প্রথমেই বলে রাখি, এটা কোন তাত্বিক আলোচনা বা ট্রেডিশনাল রিভিউ নয়। এটা একান্তই চলচিত্র না বোঝা, কিন্তু চলচিত্রকে ভালোবাসে এমন একজন মানুষের জবানীতে ও তার সাদা চোখে দেখা, একটি চলচিত্রের সুরত হাল।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান ছবিটি মুক্তি পেতে যাচ্ছে আজ মানে ২০ জুন ২০১৪। তবে কথায় কথায় শুনেছিলাম ছবিটি ১৩ তারিখ থেকেই বলাকা -২ তে দেখা যাচ্ছে। অবশেষে হঠাৎ বিকেলের দিকে অগ্রজ রুবেল ভাই (তির্থক আহাসান রুবেল) এর ফোন। ‘রিফাত যাবা নাকি নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ দেখতে। কবি নির্মলেন্দু গুণ আসতেছে। স্পেশাল শো।’ অতঃপর না করার কোন প্রশ্নই আসে না। চলে গেলাম বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডে । সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ এর শো। হলে ঢোকার আগেই, দেখা নেকাব্বর ওরফে জুয়েল জহুর এবং কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে। শরীর বুড়ো হলেও মন বুড়িয়ে যায় নি বলেই মনে হলো। যাই হোক এর পর সোজা হলে।
ছবির শুরুতেই দেখি একটি স্টেশন একটি ট্রেন থেকে মেরুন রঙের পাঞ্জাবিতে নামছেন প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুন। একটু দূরে একদল মানুষের জটলা, তার মাঝে একটা শীর্ণ মানুষের পা দেখা যাচ্ছে, তার উপর ভন ভন করছে অনেক অনেক মাছি। কবি এগিয়ে গেলেন, সে পায়ের দিকে লক্ষ্য করে। কবি দেখলেন, হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন, এবং ফিরে এসে বসলেন স্টেশনের এক পুরোনো বেঞ্চে, আর বাধের ঝোলা থেকে বের হলো, একটা ছোট্ট কিন্তু গোছালো স্পাইরাল খাতা। কবি চশমাটা খুলনেন, হাত দিয়ে মুছে নিলেন তাঁর চোখ ও কপাল টা। এর পর লিখতে শুরু করলেন। নেকাব্বরের মহা প্রয়াণ।
এর পর ক্যামেরার পথ অনুসরণ করে আমরা চলে যাই ষাট-সত্তুরের দশকের পূর্ব বাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের দিকে। সেখানেই আমাদের দেখা হয় তরুণ নেকাব্বর ও তরুণ কবি ও ছাত্র নেতা নির্মল (নির্মলেন্দু গুণ) এর সাথে।
আগেই বলে রাখা ভালো, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ কে অনেকেই বলছেন, মুক্তি যুদ্ধের সিনেমা। কিন্তু আমি ব্যাক্তিগত ভাবে তা মনে করি না। আমার মতে নেকাব্বরের মহা প্রয়ান হলো ষাট ও সত্তুরের দশকের বাংলাদেশে কে ধারণ করে এমন একটি চলচিত্র রূপী তথ্য চিত্র। কারণ এখানে তুলনামূলক ভাবে চলচিত্রের গল্পের থেকে আমার ক্যামেরায় ধরা পড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও তার পারিপার্শ্বিক ডিটেইল গুলো কে বেশি ভালো লেগেছে।
যাই হোক, নেকাব্বর গ্রামের ভুমিহীন কৃষক, তালুকদারের জমিতে বর্গা চাষ করে। ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বলতে আছে একটা বসত ভিটা, একটা ষাড় ও নিজের এক খানা নাঙল। নেকাব্বরের দেহাবয়ব এখানে যা দেখানো হয়েছে তাতে আমাদের মনে পড়তে বাধ্য পৌরাণিক গ্রীক দেবতাদের। নেকাব্বরের প্রেমিকা ফাতেমা (নায়িকা শিমলা)। ছবির শুরুতেই দেখতে পাই নেকাব্বরের সাথে ফাতেমার শরীরি প্রেমের দৃশ্য। এর পর ছবির আরো অনেক জায়গায় দেখানো হয়েছে এই শারীরি প্রেমের দৃশ্য। যদিও প্রথমে ব্যপার টা আমার কাছে ভালো ঠাকছিলো না। কিন্তু দিন শেষে বোঝা যায় ছবির প্রয়োজনেই এটা করা হয়েছে। সে যাই হোক। ফাতেমার বাবা তালুকদারের লোক, আর ফাতেমা নেকাব্বরের মাঝে প্রেম, আবার নেকাব্বর করে কৃষক আন্দোলন। কৃষক সমিতি। ‘নাঙ্গল যার জমি তার।’ এই স্লোগানের মাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে তৎকালীন ভগ্ন সমাজ ব্যবস্থা ও মানুষের জেগে ওঠার গল্প কে।
