গম্ভীরা শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর নয়, সারাদেশের জনগণের কাছে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত বা লোকনাট্য হসেবে বিবেচিত। মালদহসহ ভারতের অনেক জেলার লোকায়ত বিনোদনের অন্যতম অনুসঙ্গ গম্ভীরা। বহু পূরাকীর্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আম, কাঁসা-পিতল, লাক্ষা, চমচম-দমমিস্টি, নকশিকাঁথা ও রেশমের জন্য প্রসিদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। আর লোকসঙ্গীত সংস্কৃতির ভান্ডারতো বটেই। তবে সমাজ আশ্রয়ী ও ভাব-ব্যঞ্জনায় বৈচিত্র্যমন্ডিত নাট্য ভঙ্গিমায় পরিবেশিত গম্ভীরার আবেদন ও আর্কষণ সর্বজনবিদিত। গ্রামীণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আঙ্গিকে রুপায়িত এ গানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণ মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হয়, কথা বোঝে, মনে ধারণ করে এবং পরে পালন করে। অর্থাৎ এ লোকনাট্য শুধু বিনোদন দেয় না, এটা জনগণকে বিভিন্ন সামাাজিক অসঙ্গতি-কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দেয়। মানুষকে সচেতন করে, আচরণিক পরিবর্তন ঘটায়। যদিও গম্ভীরার জন্ম হয়েছে সারা বছরের সুখ-দুঃখের কাহিনী বর্ণনাত্মক গীত হিসেবে। বৈশাখ মাসে ভোলা বা শিবকে ‘নির্বিকার দর্শক’ হিসেবে নিয়ে গণমানুষের সারা বছরের সুখ-দুঃখের কাহিনী গীতের ছড়া-ছন্দে পরিবেশন করা হতো। এজন্য গম্ভীরা ‘শিবপূজা’ বা ‘শিবের গজন’ নামেও পরিচিত ছিল অবিভক্ত বাংলায় বিশেষ করে মালদহে। উল্লেখ্য যে, ভারত ভাগের পূর্বে বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ মালদহের আধীনে ছিল। প্রদ্যোত ঘোষ তাঁর ‘গম্ভীরা, লোকসঙ্গীত ও উৎসবঃ একাল ও সেকাল’ (১৯৬৯, কলকাতা) গ্রন্থে বলেন গম্ভীরা পূজা উৎসব হিসেবেই প্রচলিত ছিল এবং এর উদ্ভব দেড় হাজার বছর পূর্বে বলে অনুমান করা হয়। তবে গম্ভীরার সাথে পূজার এখন বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। গম্ভীরা এখন বিনোদনের পাশাপাশি উন্নয়ন যোগাযোগের অন্যতম হাতিয়ার, লোকজ মাধ্যম বা দেশজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উন্নয়ন যোগাযোগ ধারণাটি আলোচনা করলে গম্ভীরা কীভাবে এর হতিয়ার হিসেবে উন্নয়ন বার্তা প্রচারে ভুমিকা পালন করে তা বোঝা যায়।
সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যুগে যুগে মানুষ যোগাযোগ কৌশল প্রয়োগ করে। অর্থাৎ ‘সংঘবদ্ধ সমাজের মতোই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যোগাযোগ পুরনো। এ যোগাযোগ সড়ক, রেল, বিমান যোগাযোগ(communications ) নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, মানবীয় যোগাযোগ (communication)। দার্শনিক ও শিক্ষক, মানব কল্যাণকামী আধ্যাত্মিক গুরুগণ এবং সামাজিক আন্দোলনের নেতত্বদানকারী সকলেই সমাজের আচরণিক রীতি ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্নভাবে যোগাযোগ কৌশলকে ব্যবহার করতেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও যোগাযোগকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দীর্ঘকাল থেকে। যোগাযোগ হচ্ছে তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া। এক ব্যক্তির সাথে আরেক ব্যক্তি, কয়েকজন ব্যক্তি বা বহু ব্যক্তির মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানই যোগাযোগ। পুরো দেশ বা বিশে^র জনগণের মধ্যেও যোগাযোগ হতে পারে। যখন এ ধরনের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোন বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় তখন গণমাধ্যমের প্রয়োজন পড়ে। যেমন এক সময় মানুষ জানতো না যে ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খেতে হবে। সারাদেশে এ বার্তা প্রচারের জন্য সরকার ও এনজিও উদ্যোগ নেয়। এরপর গণমাধ্যমসহ এনজিও‘র কর্মীগণ সারাদেশে এ বার্তা প্রচার করে। প্যাকেট স্যালাইন না থাকলে এক চিমটি লবণ, একমুঠো গুড় আধাসের বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে স্যালাইন তৈরির ফর্মূলা