বিংশ শতাব্দির বিপন্ন মানবতার প্রথম চিত্রকর জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন বিংশ শতকের প্রথম তিন দশকে বৈশ্বিক ও দৈশিক ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতে উদ্বেলিত। বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দের কাব্যে ধরা পড়েছে যুগের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অনুভব। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পোড়ো জমিনে অমানবিকতার, দুঃসহ জীবনবোধ মানবজীবনকে করে তুলেছে কঠিন, রোমান্টিক ভাব-ভাবনায় জীবনের এ জটিলতার কোন সমাধান মেলে না। আজীবন সত্যানুসন্ধানী কবি সত্য খুঁজে না পেয়ে তাঁর কাব্যকে এক করুণ সুরে সমপর্ণ করেছেন। তিনি কালের সবচেয়ে পরিণত মানসের কবি। তাঁর ‘সমারূঢ়’ কবিতা তারই যেন ঈঙ্গিত বহন করে। যদিও সমারূঢ় শব্দটির অর্থ বিশেষভাবে আরূঢ় বা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিক(পুরুষ), তথাপিও এটি নিঃসন্দেহে ব্যঞ্জনাধর্মী।
যুগ জটিলতার প্রেক্ষাপটে বিগত জীবনের মূল্যবোধ বিধ্বস্ত। তাই নব জীবনের সঙ্গে রোমান্টিক ভাব-ভাবনাও অচল। জীবনানন্দ প্রেমিক কবি- তবে অচরিতার্থ প্রেমের কবি। প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আধুনিকতা খুঁজেছেন। নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়ের টিকা দিবসে যেমন বলা হয়, “বাদ যাবে না কোন শিশু” - তেমনি জীবনানন্দের কবিতাতেও যেন সে রকম চিত্র দেখি অর্থাৎ প্রকৃতির কোন উপাদান যাতে বাদ না যায় সেজন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। কবিতার বিষয় নির্ধারণে তিনি যেমন প্রকৃতির রূপ-রস দোহন করে নির্যাস নিতেন তেমনি সে ভাব-ভাবনার স্পষ্ট ছাপও আমরা তাঁর কাব্যে পাই। তাঁর মতে প্রকৃত কবিতাবোদ্ধাদেরই কবিতা সমালোচনায় আসা উচিত। অজ্ঞদের সমালোচনায় যখন আধুনিক কবিতাতেও পঁচনের মত ছোঁয়াচে রোগ ছড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করা হয় তখন তিনি অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন,
“বরং নিজেই তুমি লেখ নাকো একটি কবিতা
বলিলাম ম্লান হেসে- ছায়াপিণ্ড উত্তর দিল না।“
অনুভূতির ছাঁচে আধুনিকতাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন নির্লিপ্ত উপমার ভাঁজে ভাঁজে। বোধের ভিতর দিয়ে কবি খুঁজে নিতে চেয়েছেন ভিন্ন চেতনার স্বাদ। অকর্মদের স্বরূপ উন্মোচনে সাহিত্যকর্মী হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর কাব্যে-
“অধ্যাপক- দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি
বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি।”
এ যেন তারই সে দক্ষতার ছাপ। কোন এক সাহিত্য সভায় বিখ্যাত সমালোচক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যখন তার ‘কমলালেবু’ কবিতা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন সে কটাক্ষের জবাব স্বরূপ তিনি এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন। উপর্যুক্ত পংক্তিত্রয়ের মধ্যে সে কটাক্ষের জবাই স্পষ্ট হয়ে ফুট ওঠেছে। ‘কবিতার নন্দন’ গ্রন্থে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, “উপমার ভেতর দিয়ে কবির বাস্তব চেতনা এবং বিশ্বাঙ্গনে আধুনিক কবিতার আসন গড়তে তার অনেক কবিতাই শুধু কবিতা নয়, কোন কোনটি যেন হয়ে উঠেছে সমালোচনার যথোপযুক্ত হাতিয়ার।” কবির বোধে পুনঃপুন জন্ম নেয়া পৃথিবীর সব জড়াজীর্ণতা, ক্ষুধা আর প্রেম কেবলি হয়ে উঠেছে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর। যুগযন্ত্রনায় তাঁর প্রেম স্নান করে স্রোতের প্রতিকূলে। তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থের ‘সমারূঢ়’ কবিতা সেরকমই একটি প্রামাণ্যচিত্রের দ্যোতনার অপূর্ব প্রকাশ।