বই কি একটা মাল? আলু, বেগুন,কম্বল, স্যান্ডেল, কম্পিউটার, বেলাবিস্কুট, ভীমবার, হ্যাঙ্গা্র, দেওয়াল ঘড়ি, টেবিল ফ্যা্ন, আটার বস্তা, আবুল বিড়ি যেরকম মাল বই ও কি সেরকম ই একটা মাল?
চলমান প্রক্রিয়া চিন্তা করলে ব্যাপার টা কিন্তু তাই। খদ্দেরের চাহিদা বিবেচনায় আনতে হবে। খদ্দের এর চাহিদা বুঝে যদি মাল তৈরি করা যায় তাহলে ব্যবসা ভাল হবে। দুটা পয়সাপাতি কামানো যাবে। দুটা পয়সা হলে লোকে সফল বলবে। বলবে- শালা একটা মাল!!
সবই ঠিক আছে। কিন্তু বই এর ক্ষেত্রে পাঠক হিসেবে এতে আমার আপত্তি আছে। কোন বই পড়তে গিয়ে যখনি মনে হয় লেখকের মধ্যে পাঠক তুষ্ট করার ছাগ্লামি আছে তখন আমি সেই বই আর পড়িনা। কারন লেখক যখন পাঠক তুষ্ট করার জন্য লেখে তখন সেই লেখা থেকে লেখকের রিয়েলাইজেশন হারিয়ে যায়। সেই লেখায় রস থাকেনা, থাকে অর্বাচীন কাতুকুতু। সেই লেখার প্রেম, ছ্যাঁক, সুখ, দুঃখ সবকিছু হয় জীবনের সাথে সম্পর্কহীন।সেসব লেখায় চরিত্রের বদলে কিছু পোশাকি ম্যানিকিন থাকে যাদের কেউ প্রেমের পোশাক, কেউ ছ্যাঁকের পোশাক,কেউ সুখের পোশাক বা কেউ দুঃখের পোশাক পরে থাকে। এভাবে পাঠকের মন জয় করতে গিয়ে লেখক তার লেখার ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করেন।
বইমেলা আসলে যেসব নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখি তা দেখেই বোঝা যায় বই গুলো বেশির ভাগ ই অন্তঃসার শূন্য। মার্কেট বুঝে লেখকরা একটা পেম(!) কাহিনী, একটা সায়েন্স ফিকশন, একটা রম্য রচনা, একটা কিশোর উপন্যাস, একটা আদি ভৌতিক উপন্যাস, একটা সাইকো উপন্যাস ইত্যাদি লিখে থাকেন। জীবনের গল্প কেউ লিখেন না। কারন খুব সহজ। জীবনের গল্প লেখার জন্য যে পর্যবেক্ষন ক্ষমতা দরকার সেটা কারোর ই নাই। এসব বইয়ের ভেতরে গিয়ে যদি কেউ অনুসন্ধান করেন তাহলে দেখবেন সেখানে মৌলিক কোন গল্পের প্লট নাই। লেখকের পড়া জনপ্রিয় লেখকদের গল্পগুলোর প্লটের ছায়া অতি দূর্বল রূপে একেবারেই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাহীন কলম দিয়ে বের হয়ে এসেছে। মনোহারী প্রচ্ছদ, ঝকঝকে ছাপা, ফ্ল্যাপে লেখকের নতুন জামাই এর মত লাজুক চেহারার নিচে সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত সবই ঠিক আছে। নাক দিয়ে শুঁকলে বইটার চমৎকার একটা গন্ধও নাকে আসবে। কিন্তু বাসায় এসে বালিশে হেলান দিয়ে বইটা যখন পড়তে শুরু করবেন তখুনি সমস্যা! হয় লেখক আপনাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছেন অথবা হাসাতে চেষ্টা করছেন অথবা কাঁদাতে চেষ্টা করছেন অথবা ভাবাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু আপনি না পারছেন মুগ্ধ হতে, না পারছেন হাসতে, না পারছেন কাঁদতে, না পারছেন ভাবতে। কারন কি? খুব সহজ। লেখার সময় লেখক নিজেই মুগ্ধ হন নাই, নিজেই হাসেন নাই, নিজেই কাঁদেন নাই, নিজেই ভাবেন নাই। তিনি শুধু এই ‘মৌলিক অনুভূতি মশলা’ গুলো দিয়ে একটা বিক্রয়যোগ্য মাল উৎপাদন করতে চেয়েছেন!
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে পাঠকের সাময়িক হিপোক্রিট প্রতিক্রিয়া। একটা লেখা পড়ে আসলে হয়ত কিছুই ভাল লাগে নাই। আরেকজনের কাছে হয়ত ওটা নিয়ে হাসাহাসি করেছেন। আর এদিকে লেখককে পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন- রবীন্দ্রনাথের পিঠ টা কি মসৃণ! লেখক আবার নিজের হাতে পাঠকের সরিয়ে নেয়া হাত নিজের পিঠে আরেকটু বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে- বলেন কি! কোথায় রবীন্দ্রনাথ, কোথায় আমি!
আমার মনে খুব স্বপ্ন জাগে এই বইমেলায় একজন নতুন লেখকের একটা বই হাতে নিয়ে ভীড়ের মধ্যে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে যাব! বই পড়তে পড়তে মনে হবে-যাচ্ছি, আমি একটা জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি!
এই বইমেলায় কি পাব সেরকম কোন নতুন লেখক??
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:২৫