এর পর গল্প এগিয়ে যাত তার নিজের নিইয়মেই। এক সময় কৃষদের বিদ্রোহ করতে হয় তালুকদারের বিরুদ্ধে। এ দিকে ফাতেমার প্রতিও নজর পরে তালুকদারের। তবে ব্যপার হলো এ সময় গল্প টা খুব ধিতেই এগিয়েছে। গল্পের চেয়ে এ সময় ল্যান্ডস্কেপ গুলো বেশি টেনে ধরেছে। সে সাথে হারিয়ে যাওয়া পোষাক, কৃষকের জমিতে বোনা ধানের ক্রমশ বেড়ে ওঠা, গ্রামের লাঠিয়াল ভিলেজ পলিটিক্স সব ই উঠে এসেছে।
এমন সময় জমিদার কে মরারা অভিযোগে মামলা হয় নেকাব্বরদের বিরুদ্ধে। তাই বাধ্য হয়ে নির্মলের সাথে নেকাব্বর কে পালিয়ে আসতে হয় ঢাকা শহরে এবং তা ফুলবাড়ী স্টেশনে। আর নেকাব্বর কে থাকতে হয় ঢাকার বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং এ। মামুন সাহেবের (গায়ক শেখ শাহেদ) কাছে। শাহেদ ভাই এর চরিত্র টা সামান্য সময়ের জণ্য হলেও অনবদ্য। আর এখান থেকেই মূল সিনেমায় প্রবেশ করে নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান। এর গাএ টুকুকে সিনেমার আদলে তথ্য চিত্র বলাই ভালো। এ সময় দেখা যায়, মানুষের মাঝে পাকিস্তান বিরোধিতা সে সাথে গ্রামের কৃষকের মাঝে লড়ায়ের স্পৃহা ও নিজের ভূমির প্রতি ভালোবাসা।
এর পর নেকাব্বর গ্রামে ফিরে যায় ফাতেমার সাথে দেখা করবে বলে। সিদ্ধান্ত হয় পরের দিন ভরেই ফিরে আসবে শহরে। কিন্তু শহরে আর ফিরে আশা হয় না নেকাব্বরের। যুদ্ধ শুরু হয়, এবং যুদ্ধের মাঝেই হারিয়ে যায় নেকাব্বর। এর মাঝে যুদ্ধ টাকে দেখানোপ হয় মাত্র ৩-৪ মিনিট।
এর পরের গল্প ৪২ বছর পরের। শাহাবাগে জন্ম নিয়েছে গণ বিস্ফোরণ গণ জাগরণ। সে সময় দেখা যায় এক বৃদ্ধকে। একটি পা নেই। পরনে ছেড়া ময়লা পাঞ্জাবি। ছিন্নমূল মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি হেটে যাচ্ছেন হোসেন শহীদ সরয়োয়ার্দী উদ্যানের মাঝ দিয়ে। পার্কের লাল দেয়ালে টানানো মুক্তি যুদ্ধের ছবি। ছবি দেখতে দেখতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। অদূরেই একজন কবি, কিছু ছেলে মেয়েকে নিয়ে বসে কবিতা পাঠ করছেন। সেদিকেই এগিয়ে যায় সেই বৃদ্ধ। যেয়ে প্রশ্ন করে কবিকে ‘তুমি নির্মল না?’ কবি চিনতে পারেন তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু নেকাব্বর কে। এর পর অনেক কথার পর নেকাব্বর ফিরে যায় তার গ্রামে, যেয়ে দেখে সব বদলে গেছে, তার নিজের ভিটা চলে গেছে নদীতে। ফাতেমা ধর্ষিত হয়েছিলো ৭১ এ। যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় ফাতেমা। ফাতেমার জন্ম দেয়া ছেলেটি পাগল। নেকাব্বর তাকে দেখে, এবং তার মাঝে জেগে ওঠে ফাতেমার প্রতি ভালোবাসা অথবা পিতৃত্ব। এবং এর পর দেখা যায় নেকাব্বর মরে পড়ে আছে স্টেশনে। এবং কবি ও নেমেছেন সেই স্টেশনে...।
