায়া হাত পা ভেঙে দেবো। যাও, বাসায় যাও।
ভাবতে ভাবতেই ঝুমুর চোখ দিয়ে জল চলে আসে। আয়নার দিকে তাকিয়ে কান্না আরো বেড়ে যায় ঝুমুর।
................................
ঝন্টুর মন মেজাজ খুবই খারাপ। সে বিরাট এক ছ্যাকা খেয়ে গেলো। আজ সুমির বিয়ে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে বিয়েটা আটকানোর। সুমিকে সে পটাতেই পারলোনা। সকাল থেকে মদ গিলে অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। নিজেকে দেবদাস মনে হচ্ছে। রফিকের সেলুনে বসে টাল নয়নে আয়নায় তাকালো। চুল দাড়ি না কেটে তিন মাস থাকলে কি তাকে দেবদাসের মত লাগবে? কে জানে। মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন শুরু করলো।
বুকের জমানো ব্যাথা কান্নার নোনা জলে ঢেউ ভাঙে চোখের নদীতে....
অন্যের হাত ধরে চলে গেছো দুরে, পারিনা তোমায় ভুলে যেতে..
ও সুমি ও সুমি তুমি কোথায়
ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়
ঝন্টুর চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রফিক বলে, ভাই ছ্যাকা খেয়ে গেলে হবে? আপনি মিয়া হিরো মানুষ। কই গিয়ে নায়কের মত মেয়েরে তুলে নিয়ে আসবেন তা না করে কান্নাকাটি করতেসেন মেয়েদের মত। ঝন্টুর মাথায় প্রবল চিন্তার উদ্রেক হয়। আসলেই তো। কথা ঠিক।
রাত আটটায় কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ঝন্টু তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। নারকীয়, নাটকীয় এবং নায়কীয় ভঙ্গিতে গিয়ে দাড়ালো সুমির সামনে।
- সুমি, চল।
- চল মানে, কোথায়?
- কোথায় আবার। তোমাকে তুলে নিতে আসছি। চলো দেরী কইরো না।
- ফাইজলামী করেন? বিয়ের মধ্যে গ্যাঞ্জাম বাধাবেন না। পুলিশ দিয়ে ধোলাই খাওয়াবো। কি মনে করেন নিজেকে? নায়ক আসছেন? বিয়ে থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যাবেন। গেট লস্ট সান অফ এ বিচ।
ঝন্টুর মাতাল মাথা পুরাই ফায়ার।
- তুমি নিজেকে কি মনে করো? বেশী সুন্দরী হয়ে গেছো? তোমার মত সুন্দরী রাস্তাঘাটে ঘোরে। তোমার বোনকে দেখে শিখতে পারোনা কিছু? মনকে বিশাল করতে শিখো বুঝলা? অহংকার পতনের মূল। এই যে তোমার বোন ঝুমু। কত লক্ষী মেয়ে। ঝুমুকে এইভাবে বললে ঝুমু আমাকে বিয়ে করে ফেলতো।
- কি স্টুপিডের মত কথা বলেন? শোনেন আপনার মত রাস্তার ছেলের সাথে আমার চৌদ্দগুষ্ঠীর কারো বিয়ে হওয়া সম্ভব না। সিনক্রিয়েট করার আগে ভাগেন। যান..
- স্টুপিড মানে? কি মনে করসো আমাকে? এই ঝুমু এদিকে আসো।
ঝুমু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো।
- আমি তোমাকে এইভাবে বললে বিয়ে করবা না আমাকে?
ঝুমু প্রবল ভয়ে মাথা উপরনীচে নাড়া দিলো। সাথে সাথে ঝন্টু বললো, “তাইলে আর কি? চলো, বিয়ে কইরা ফেলি।” এই বলে ঝুমুর হাত ধরে একটা টান দিলো।
অতি আবেগে, আনন্দে আর টেনশানে ঝুমু চোখ দিয়ে পানি বের করার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। মাটিতে পড়ে যাবার আগে টের পেলো ঝন্টু ভাই তাকে দুই হাত দিয়ে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে হনহন করে হাটা শুরু করে দিয়েছে। বিয়েবাড়িতে প্রচন্ড গোলমাল লেগে গেলো। সবার চিৎকারের মাঝখান দিয়ে ঝন্টু ভাইয়ের আওয়াজ কানে আসতে লাগলো।
“এই কেউ সামনে আসবি না। এক্কেবারে থাপড়ায়া হাত পা ভেঙে দিবো। শ্বশুরআব্বা সরে যান। পরে আইসা দোয়া নিবো। এই সর। থাপড়ায়া ঠ্যাং ভেঙে দেবো। ফাজিল কোথাকার...”
উৎসর্গ : আমার এক হবু ডাক্তার বন্ধুকে। নিজের অজান্তেই সে অনেক বিশাল একটা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে। আমার অনেক দু:সময়ে তার মজার মজার ক্রিয়েটিভ কান্ড কারখানা দেখে মুখে হাসি ফুটেছে। স্রষ্টা তার জীবন আনন্দে ভরিয়ে দিক।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৮