বিবাহের আরবী শব্দ হলো নিকাহ। নিকাহ এর শাব্দিক অর্থ হলো, একত্রিত হওয়া, নারী পুরুষ মিলিত হওয়া।
বিবাহ হচ্ছে এমন একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে নারী-পুরুষ শারীরিকভাবে একে অপরের সাথে মিলিত হওয়া বৈধ হয়। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ পরস্পরে নিজেদের দৈহিক ও প্রাসঙ্গিক চাহিদা পূরণের জন্য সমাজ ও ধর্ম স্বীকৃত বৈধ পন্থার নামই হচ্ছে বিবাহ।
কখন বিয়ে করবেন?
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭৭৮)
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সক্ষমতা রাখে তারা যেন বিয়ে করে ফেলে। কেননা এটা চোখের প্রশান্তি দানকারী ও লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। আর যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন রোজা রাখে, কেননা এটা তাদের উত্তেজনাকে হ্রাস করবে।”
* যদি শারীরিক এবং আর্থিক সক্ষমতা থাকে এবং বিয়ে না করলে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে এমতাবস্থায় বিয়ে করা ফরজ।
* যদি শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকে, কিন্তু বিয়ে না করলে গুনাহের আশংকা না থাকে তাহলে এমন অবস্থায় বিয়ে করা সুন্নাত।
* যদি আর্থিক সক্ষমতা থাকে কিন্তু শারীরিক সক্ষমতা না থাকে যেমন অসুস্থ্য বা বয়স্ক ব্যক্তি, এমতাবস্থায় বিয়ে করা মাকরূহ।
* যদি কেবল শারীরিক সক্ষমতা থাকে, আর্থিক সক্ষমতা নেই তাহলে এমতাবস্থায় বিয়ে না করে রোজা রাখা উত্তম এবং আর্থিক সক্ষমতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা সুন্নাত
সবচেয়ে বেশী বরকতপূর্ণ ও উত্তম বিবাহ:
হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সা. বলেছেন, “নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি বরকত ও কল্যাণময় বিবাহ হচ্ছে সেটি, যেখানে খরচ কম হয় (অহেতুক খরচ হয় না)।” (বায়হাকী, ঈমান অধ্যায়)
দেনমোহর নির্ধারণঃ
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদিও মহরের বেলায় কোন বিশেষ পরিমাণ আবশ্যিকভাবে নির্ধারণ করেন নাই তবু অসংখ্য হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহরের পরিমাণ এতটুকু হওয়া উচিত যা সহজভাবে আদায় করা যায়। আর যে পরিমাণ মহর নির্ধারিত হয় তা থেকে কিছু অংশ বাসররাত যাপনের পূর্বেই স্ত্রীকে দেয়া চাই। অনেক ফকীহদের মতে প্রথমে স্ত্রীকে কিছু না দিয়ে বাসর রাত যাপন মোটেই জায়েয নেই। শামী কিতাবের উদ্ধৃতি মুতাবিক (২/৩২৯) হানাফী মাযহাব মতে স্ত্রীকে প্রথমে কিছু দেয়া মুস্তাহাব।
হযরত আলী রা. হযরত ফাতিমাকে বিবাহ করার পর বাসররাত্রি যাপনের ইচ্ছা পোষণ করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু না দিয়ে বাসর রাত্রি যাপনের অনুমতি দেন নি বরং নিষেধ করেন। হযরত আলী বলেন, "দেয়ার মত আমার নিকট কোন কিছু নেই"। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে "তোমার লৌহবর্ম দিয়ে দাও"। হযরত আলী হযরত ফাতেমাকে স্বীয় বর্ম দিয়ে দেন এবং এরপর বাসররাত্রি যাপন করেন। বস্তুত এতে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আন্তরিক ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং তার মন জয় করা সহজ হয়।