প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরেই স্ত্রী মিরার পকপকানি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তুষার। আগে বিরক্ত লাগলেও এখন আর লাগে না। মিরার কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে সে। মিরার উদ্বেগের একমাত্র কারন, তাদের ছেলে রাহিন। ক্লাস এইটে পড়া রাহিনের পড়াশোনায় একদমই মন নেই। রেজাল্টের অবস্থাও যাচ্ছে তাই। তবে তার মধ্যে কোনো বখাটেপনা বা বেল্লাপনার ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই। একেবারেই শান্ত, ভদ্র ও সুশীল একটা ছেলে। সমস্যা ঐ একটাই - পড়াশোনায় অমনোযোগী। তুষারের এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। ছেলেকে নিয়ে টেনশন করার সকল দায়িত্ব সে মিরার উপরেই ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। তাছাড়া সারাদিন অফিস করে এসব ছোটখাটো পারিবারিক ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা তুষার।
তবে আজকের পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে তুষারের কাছে। অন্যদিনগুলোর মত আজ মিরার কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিকই ঠেকছে তুষারের কাছে। মিরার দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। হঠাৎ পাশের রুমে গিয়ে তড়িৎবেগে কিছু একটা হাতে নিয়ে তুষারের সামনে এসে উপস্থিত হল মিরা। গম্ভীর মুখে বললো, “এই নাও তোমার ছেলের প্রগ্রেস রিপোর্ট"।ভাবলেশহীনভাবে প্রগ্রেস রিপোর্টটি উল্টালো তুষার। ছেলের প্রগ্রেসের অবস্থা দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার যোগাড়। লালে লালে রঞ্জিত হয়ে আছে রিপোর্টটি। দু একটি বিষয় ছাড়া মোটামুটি সবগুলোতেই ফেল। এই মূহুর্তে কোনো বাবার মুখে হাসি আসাটা অস্বাভাবিক ঘটনাই বটে। কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাটাই ঘটিয়ে বসলো তুষার।
: আচ্ছা তুমি কি কোনো রক্ত মাংসের মানুষ? আমার না মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। এই পরিস্থিতিতে তুমি হাসছো কিভাবে?
: সরি বাবা...আসলে রেজাল্ট কার্ডটা দেখে অনেক পুরোনো একটা স্মৃতি মনে পড়লো। ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি ঠিক এরকম রেজাল্ট কার্ড নিয়ে আব্বার সামনে হাজির হয়েছিলাম।...আব্বা উলঙ্গ করে যেই মাইরটা দিছিলো না...পাছাতে এখনো মাইরের দাগ রয়ে গেছে...হাহাহাহা!
: তোমার বাবাই ঠিক ছিলো। ঐ সময় তোমাকে সঠিক ট্রিটমেন্টটা করেছেন বলেই তুমি আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দুঃখের সাথেই বলছি, তোমার বাবা হওয়ারই কোনো যোগ্যতা নেই। তোমার মত এতটা দায়িত্বহীন বাবা আমি আমার জীবনে দেখি নি।
কথাগুলো শেষ না হতেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো মিরা। মিরার কান্না দেখে কিছুটা বিব্রত বোধ করছে তুষার। আজকাল বেশিরভাগ মায়েদেরই বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা কাজ করে। ব্যাপারটা তুষারের কাছে একদমই বিরক্তিকর লাগে।
মিরার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি ছেলে রাহিনের রুমে ঢুকলো তুষার। বই একটা খুলে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে সে। বোঝাই যাচ্ছে মায়ের বকুনি খেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়তে বসেছে।
: কি পড়ছো বাবা?
তুষারের প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো রাহিন। বাবা কখনো পড়াশোনা নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলেনি। আজ বাবা হঠাৎ রুমে এসে পড়াশোনার খোজখবর নিচ্ছে, কাহিনী কি? অজানা এক আতঙ্ক কাজ করা শুরু করেছে রাহিনের মনে। বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল।
: তোমার সমস্যাটা আমাকে একটু বলতো বাবা। দিন দিন তোমার রেজাল্টের এত খারাপ অবস্থা হয়ে যাচ্ছে কেনো?
রাহিন কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তুষার ছেলের মাথায় হাত রাখলো। ওর মাথায় কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে খাটে নিয়ে বসালো...এবার একটু স্বাভাবিক হলো রাহিন।
: সত্যি করে বলতো, তোমার কি পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না? নির্ভয়ে সত্যি কথাটা বলো...
