আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি (quoted in Gurtov, 1974, p 86), ম্যালথাসের দেশ ( Robinson, 1974, p 64), ভূমিদাসের দেশ ( Stepanek, 1979), উন্নয়নের টেস্টকেস (Faaland and Parkinson, 1976), পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রামীণ বস্তি (Burrows, 1947), দুবৃত্তদের দেশ, দুর্নীতির দেশ ইত্যাদি অভিধায় বাংলাদেশ; আর আরামপ্রিয়, ধীরগতির জীবনধারায় অভ্যস্ত, সৃজনশীল উদ্যমে বিমুখ, যুক্তিবিমুখী, বিস্মরণশীল, কর্মে নিরাসক্ত কিন্তু অর্থের প্রতি লালায়িত, আত্মকেন্দ্রিক, পরনিন্দাচর্চায় উৎসাহী, কলহপ্রিয়, হুজুগপ্রিয়, অলস, কুটিল, ঈর্ষাপরায়ণ, পরনির্ভরশীল, রক্ষণশীল ইত্যাদি বিশেষণ নিয়ে বহির্বিশ্বে এদেশের মানুষের সাধারণ পরিচিতি। পরিচিতি রয়েছে বাঙালির মস্তিষ্কের উর্বরতা ও তার অপব্যবহার নিয়েও। একইসঙ্গে প্রসঙ্গত যে উল্লিখিত ধারণাপুঞ্জ কেবল বিদেশীরাই নয়, বাঙালি বা এদেশের মানুষ নিজেদের নিয়েও সমধরনের ধারণা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। সুযোগ পেলে বাঙালিরাও একজন আরেকজনকে শালা বাঙালি’ বলে গালি দেয়। সে গালি কখনো আপন মনে কখনো অন্যকে শুনিয়ে দিয়ে থাকে। কখনো কখনো মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে এদেশে জন্ম নেয়াকে আজন্ম পাপ’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
অথচ জাতি হিসেবে বাঙালিদের অন্তত ৫ হাজার বছরের সমৃদ্ধ দালিলিক ইতিহাস রয়েছে। তারা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে কৃষি, শিল্প-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যে। এ জাতির কৃষ্টি ও ধর্ম এক কথায় সভ্যতার বিভিন্ন দিক উপমহাদেশ শুধু নয় বিশ্বের বহু দেশে প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এ ইতিহাস এখন বহুলাংশেই বিস্মৃতির অন্ধকারে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু অঞ্চলে, ক্রীটে, সিংহলে, ভারতের নানা জায়গায় বাঙালিদের যোগাযোগ ছিল। সেই ঐতিহাসিক যুগের এক পর্যায়ে বাঙালিরা পাঞ্জাব সীমান্ত থেকে বার্মা সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে ক্ষমতা বিস্তার করেছে। বাঙালিরা তখন নির্মাণ করেছে বিশাল বাণিজ্য-পোত। তারা বাণিজ্য করতে গেছে পশ্চিম ভারতে (সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে), সুমেরে, সিংহলে, ভূমধ্যসাগরের ক্রীট দ্বীপে, মিশরে, রোমে, জাভা ও ইন্দোনেশিয়াসহ আরো অনেক দেশে। কৌটিল্য প্রণীত অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে বাংলায় পশম বস্ত্রের তথা বিখ্যাত সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে। এসব বস্ত্র বহু দেশে রপ্তানী হতো।
কেবল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নয় বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষায় এই ভূখন্ড বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় পাল যুগে নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি ইত্যাদি অঞ্চলে গড়ে ওঠা উন্নতমানের শিক্ষাকেন্দ্রর কথা। বিহার নামে পরিচিত এসকল প্রতিষ্ঠান ছিল বর্তমান যুগের বিশ্ববিদালয়ের মতো। দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। প্রজ্ঞা ও শিক্ষার কারণে বাঙালি মনীষী অতীশ দীপঙ্কর চীনাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। প্রখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বেতারযন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যদিও যোগাযোগ ব্যস্থার সমস্যার কারণে তিনি যথাসময়ে বিশ্বদরবারে তাঁর এ উদ্ভাবন তুলে ধরতে পারেননি। জানা যায়, কম্পিউটার নির্মাণের ভাবনাও তাঁর মধ্যে ছিল। তিনিই প্রথম উদ্ভিদের