বাসের পিছনে কলেজ পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ের হৈ-হুল্লর যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে নীরবের। বারবার পিছনে ফিরে ভ্রু কুচকে তাকাচ্ছে সে। তাদেরকে বোঝাতে চাচ্ছে, একটু রয়ে সয়ে ফুর্তি করো। কিন্তু নীরবের ইশারা ইঙ্গিত কেয়ার করার টাইম কই ওদের? বাংলা পপ গান, ইংলিশ মেটাল, হিপহপ যে যা পারছে বেসুরা সুরে গেয়েই যাচ্ছে একটার পর একটা। গানের তালে তালে চিৎকার তো আছেই! সেই সাথে হাসাহাসি-হাততালি-শিস দেয়া...ওফ মাথাটা একেবারে ধরেই গেল নীরবের। এদিকে বাসের অন্যান্য যাত্রীরা একেবারেই নির্বিকার। কারো চেহারার মধ্যে বিরক্তির কোনো আভাই দেখা যাচ্ছে না। কিছু মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক তো বেশ আগ্রহভরেই উপভোগ করছে টিনএজার তরুন-তরুনীদের উন্মাদনা। নীরবের যে ইদানিং কি হয়েছে তা সে নিজেও জানেনা। সবকিছুই কেন যেন খুব বিরক্তিকর মনে হয়। জীবনটা দিন দিন একদম বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড একঘেয়েমী লাগে এই জীবন। প্রতিদিন ৯-৫টা অফিস, অফিস শেষে দীর্ঘ ৩ ঘন্টার ট্রাফিক জ্যাম পেড়িয়ে অনেকটা আধামরা হয়ে বাড়ী ফেরা, তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুম, পরদিন আবার অফিস...! এটাকে কি জীবন বলে? কালকে অফিস থেকে ৫দিনের ছুটি নিয়েছে সে। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলো কক্সবাজার থেকে একটু ঘুরে আসবে। সমুদ্রের বিশালতা ও অপার সৌন্দর্য হয়ত কিছুটা হলেও তার একঘেয়েমীতে ভরা জীবনে স্বস্তি এনে দেবে! তবে ছুটি ম্যানেজ করতে বেশ ভালোই কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তাকে। প্রাইভেট কোম্পানী থেকে ৫দিনের ছুটি ম্যানেজ করা আর হিমালয় পর্বত জয় করা তো প্রায় কাছাকাছিই একটা ব্যাপার।
বেশীক্ষন হয়নি বাস যাত্রা শুরু করেছে। এখনো অনেক সিটই খালী। সামনের স্টপেজগুলো থেকে হয়ত আরো যাত্রী উঠবে। নীরবের ঠিক পিছনের সিটে বসা এক ভদ্রলোক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই চিৎকার চেচামেচির মধ্যে একটা মানুষ কিভাবে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে নীরব কিছুতেই বুঝে উঠল না। লোকটির ঘুম দেখে নীরবেরও শরীরটা মেজমেজ করছে। হাল্কা ঘুমও পাচ্ছে। ঘুম কি আসলেই কোনো সংক্রামক ব্যাধি কিনা সেটাই ভাবছে নীরব। আর এদিকে সেই উচ্ছ্বল তরুন-তরুনীরা আগের চেয়ে একটু শান্ত হয়েছে। বোধ হয় চিল্লাতে চিল্লাতে টায়ার্ড হয়ে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নীরব। কানের মধ্যে হেডফোন গুজে দিয়ে প্রিয় শিল্পী জন ডেনভারের সেই বিখ্যাত গান “ইউ ফিল আপ লাই সেন্সেস...” শুনতে লাগল। গান শুনতে শুনতে কখন যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, জানেনা সে! আচমকা একটি মেয়েলী কন্ঠ শুনে হুরমুর করে জেগে উঠল...
--এক্সকিউজ মি! আপনি তো হেলতে হেলতে আমার কোলের উপর এসে পড়েছেন! আপনাদের মত যাত্রীদের জন্য বাসে “সিট” নয় “খাটের” ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল!
মেয়েটিকে দেখে নীরব হতবাক হয়ে গেল। তার পাশে এই পরী কোথ থেকে এল? পরী দেখতে নাকি অনেক রুপসী হয়। তবে তার পাশে বসা মেয়েটির চেয়ে রুপসী হবেনা-এই ব্যাপারে নীরব নিশ্চিত!
--আজব তো! আপনি কিছু না বলে “হা” করে তাকিয়ে আছেন কেন?
--এহেম...না মানে আমি একটা ব্যাপার বুঝে উঠতে পারছিলাম না!
--“বুঝে উঠতে পারছিলাম না” মানে? কি বুঝে উঠতে পারছিলেন না?
--আমি কি সপ্ন দেখছি নাকি সত্যি দেখছি-সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে সপ্ন দেখছিলাম না।
--ওও তাই? তো কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
--পরীরা চশমা পড়ে না। কিন্তু আপনার চোখে চশমা।
--আশ্চর্য!! আপনার সাহস দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি! আপনি আমার সাথে ফ্লার্ট করছেন???
--আমি খুবই গোবেচারা টাইপ মানুষ। ফ্লার্ট কিভাবে করে সেটা জানিনা। তবে আমি যা বলেছি একটুও মিথ্যা বলিনি।
--আপনার চেহারাটা বোকাবোকা হলেও আমি নিশ্চিত আপনি অত্যন্ত ধুরন্দর একটা লোক। আমার কপাল খারাপ...আপনার মত একটা লোকের পাশে আমার সিট পরেছে।
--আপনি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন। আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই।
--ঠিক আছে। ঠিক আছে। আপনি যেমনি হোন না কেন সেটা নিয়ে ভাবাভাবির টাইম আমার নেই। আপনি আপনার মত থাকেন। আমি আমার মত থাকি। তবে দয়া করে দূরত্ব বজায় রাখুন। ঘুমের ভান করে যদি আবার আমার দিকে হেলার চেষ্টা করেন...খুব খারাপ হবে বলে দিলাম!