রাহিন কিছুক্ষন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর নিঃসংকচে বলে উঠলো...“আমার পড়াশোনা করতে একেবারেই ভালো লাগে না বাবা। পড়াশোনা জিনিসটা আমার কাছে বুলশিট মনে হয়”।
: ঠিক আছে বুঝলাম। তাহলে কি করতে ভালো লাগে তোমার?
: আমার সারাদিন ক্রিকেট খেলতে ইচ্ছা করে।
: তাই? তো ক্রিকেট খেলে কি হবে শুনি? সাকিব হাসানের মত ক্রিকেটার হতে পারবা?
: পারবো বাবা। আমি সাকিব হাসানের চেয়েও বড় ক্রিকেটার হবো। আমি একদিন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্যাপ্টিন হবো!
ছেলের আত্নবিশ্বাস দেখে বিস্মিত হল তুষার। তুষারেরও কেনো যেন মনে হওয়া শুরু করলো তার ছেলে সত্যিই একদিন সাকিব হাসানের চেয়েও বড় ক্রিকেটার হবে।
: মুখে মুখে বললে হবে না। কাজে সেটা প্রমাণ করতে হবে। স্কুল ক্রিকেট টিমে তোমার পজিশন কি?
: বাবা, আমি স্কুল ক্রিকেট টিমে সবসময় ওপেনিং-এ ব্যাটিং করি। কয়েকদিন আগে নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটের জন্য সিলেক্টেড হয়েছি।
: ভেরি গুড। আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিলাম। নির্মাণ ক্রিকেট কম্পিটিশনের প্রথম খেলাটা আমি দেখতে যাবো। ঐদিন আমি তোমার খেলা ভালোভাবে অবজার্ব করবো। ওটা হবে তোমার জন্য একটা পরীক্ষা। যদি পাশ করতে পারো...তাহলে সেদিন থেকে তোমার জীবনের ধ্যান জ্ঞান হবে একটাই - ক্রিকেট। তোমাকে পড়াশোনার জন্য আর কেউ চাঁপাচাপি করবে না। দরকার হলে আমি তোমাকে বিকেএসিতে ভর্তি করিয়ে দিবো। একজন ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যা যা সহযোগিতা দরকার সব আমি করবো। কিন্তু কথা দাও, অন্তত এই পরীক্ষায় তুমি ফেল করবে না!
কথাগুলো স্বপ্নের মত মনে হলো রাহিনের কাছে। চোখে মুখে বাবার প্রতি হাজারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেলো। মনে মনে দৃঢ় অঙ্গিকার করলো, এই পরীক্ষায় সে পাশ করেই ছাড়বে যেভাবেই হোক।
......নিজের ছেলেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছো, না? কেমন বাবা তুমি ? নিজের ছেলের জীবনটাকে এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছো?
: ভুল বললা। আমি আমার ছেলের জীবনকে মোটেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছি না। আমি চাইনা ওর জীবনটাও আমার মত হতাশায় কাটুক...বাবা-মার ইচ্ছের মূল্য দিতে গিয়ে জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম তা হতে পারিনি। বুকে প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে জীবনের প্রায় অর্ধেকের বেশি সময় পার করে ফেললাম। আমি চাইনা আমার ছেলের জীবনটাও আমার মত হোক।
:তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলা যে তোমার ছেলে ক্রিকেটার হিসেবে সফল হবে? যদি ও সফল না হয় তাহলে ওর ভবিষ্যতটা কি হবে একবার কি ভেবেছো ঠান্ডা মাথায়?
: ওর চোখেমুখে যে আত্নবিশ্বাস আমি দেখেছি, আমি একশ ভাগ নিশ্চিত আমার ছেলে সফল হবেই।
--------------------------------------------------------------------
বেশ আগ্রহ নিয়ে ছেলের খেলা দেখতে মাঠে এসেছে তুষার। রাহিন যখন ব্যাট হাতে ক্রিজের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলো...অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিলো তুষারের। নিজের ছেলের মাঝে সাকিব হাসানের স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাচ্ছে সে। চোখে কেনো যেন পানি চলে আসছিলো বারবার। এদিকে চমৎকার ব্যাটিং শুরু করেছে রাহিন। গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের আনন্দে মাতিয়ে তুলেছে সে। বাবা হিসেবে গর্বে বুকটা ভরে উঠছিল তুষারের......