জনপ্রিয় করে জনগণকে সচেতন করে। সচেতন হলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণিক পরিবর্তন হয় অর্থাৎ ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন পান করে। এইভাবে জানানো, সচেতন করা, দৃষ্টিভঙ্গিও আচরণিক পরিবর্তন ঘটানোর কাজটি করে উন্নয়ন যোগাযোগ। অর্থাৎ যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে যখন উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বা মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার হয় তখন তাকে উন্নয়ন যোগাযোগ বলে। ‘আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য যোগাযোগ দক্ষতা, মাধ্যম, মনোভঙ্গি এবং কৌশলের পরিকল্পিত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রয়োগই হচ্ছে উন্নয়ন যোগাযোগ।’ উন্নয়ন যোগাযোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা। এটা শুধু মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটিয়ে তার পরিপূর্ণ স্বক্ষমতার বিকাশ সাধনের যোগাযোগ প্রচেষ্টা। মূলত সামাজিক সচেতনতামূলক যোগাযোগই উন্নয়ন যোগাযোগ।
সাধারণভাবে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভাটসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বলা হয় উন্নয়ন হয়েছে। কৃষি ও শিল্পে আধুনিকায়নের মাধ্যমে সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি হলে বলা হয় উন্নয়ন ঘটেছে। কারণ এর ফলে সকল শ্রেণির মানুষের উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ঘটে এবং জীবনমানের সন্তোষজনক উন্নতি হয়। এসব অবশ্যই উন্নয়নের প্রধান অঙ্গ ও অনুসঙ্গ। কিন্তু উন্নয়ন যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের আচরণিক পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হলে সেটাও উন্নয়ন। তবে তা অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো চোখে পড়ে না, দৃশ্যমান হয় না। যেমন রোগ-বালা-অসুস্থতার নিরময়ে হাসপাতাল তৈরি হয়। চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এটা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আর আপনি কোন মাধ্যমে (আন্ত:ব্যক্তিক মাধ্যম, লোকজ মাধ্যম বা গণমাধ্যম) জেনেছেন যে বসি-পচা খাবার খাওয়া যাবে না। খেলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবেন। এ বার্তা জানার পর বসি-পচা খাবার খাওয়া বন্ধ করলেন। আপনাকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হলো না। আবার আক্রান্ত হয়ে খাবার স্যালাইন পান করলেন, চিকিৎসা নিলেন, সুস্থ হলেন। এক্ষেত্রে আপনার জ্ঞানগত, দৃষ্টিভঙ্গিগত ও আচরণিক পরিবর্তন হয়েছে। এভাবে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার যদি কমে যায় তাহলে এক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে বলা যায়। আবার আপনি অনেক বড় উন্নয়ন প্রকল্প হতে নিলেন। সারাদেশে হাঁস-মুরগী পালনের মাধ্যমে গরীব জনগণকে স্বাবলম্বী করার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এজন্য টাকা-পয়সা বিতরণ করলেন কিন্ত কীভাবে হাস-মুরগী পালন করতে হবে, রোগ-বালা থেকে মুক্ত রাখতে হবে তা এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জানালেন না। রোগ-বালায় আক্রান্ত হয়ে সকল হাঁস-মুরগী মারা গেল। পুরো প্রকল্প ব্যর্থ। গরীবরা স্বাবলম্বী হওয়াতো দূরের কথা তাদের বিনিয়োগকৃত শ্রম ও অর্থ মাটিতে চাপা পড়লো। কিন্তু যদি আপনি উন্নয়ন যোগাযোগ কৌশল গ্রহণ করে সঠিকভাবে হাঁস-মুরগী পালনের বার্তা পোঁছে দিতেন তাহলে এ উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো না।