--হাহাহাহাহা! তার মানে আপনি ভেবেছেন আমি তখন ইচ্ছে করে......হলি সিট! আপনি কেন খামাখাই আমার প্রতি এতটা আক্রমনাত্নক হয়ে উঠেছেন বুঝতে পারছিনা। আপনি পুরুষ বিদ্বেষী নাতো?
--আপনি আসলে কথা বলেন বেশী। আস্ত একটা বাঁচাল লোক আপনি!
--আমি মোটেও বাঁচাল না। তবে যাকে ভালো লাগে তার সাথে অনেক বেশী কথা বলি।
নীরবের দিকে প্রচন্ড বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকালো সূচী। কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল, “এই টাইপ লোকের সাথে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো”।
পিছনে আবার হট্টগোল শুরু হয়েছে। এবার গান-বাজনা নয়। দুই বন্ধুর মধ্যে ফাটাফাটি ঝগড়া বেধে গেছে। বাকি বন্ধুরা প্রানপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের ঝগড়া থামানোর জন্য। কিন্তু কোন কাজই হচ্ছে না। বাসের মুরুব্বী টাইপ কিছু যাত্রী এবার উঠে এসেছে তাদেরকে থামানোর জন্য। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবশেষে দুজনকে ঠান্ডা করা সম্ভব হয়েছে। এবার চলছে কোলাকুলি পর্ব। পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করল নীরব। হঠাত করে কেন যে তার সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করেছে...কে জানে??
সূচী ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুমন্ত মুখখানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নীরব। নীরবের মনে হচ্ছিল আকাশের চাঁদ যেন ঠিক তার পাশের সিটে নেমে এসেছে। এত কাছ থেকে চাঁদ দেখার সৌভাগ্য সবার হয়না। একটি মূহুর্তের জন্যও এই অকৃ্ত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চায় না নীরব। একটা মানুষ এত সুন্দর কিভাবে হয়? সৌন্দর্যের একটা সীমা থাকা উচিত। সীমাহীন সৌন্দর্য মোটেও ভালো না। বাসের ঝাকুনীতে হঠাত সূচী নিরবের দিকে হেলে পড়ল। নীরবের কাধে মাথা রেখে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছে সে। নীরবের মনে হচ্ছিল চাদের নরম আলো বুঝি তার সারা শরীরে স্পর্শ করেছে। অন্যরকম একটা ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছিল। জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল নীরবের। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে জীবনটা অনেক সুন্দর...অনেক!!
--এক্সকিউজ মি! এখন তো আপনিই হেলতে হেলতে আমার কোলে এসে পড়েছেন!
সূচী চোখ মেলে দেখে যে তার মাথা নীরবের কাধের দিকে হেলানো। প্রচন্ড হচকচিয়ে গেল সে! লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। নীরবকে কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না...
--আমি নিশ্চিত আপনি ইচ্ছে করে আমার দিকে হেলে পড়েননি, মুচকি হেসে বলল নীরব।
--সরি আসলে কখন যে......আই এম রিয়েলী সরি!
--সরি হওয়ার কিছু নেই। আমি বুঝতে পেরেছি। আশা করি আপনিও বুঝতে পেরেছেন যে, আমি তখন ইচ্ছে করে আপনার গায়ে হেলে পড়িনি!!
--হুম। আমি খুবই লজ্জিত। না বুঝে আপনার সাথে ওরকম ব্যবহার করা আমার মোটেও উচিত হয়নি।
--ইটস ওকে। আমি কিন্তু আসলে তেমন কিছুই মনে করিনি।
--থ্যাংক্স। আর ও...আপনি কিন্তু তখন আমাকে পরী-টরী কিসব হাবিজাবি বলছিলেন যা আমার কাছে মোটেও শোভন মনে হয়নি!
--ও আই সি! আমি সরি সেজন্য। আসলে আপনাকে প্রথম যখন দেখি মাথা একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কি বলতে যে কি বলে ফেলেছি! আসলে আপনি এত সুন্দর...
--প্লিজ প্লিজ স্টপ। আপনার কথাবার্তা কিন্তু আবার চিপ ফ্লার্টিং-এর দিকে টার্ন নিচ্ছে।
--হাহাহাহাহা। আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি বোধ হয় কমপ্লিমেন্টের সাথে ফ্লার্টকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি কিন্তু...
--ওফ বাদ দেন। এই ব্যাপারে আপনার সাথে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। কফি খাবেন? আসার সময় এক ফ্লাক্স বানিয়ে এনেছি। আমি আবার কফি না খেয়ে থাকতে পারিনা। পুরোপুরি কফি এডিক্টেড।
--কফি কি আপনি নিজের হাতে বানিয়েছেন?
--হ্যা, নিজের হাতে বানিয়েছি। কেন?
--না মানে...চিনি দিয়েছিলেন?
--আশ্চর্য! চিনি দেবো না কেন?
--এহেম এহেম...আপনি নিজ হাতে বানিয়েছেন আবার চিনিও দিয়েছেন...ভয়ে পাচ্ছি এত মিষ্টি একসাথে খেলে না জানি আবার ডায়বেটিস হয়ে যায়..!!
নীরবের দিকে রাগান্বিত ভংগিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল সূচী। তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে হাত থেকে কফির মগ উল্টে পড়ে যায় এমন অবস্থা। নীরবও হাসছে। ওদের হাসি দেখে কিছু কৌতুহলী যাত্রী বারবার উঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছে...কাহিনী কি...?
-----চলবে