প্রাণ আছে এ তত্ত্ব ব্যাখ্যা-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পল্লী-প্রধান বাংলাদেশের অর্থে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায়, সুলতানী আমলে সৌদিআরবের মক্কা-মদীনায় বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার খয়রাতি সাহায্য পাঠানো হত, এমনকি ৩০ এর দশকেও এদেশ থেকে সৌদি আরবে সাহায্য পাঠানো হয়েছিল। ইবনে বতুতা ও বার্নিয়ারসহ মধ্যযুগের বিভিন্ন ভিনদেশী পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তান্তে সে সময় এদেশের মানুষের সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে, আজ যারা এদেশ ও এদেশের মানুষকে নিয়ে উপহাস করে এবং এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন কৌশলে বেঁধে রাখার প্রয়াস চালায় সেই ইউরোপ-আমেরিকা সভ্যতার মাপকাঠিতে তখন ছিল অন্ধকারে। বিভিন্ন কলা-কৌশলে এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও দেশের মানুষকে অন্যায় শোষণের মাধ্যমে তারা আজ স্ফীত। আর তাদের উপনিবেশের শিকার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশ আজ তাদের সাহায্যপ্রার্থী।
আবার আধুনিক সভ্যতার প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি অর্থনীতি ও উন্নয়ন নিয়েও ভেবেছে। বাঙালিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় প্রথম অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এ আলোচনায় তিনি সুপারিশ হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় সংকোচন এবং ব্রিটিশদের এদেশে পুঁজি বিনিয়োগের কথা বলেছেন। তৎপরবর্তীকালে অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনায় বিদেশি পুঁজি আমদানীর মাধ্যমে এদেশের শিল্পসহ সামগ্রিক উন্নয়নের কথা বলেছেন। পল্লী বাংলার কৃষকের দুর্দশা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। রাজা রামমোহন এবং বঙ্কিমচন্দ্রের এ পল্লীভাবনা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন একটি গ্রাম জাগলে একটি দেশ জাগবে’।
তিনি এদেশের উন্নয়ন, বিশেষকরে পল্লী উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়েই তিনি পল্লীর উন্নয়নে পল্লীবাসী কৃষকদের জন্য পৃথক ব্যাংক গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর পল্লী সমাজ, বামুনের মেয়ে প্রভৃতি উপন্যাসে, মীর মশাররফ হোসেন তাঁর জমিদার দর্পনসহ অন্যান্য নাটকে, দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নীল দর্পনসহ বিভিন্ন নাটকে ইংরেজ ও তাদের দোসর-দালাল জমিদারদের অত্যাচার ও পল্লীবাসী কৃষকদের দুর্দশার নিখুত চিত্র তুলে ধরেন। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর ইকোনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ নামক দু’খন্ডের গ্রন্থে ব্যবসার নামে এদেশ থেকে ইংরেজদের সম্পদ পাচারের সমালোচনা করেন। ১৯১৬ সালে রাধাকোমল মুখোপাধ্যায় তাঁর দারিদ্রের ক্রন্দন’ গ্রন্থে বাঙালির, বিশেষকরে বাঙালি কৃষকদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং এ দুরাবস্থা দূর করার বিভিন্ন উপায় তুলে ধরেন। ১৯৪১ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা সম্বলিত আবদুল হাকিমের গ্রামের উন্নতি’ নামক গ্রন্থে পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ গ্রন্থের ভূমিকায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বলেন, বাঙলার শতকরা নব্বই জন লোক গ্রামবাসী, কাজেই গ্রামের উন্নতিতেই সারা বাঙলার উন্নতি।’