উন্নয়ন যোগাযোগের জনক ও আইরিশ লেখক আর্সকাইন চাইল্ডারস (Erskine Childers’) এসব বিষয়ের ওপর প্রথম গুরুত্ব দেন। ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে ভারত, তানজানিয়া ও মিসরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে চাইল্ডারস বলেন, ‘যেকোনো টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য জনগণ ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অপরিহার্য।’ ১৯৬৭ সালে চাইল্ডারস ও তার সহধর্মিনী থাইল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী মালিকা ভজরথন কর্তৃক গৃহীত প্রকল্প ‘ডেভলপমেন্ট সার্পোট কমিউনিকেশন সার্ভিস ইন ব্যাংকক’ এর নীতিপত্রে চাইল্ডারস বলেন, ‘বুদ্ধিদীপ্তভাবে নকশাকৃত এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় গৃহীত কোন উদ্ভাবনও উন্নয়ন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা যোগাযোগ করা হয়েছে। উন্নয়নের জন্য বস্তুগত সম্পদের নির্মাণ সফল হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এ সকল সম্পদ ব্যবহারের জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় নতুন কৌশল ও পারিপার্শ্বিক পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিগত উদ্ভাবন যোগাযোগ করা হয়েছে। চাইল্ডারস বলেন, ‘উন্নয়ন যোগাযোগ জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন বার্তা প্রেরণ করে।’
চল্লিশের দশক থেকে উন্নয়ন যোগাযোগ ধারণাটি পরিচিত হতে থাকে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর প্রায়োগিক ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়। পঞ্চাশের দশকে যোগাযোগবিদ ড্যানিয়েল লার্নার, উইলবার শ্র্যাম এবং ইভারেট এম রজার্সের প্রচেষ্টায় উন্নয়ন যোগাযোগ একাডেমিক পঠন-পাঠনেও অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন যোগাযোগ ধারণাটির ব্যবহার করা হয় না।
উন্নয়ন যোগাযোগের প্রয়োগে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি উপাদান--সামাজিক যোগাযোগ, শিক্ষামূলক যোগাযোগ ও প্রতিষ্ঠানগত যোগাযোগ--কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ হচ্ছে এমন একটি যোগাযোগ প্রক্রিয়া যা সমাজের জনগণেরে মধ্যে সংলাপ ও মিথষ্ক্রিয়া, অনুচিন্তা, অংশগ্রহণ, ঐকমত্য স্থাপন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিবর্তনের কর্মপন্থা বিকাশে সহায়তা করে। এটা সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উপলব্ধি ও বিশ্বাস অর্জনে জনগণ ও সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তাকারী যোগাযোগ প্রক্রিয়া। সামাজিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গম্ভীরা ব্যবহৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এনজিওগুলো এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভুমিকা পালন করছে। অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম, ফ্লিপ-চার্ট, স্থানীয় গণমাধ্যম, সনাতন মাধ্যম যেমন- নাটক, পথ নাটক, গান, নাচ প্রভৃতি মাধ্যমও ব্যবহার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ায়।
উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন উন্নয়ন যোগাযোগ মাধ্যমের প্রয়োজন। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গণমাধ্যম, লোকজ মাধ্যম এবং বিভিন্ন আন্তঃব্যক্তিক চ্যানেল ব্যবহার করা হয়। পূর্বে উন্নয়ন যোগাযোগ ছিল একমুখী ও গণমাধ্যম নির্ভর। সত্তরের দশকে এসে উন্নয়ন ধারণার পরিবর্তন ঘটে। এ সময় গণমাধ্যমের একক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ও উন্নয়নে দেশজ (লোকজ) মাধ্যমের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ এ দেশের দশ ভাগের প্রায় নয় ভাগ জনগণ গ্রামে বাস করে। এদের মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ অশিক্ষিত ও পাঁচ ভাগের চার ভাগ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। প্রায় ৫৬ শতাংশ লোকই অশিক্ষিত। যে ৪৪ শতাংশ লোক শিক্ষিত তাদের অনেকে আবার গণমাধ্যমের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের একেক অঞ্চলে একেক লোকজ সাংস্কৃতিক মাধ্যম বেশি জনপ্রিয়। গম্ভীরা, পথনাটক, পুঁথিপাঠ, কবিতা, সাপখেলা, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল, গজল, শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তন, পুতুল নাচ, লোকসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, মানসী, বারোশ সঙ্গীত, বাউল