সিনেমার দূর্বলতা হলো গল্প টা অনেক ধীর গতিতে এগিয়েছে। সিমলার কথা বার্তায় শহুরে টান স্পষ্ট ছিলো। এ ছাড়া সহ অভিনেতাদের অভিনয় সামান্য জড়তা চোখে পড়ে। তা ছাড়া গল্প গুলো অনেক টাই ছাড়া ছাড়া। ও গল্প বলার ধরণ টা দূর্বল। এবং এটা সিনেমা হয়ে উঠেছে শেষ ৩০-৪০ মিনিট। তবে তরুণ নেকাব্বর ও তরুণ নির্মলের অভিনয় বেশ ভালো হয়েছে। আমার মতে নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান হলো বাংলাদেশ কে নিয়ে বলা গল্প। এটাকে কোন ভাবেই মুক্তি যুদ্ধের ছবি বলতে আমি রাজি নই। আমি বলতে চাই এতা একটা প্রেমের ছবি, বাংলাদেশের ছবি। মানুষের আকাঙ্খার ছবি।ছবির গান গুলোও অসাধারণ। আমি এ ছবিকে ৭.৯ দেবো ১০ এর মাঝে।
ধন্যবাদ মাসুদ পথিক ও তার কলা কুশলীদের এ ধরনের একটি ছবি আমাদের উপহার দেবার জন্য। এবং ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকার কে। এ ধরণের তথ্য নির্ভর ছবি গুলোতে অনুদান দেবার জন্য।
"নেকাব্বর জানে তাঁর সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না
কেউ কোনোদিন।
এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন, 'কী কইরা
পালবা আমারে,
তোমার কী আছে কিছু তেনা?'
সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু'হাতে বুকে পিষে
বলেছিল নেকাব্বর;
'আছে, আছে, লোহার চাককার মতো দুটা হাত,
গতরে আত্তীর বল - আর কীডা চাস্ মাগী।'
'তুমি বুঝি খাবা কলাগাছ?'
আজ এই গোধুলিবেলায় প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালা চোখে নিয়ে
নেকাব্বর সহসা তাকালো ফিরে সেই কলাবাগানের গাঢ় অন্ধকারে।
তিরিশ বছর পরে আজ বুঝি সত্য হলো ফাতেমার মিষ্টি উপহাস।
পাকস্থলি জ্বলে ওঠে ক্ষুধার আগুনে, মনে হয় গিলে খায়
সাজানো কদলীবন,'
যদি ফের ফিরে পায় এতটুকু শক্তি দুটি হাতে, যদি পায়
দাঁড়াবার মতো এতটুকু শক্তি দুটি পায়ে।
কিন্তু সে কি ফিরে পাবে ফের?
ফাতেমার মতো ফাঁকি দিয়া সময় গিয়েছে ঢের চলে।
কারা যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে সব শক্তি তার।
বিনিময়ে দিয়ে দেছে ব্যাধি, জরা, দুর্বলতা, বক্ষে ক্ষয়কাশ-
অনাদরে, অনাহারে কবরে ডুবেছে সূর্য, ফাতেমার তিরিশ বছর।
এখন কোথায় যাবে নেকাব্বর?
হয়তো গিলেছে নদী তার শেষ ভিটেখানি, কবর ফাতেমা-
কিন্তু তার শ্রম. তার দেহবল, তার অকৃত্রিম নিষ্ঠা কারা নিলো?
আজ এই গোধুলিবেলায় এই যে আমার পৃথিবীকে মনে হলো পাপ,
মনে হলো হাবিয়া দোজখ - কেউ কি নেবে না তার এতটুকু দায়?
মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চায় না সুদুরে চলে যেতে, নেকাব্বর ভাবে,
অজানা অচেনা স্বর্গে বুঝি মেটে বাস্তবের তৃষ্ণা কোনোদিন?
তবু যারা চায়, তারা কেন চায়? তারা কেন চায়? কেন চায়?
নেকাব্বর শুয়ে আছে জীবনের শেষ ইস্টিশনে। তার পচা বাসী শব
ঘিরে আছে সাংবাদিক দল। কেউ বলে অনাহারে, কেউ বলে অপুষ্টিতে,
কেউ বলে বার্ধক্যজনিত ব্যাধি, - নেকাব্বর কিছুই বলে না। "
আজ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে বলাকা সিনেওয়ার্ল্ড ২, খুলনার ময়ূরী, নরসিংদীর রাজমণিহার, নেত্রকোনার হীরামন প্রেক্ষাগৃহে। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখতে হলে একবারের জন্য এ ছবিটি দেখে আসুন।