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অধিকাংশ স্ত্রীদের মহর পাঁচশত দেরহাম আনুমানিক প্রায় ১৩১ ভরি রূপা নির্ধারণ করেছিলেন। (প্রতি ভরি রূপার দাম হিসাবে বর্তমানে তা ২ লক্ষ টাকার মত হবে)। নবী কন্যাদের বেলায়ও এই পরিমাণ মহরানা নির্ধারণ করা হয়। রাসূলে পাকের স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র হযরত উম্মে হাবীবার মহরানা চার হাজার দেরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর তা রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয় বরং হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজ্জাশী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে আদায় করেছিলেন।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কার্যক্রমের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, এতো অধিক পরিমাণ মহরানা নির্ধারণ করা সঠিক নয় যা আদায় করা কঠিন হয়। আবার এতো অল্প পরিমাণ নির্ধারণ করাও উচিত নয় যাতে তার অবমূল্যায়ন হয় এবং স্ত্রীর জন্য অবমাননা অনুভূত হয়। অথচ এ ব্যাপারে সমাজে সীমালংঘন পরিলক্ষিত হয়। অধিক পরিমাণে মহরানা নির্ধারণ করাকে গৌরবের বিষয় মনে করা হয়, যে পরিমাণ আদায় করা কেবল কষ্টকরই নয় বরং অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে অনেক পরিবারের রেওয়াজ অনুযায়ী এতো অল্প পরিমাণ মহরানা নির্ধারণ করা হয় যা শুনে হাসি পায় এবং স্ত্রীর জন্যও অত্যন্ত অবমাননাকর হয়।
যা দেখে বিবাহ করা উচিতঃ
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
"সাধারণত: চারটি গুণের ভিত্তিতে কোন নারীকে বিবাহ করতে হয়, সহায়-সম্পদ, বংশীয় মর্যাদা, রূপ এবং ধর্মানুরাগ,তোমরা ধর্মানুরাগী সৎ নারীকে বিবাহ করে সফলকাম হও, বড় কামিয়াবী এটাই।" (রেফাঃ)
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
"কেবল রূপ দেখে বিবাহ করো না, কেননা রূপ ধ্বংসের কারণ হতে পারে এবং কেবল অর্থ সম্পদ দেখেও বিবাহ করো না। কেননা সাধারণত অর্থ সম্পদ অহমিকা এবং অবাধ্যতার কারণ হয়। ফলে সে স্বামীর আনুগত্য করে না বরং স্বামীকে খাদেম মনে করে। তাই ধর্মানুরাগীতা দেখে বিবাহ করবে"
আরো হাদীস রয়েছে,
"যদি কেউ কেবল সম্মান অর্জনের জন্য বিবাহ করে তাহলে অসম্মান বৃদ্ধি পায়। যে অর্থ সম্পদের লোভে বিবাহ করে তার অভাব বৃদ্ধি পায়। আর যে বংশীয় মর্যাদা দেখে বিবাহ করে তার মর্যাদা মোটেও বৃদ্ধি পায় না। হ্যাঁ যে পবিত্রতার জন্য অথবা আত্মীয়দের সাথে উত্তম আচরণের খাতিরে বিবাহ করে তবে স্বামী স্ত্রী উভয়ের জন্যই এই বিবাহ বরকতময় হবে"
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন-
"যদি এমন লোক বিবাহের প্রস্তাব দেয় যার ধর্মীয় ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস হয় তাহলে অনতিবিলম্বে তার নিকট বিবাহ দাও। অন্যথায় পৃথিবীতে মারাত্মক ধরনের ফিৎনা ফাসাদ শুরু হবে।"
বলাহয়,
"তিন প্রকার লোকের সাহায্য করার দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজের উপর জরুরী করেছেন-