গান, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতী, মাইজভা-ারী, লালন, আদিবাসী সঙ্গীত, জারি, সারি, কবিগান, গল্পকথন ও যাত্রা প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য লোকজ মাধ্যম। কিন্তু এসকল লোকজ মাধ্যমের মধ্যে উন্নয়ন কর্মসূচীতে সচেতনতা সৃষ্টিতে গম্ভীরা ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে পরিবার পরিকলাপনাসহ স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ইস্যুতে সচেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিবেশিত গম্ভীরা সারাদেশের জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আশুতোষ ভট্রাচার্য তাঁর বাংলার লোকসাহিত্য (১ম খন্ড, ১৯৬২) গ্রন্থে বলেন, অল্পশিক্ষিত গম্ভীরা রচয়িতা বা গায়কদের প্রকাশভঙ্গি, বুদ্ধি, শ্লেষ, সংলাপ ও অলংকারের পরিচয় দেখে বহু উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি অবাক হয়ে যান। অর্থাৎ গম্ভীরা গান অন্যান্য লোকসঙ্গীত অপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও উর্দ্দীপনামূলক।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে গম্ভীরা জন্মলগ্নে পূজা অর্চনার অংশ ছিল। এ অবস্থা থেকে গম্ভীরা এখন সম্পূর্নভাবে মুক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর ধর্মের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গম্ভীরা গানকে ধর্মনিরপেক্ষভাবে জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আধুনিক গম্ভীরার জনক মোহাম্মদ সফিউর রহমান সুফি মাস্টার ও শিল্পী মোহাম্মদ সোলাইমান। তবে ওইসময় পালা গম্ভীরায় তৎকালীন সংঘটিত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও স্থান পেত। বর্তমানে গম্ভীরা এখন দুই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে পরিবেশিত হয়। এক. বিনোদন এবং দুই. শিক্ষা-বিনোদন (edutainment)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যে পরিবেশিত গম্ভীরাও শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক। শামমুজ্জামান খান ও অন্যান্যদের দ্বারা সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালাঃ চ্পাাইনবাবগঞ্জ” এ বলা হয়েছে: “লোকশিক্ষা ও সমাজ চেতনাকে জাগিয়ে তোলাই এই গানের লক্ষ্য।” অশিক্ষিত নিরক্ষর জনগণ গম্ভীরার মাধ্যমে অনেক শিক্ষা লাভ করে। কারণ এর ভাষা লোকায়ত সমাজের ভাষা। তাই এ পরিবেশনা খুব সহজেই তথ্য ও শিক্ষা দিয়ে সচেতন করে তুলতে পারে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতনতামূলক উপাদানে বর্ণিত গম্ভীরার কথা যেমন-
“স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল
এটা মিথ্যা নয় একচুল
পরিবেশ বজায় না রাখিলে
স্বাস্থ্যবিধি না মানিলে
সুস্থ জাতির চিন্তা করা ভুল।”
“গাছ লাগালে পাবে ফল
তাতে বাড়বে মনোবল
বৃষ্টি হবে যাবে খরা
মাটির ক্ষয়রোধ হবে ত্বরা
কৃষিক্ষেত্রে পাইবে সফল।”
শিক্ষা-বিনোদন তথা উন্নয়ন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম গম্ভীরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক বার্তার প্রচারে গম্ভীরা ব্যাপক ভুমিকা পালন করছে। চাঁপাইনবাগঞ্জের গম্ভীরা এখন জাতীয় সম্পদ। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে গম্ভীরা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যেমন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি তথ্য সার্ভিস গম্ভীরাকে ব্যবহার করছে।