এরপর ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে দুই দফা স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত ও দাতা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ আখ্যায়িত হয় উন্নয়নের একটি টেস্ট স্টেট’ হিসেবে। উন্নয়নের বিভিন্ন তত্ত্ব ও কৌশল বাস্তবায়নের পরীক্ষাগার হিসেবে পরিণত হয় বাংলাদেশ। বিশেষকরে আধুনিকীকরণ তত্ত্ব এবং নির্ভরশীলতা তত্ত্ব। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে একের পর এক গ্রন্থ রচিত হতে থাকে। বিভিন্ন অভিধায় আখ্যায়িত করা হয় এদেশকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ১৯৭৬ সালে জাস্ট ফালান্ড এবং জে.আর পারকিনসন কর্তৃক রচিত Bangladesh : The Test Case of Development গ্রন্থটি। এতে লেখক ও গবেষকদ্বয় বুঝাতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশের উন্নয়ন খুব জটিল ব্যাপার এবং এদেশে উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তাঁরা এদেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশী সাহায্যের অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেন। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আরও একধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছিলেন একটি বাস্কেট কেস বা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে। এসকল মন্তব্যের অন্তরাল উদ্দেশ্য যে বাংলাদেশের দারিদ্র জিইয়ে রেখে তা থেকে সুবিধা আদায় করা তা সামান্য সচেতনতাবোধ থেকেই উপলব্দি করা যায়। বিদেশীদের পাশাপাশি এ সুবিধার অংশভাগী এদেশের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিক এবং উন্নয়নকর্মীরাও। এ প্রসঙ্গে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. খুরশিদ আলম বলেন, দারিদ্রের সুফল রয়েছে অনেক যেমন তা আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিকসহ বিভিন্ন কাজে লাগে। দারিদ্র এক বিরাট সম্পদ যার মালিকানা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে মাঝে-মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ বা মান-অভিমানও চলতে দেখা যায়।
তবে ধীরে হলেও বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশ সম্পর্কিত উন্নত বিশ্বের ধারণাগুলো ভ্রান্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশিত অগ্রগতি লাভ করতে না পারলেও ক্রমশ সে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, কেননা এদেশের শিকড় প্রোথিত একটি সমৃদ্ধ ও সংগ্রামী সভ্যতার ইতিহাসে। বাংলাদেশ আধুনিক বিশ্বের হানেগোনা কয়েকটি দেশের একটি এবং দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যে-দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এদেশের হাজার বছরের ইতিহাস প্রকৃতির রূঢ়তার বিরুদ্ধে আপামর মানুষের জীবনপণ সংগ্রামের ইতিহাস। জাতি হিসেবে বাঙালিদের রয়েছে অপার সৃজনশীলতা, সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি, অসীম উদ্যম ও আন্তরিকতা। ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালে এবং বিভিন্ন করালগ্রাসী প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবেলায় এদেশের মানুষ তাদের পরীক্ষিত ভুমিকা পালন করেছে। বারবার তারা প্রমাণ করেছে- সীমাহীন সংকটেও এদেশের মানুষ ঘাবড়ে যায় না, উঠে দাঁড়ায়, মোকাবেলা করে। উন্নয়নের নামে উন্নতবিশ্ব ও বিভিন্ন স্বার্থবাদী দাতাসংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, কতিপয় স্থানীয় সুশীল সমাজের পরিকল্পনা-কর্মসূচি-কার্যক্রম এবং অদূরদর্শী রাজনীতিকদের মাধ্যমে এদেশকে ব্যর্থ প্রমাণিত করার চেষ্টা করলেও এদেশের মানুষ তাদের অসাধারণ উদ্ভাবনীশক্তি, শ্রম ও ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী ঐক্যের মাধ্যমে এদেশ ও এদেশের মানুষকে নিয়ে উন্নত বিশ্বের উপহাস-বিদ্রুপ উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।