আল্লাহর জন্য জেহাদকারী মুজাহিদ, ক্রীতদাস যে তার মালিককে আযাদীর বিনিময় আদায় করতে চায় এবং যে গোনাহ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে বিবাহ করতে ইচ্ছুক।"
বিবাহের ফযিলতঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
“মুমিনের জন্য তাকওয়ার পর সর্বাধিক উপকারী বস্তু হচ্ছে নেক স্ত্রী। নেক স্ত্রীর গুণাবলী হচ্ছে, যে স্ত্রী বিনা বিলম্বে স্বামীর নির্দেশ পালন করে। তাকে অবলোকন করে স্বামী আনন্দিত হয়। স্ত্রীর প্রতি ভরসা করে স্বামী শপথ করে, স্ত্রী তা পূরণ করে। স্বামীর অবর্তমানে তার সহায় সম্পদ নষ্ট করে না, এবং তার কারণে স্বামী কষ্ট পায় না।”
বলা হয়ে থাকে,
“বস্তুজগত কেবল সাময়িক উপকারী বস্তু, উপকারী উপাদানের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম হচ্ছে নেক স্ত্রী।”
বর্তমান বাস্তবতাঃ
আমাদের আজকের সমাজের একটি দু:খজনক বাস্তবতা হলো:
আমরা বিবাহকে নানাবিধ অহেতুক খরচের বেড়াজালে বন্দী করে তাকে একটি বিভীষিকাময় কর্মযজ্ঞে পরিণত করেছে। এখন বিয়ের নাম নিতে গেলেই আগে লাখ লাখ টাকার বান্ডিল হাতে রাখতে হবে। যার কারণে লক্ষ লক্ষ যুবক আজ বিবাহের নাম নিতেও ভয় পায়। এভাবে অনৈসলামিক আর অপসাংস্কৃতিক কালচার আমাদের যুব সমাজকে বিবাহের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে। ইসলাম যেখানে বালেগ হওয়া এবং নুন্যতম আর্থিক সঙ্গতি থাকলে বিবাহের অনুমতি দিয়েছে সেখানে আমাদের সমাজ এখন ছেলেদের জন্য ক্যারিয়ার গঠন নামক শর্তের বেড়াজালে ৩০/৩৫ বছরের অলিখিত শর্তারোপ করে করেছে। কিছুদিন যাবত টেলিভিশনে প্রচারিত একটি কোম্পানীর বিজ্ঞাপনও এই থিউরী সম্প্রচার করছে। বলা হচ্ছে, বিবাহে তো অনেক খরচ, তার চেয়ে বরং মোবাইল কিনে প্রেম করেন, আর ফাও টাকা ওড়ান।
অথচ এর বহু আগেই ছেলে মেয়ে বালেগ ও প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায়। আমাদের বর্তমান সমাজে একটি তরুণ-তরুণীর সামনে অন্যায়-অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়ার সকল উপায়-উপকরণ খুবই সহজলভ্য। কিন্তু বিবাহ দুরূহ। যার কারণে যিনা-ব্যভিচারের বিস্তৃতি ঘটছে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে আমাদের রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানী গুলো অব্যাহত প্রচেষ্টায় এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুবক-যুবতীদের বিবাহ বহির্ভুত প্রেম-ভালোবাসা আর যিনা-ব্যভিচার খুব সহজ একটা বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু ধর্ম ও সমাজ স্বীকৃত বৈধ বিবাহকে দেয়া হয়েছে নির্বাসন। তাই দিন যত যাচ্ছে, যিনা-ব্যাভিচার, ইভটিজিং ও নারী নির্যাতন ততই বেড়ে চলছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিবাহকে সহজ ও সাবলীল করার বিকল্প নেই
[বিভিন্ন প্রবন্ধ অনুসরণে মুমীনদের উদ্দেশ্যে রচিত]
ফেসবুকে কর্ণেল সামুরাই
একইরকমের আরো পোষ্টঃ
সম্পদের লালসা ও বিবাহ Vs মুহম্মদ (সা).. সামুরাইয়ের যুক্তিখন্ডন
নিষ্ঠুর ঈশ্বর, বিধ্বস্ত নাস্তিকতা এবং কর্ণেল সামুরাই..