জাতীয় ও আন্তজার্তিক বিভিন্ন এনজিও গম্ভীরাকে উন্নয়ন বার্তা প্রচারে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মনে করে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা Communication for Rural Development Sourcebook (2014) এ উন্নয়ন বার্তার বাহক হিসেবে গম্ভীরার উল্লেখ করেছে। এখানে বলা হয়েছে: In Bangladesh, for example, folk songs called gambhira are popular conveyors of developmental messages, such as those on climate change adaptation .” ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের আরেক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘Convention for the Safeguarding of Intangible Cultural Heritage’ এ স্বাক্ষর করে। এ কনভেনশন বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য ২০১৩ সালের ১৭-২০ জুলাই অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর এক ওর্য়াকশপে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে গম্ভীরার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। তবে ইউনেস্কোর ওই ওয়ার্কশপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষক তাঁর “Intangible Cultural Heritage of the Paharpur Region of Naogaon District: Recommendation for Safeguarding” শীর্ষক প্রবন্ধে গম্ভীরার অঞ্চল হিসেবে নওগাঁ জেলার নাম উল্লেখ করেছেন, চাঁপাইনবাগঞ্জ নয়। এ তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশে গম্ভীরার অঞ্চল মূলত চাঁপাইনবাগঞ্জ।
রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাগঞ্জ, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, বিশুদ্ধ পানি, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে গম্ভীরা। বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতায় গম্ভীরা পরিবেশন করা হচ্ছে। নানা-নাতির হাস্যরসের মধ্য দিয়ে সহজেই সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গম্ভীরা গান ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন এনজিও ও প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া জনসাধারণকে এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন করতে গম্ভীরাকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।
সম্পতি নির্বাচনী প্রচারে মালদহে গম্ভীরা গানের শিল্পীদের বিভিন্ন দেব-দেবীরূপে সাজিয়ে ভোট প্রচার করেছে তৃণমূল কংগ্রেস মালদহের ইংরেজ বাজার পুরসভার ১২ নং ওয়ার্ডের ওই তৃণমূল প্রার্থী জানান গ্রামের এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা গম্ভীরা শিল্পকে প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে এক মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে গম্ভীরা গান (অডিও)। মাইকযোগে গম্ভীরা গান পরিবেশন করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রচারের কার্যকারী হাতিয়ার হিসেবে গম্ভীরা ব্যবহার করা হচ্ছে তা ব্যক্তিগত প্রচারেই হোক বা সামষ্টিক উদ্দেশ্য সাধনেই হোক।
উন্নয়ন যোগাযোগের অংশ হিসেবে গম্ভীরা পরিবেশনের উদ্দেশ্যে থাকলে এর কথা (বার্তা) হয় অনেক পরিকল্পিত। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ যোগাযোগকর্মীর মাধ্যমে সমস্যা ও চাহিদা নিরূপণ এবং বিশ্লেষণের পর মানসম্পন্ন উপযোগী বার্তা প্রণয়ন করতে হয়। অতঃপর বিষয়বস্তু ও প্রকৃতি মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ, বিন্যাস ও ধারাবাহিকতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য এবং করণীয় সহজভাবে উপস্থাপন করতে হয়। এরপরই আসে এ সম্পর্কিত সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, গুরুত্ব ও অভিষ্ট্য লক্ষ্যকে সামনে রেখে যথাসময়ে সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপন এবং পরিবেশনা। ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার সঠিক চর্চার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় গম্ভীরা একাডেমি। গম্ভীরা একাডেমি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে গম্ভীরা চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এর অতীত ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখবে অনন্তকাল--এ প্রত্যাশা সকলের।
দ্রষ্টব্য: প্রবন্ধটি চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলা সমিতি, ঢাকার ২০১৬ ডাইরেক্টরিতে প্রকাশিত। প্রবন্ধটির তাত্ত্বিক দিক লেখকের ‘সাংবাদিকতাঃ অফলাইন অনলাইন’ গ্রন্থের ‘উন্নয়ন যোগাযোগঃ তত্ত্ব ও বাস্তবতা’ প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:৩১