রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) গত হয়েছেন প্রায় সত্তর বছর আগে। রবীন্দ্রনাথের সময় বাঙলা কবিতা যখন, রবীন্দ্রনাথ নামক সূর্যটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছিল, তখন ঊনিশো ত্রিশের দশকে পঞ্চ পান্ডবের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা বাঙলা কবিতাকে রাবীন্দ্রিক ভাব অর্থাৎ, রোম্যান্টিকতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক করে তুলেছিলেন --কবিতার যে ধারাটি বর্তমানে বহমান। ওটা ছিলো কবিতার বিপ্লব। ওখানে কোনো অশ্লীলতা ছিলো না, ছিলো সময়ের দাবী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে শুরু হয় অশ্লীলতা, যা মাঝে মাঝে এখনও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে চায়।
১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে যে নীতি ও কর্মপন্থা গৃহীত হয়, তার অনুসরনেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া বলা হয়। তখন প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া বলেই কমিউনিস্টরা ক্ষান্ত হয়েছিল, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের দিকে লোমশ হাত বাড়ায় নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান বলেন, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় সংহতির প্রয়োজনে আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত !
বিশশতকের প্রথমার্ধ থেকেই বাঙালি মুসলমানের মাথায় একটি অদ্ভুত প্রশ্ন দেখা দিতে থাকে----সেটি হচ্ছে তাঁরা বাঙালি নাকি মুসলিম। বর্তমানেও অনেকের মাথায় এই অদ্ভুত প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে আমি যে জায়গাটিতে থাকি, ওই জায়গার বাঙালি মুসলমান অদ্ভুত প্রশ্নটির উত্তর পেয়ে গেছেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে মেনে নিয়েছেন যে, তাঁরা একদম খাটি মুসলমান। তাঁদের পোশাক, তাঁদের ভাষা, তাঁদের আচরণ সবকিছুতেই তাঁরা হয়ে ওঠছেন খাঁটি মুসলমান। তাঁদের কক্ষে গেলে দেখা যায় তাঁদের টেবিলে আছে পাঠ্যসূচিভিত্তিক বই, আর সেলফে তাকে তাকে সাজানো আছে মোখ্ছুদুল মোমেনিন, বেহেশতি জেওর, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, মরনের আগে ও পরে, হরেক রকমের সহীহ্ হাদীছ, কোরআন ইত্যাদি। এর বাইরে উনারা কখনো কোনো বই পড়েন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ঐ সকল মুসলমানের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ বুঝা ত দূরের কথা, পাঠই অসম্ভব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ না পড়েই অহরহ বকে যান রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বড় রকম বিতর্ক দেখা দিয়েছিলো ১৯৬১ সালে। সারা বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রশতবর্ষের আয়োজন হচ্ছে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা স্বদেশে তা করতে দিতে চায় নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বলে বাঙলা একাডেমিও এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিলো না। ফলে বেসামরিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে কিছু লেখ সংগঠন ও প্রেসক্লাবের কিছু সংগঠনের সমন্বয়ে একত্রে কিছু কর্মসূচি পালিত হয়। তখন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়, মাসের পর মাস ধরে জন্মশতবর্ষ পালনের বিরূদ্ধে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লেখা হয়। বলা হলো রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের কবি, বলা হলো পাকিস্তানকে নির্মূল করে দুই বাঙলাকে একীভূত করার ষড়যন্ত্র চলছে। দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ সরাসরি প্রবৃত্ত হয় আজাদের আক্রমনের জবাব দিতে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে "ভারতীয় উৎস" -এর সাংস্কৃতিক প্রচার রহিত হয়। ফলে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মকেও ভারতীয় উৎস হিশেবে চিহিুত করে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রচারও রহিত করা হয়। যুদ্ধ শেষে আবারও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের প্রচার শুরু হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সালের জুন মাসে, পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবউদ্দিন জাতীয় পরিষদকে জানান যে, রবীন্দ্রনাথের যে-সমস্ত গান পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী, সে-সমস্ত গানের প্রচার বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গানের প্রচারও ক্রমশ হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এতো কিছুর পর ও রবীন্দ্রনাথকে আটকে রাখা যায় নি। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সভা-সমিতিতে "আমার সোনার বাঙলা" গাওয়া প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও "আমার সোনার বাঙলা" সত্যিকার আবেগ নিয়ে বহু জায়গায় গাওয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরূপ প্রকাশের ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে। বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, সর্বপ্রথম আহমদ শরীফ, অতিআধুনিক ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক সমালোচনা করেন। আহমদ শরীফ প্রবন্ধের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ করেন হায়াৎ মামুদ। তিনি বলেন ব্যক্তিগত জীবন নয়, শিল্পই হওয়া উচিত আলোচনার মূল বিষয়। তিনি পাঠকদের মনে করিয়ে দেন যে, যাঁর সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তিনি নিজের পার্থিব ও পরিবেশগত সীমা ছাড়িয়ে একটি সংস্কৃতিকে তার শেষ্ঠরূপ দান করেছিলেন।
এছাড়াও ১৯৭৫ সালের পরে পাকিস্তান আমলের কিছু কিছু প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপিত হয় এবং রবীন্দ্র-অনুরাগীদের সমালোচনার নামে রবীন্দ্রনাথকেও আক্রমন করা হয়। এইতো গত দশকেই একজন রাজনীতিবিদ বললেন, যে-দেশে ত্রিশ লক্ষ লোক স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়, সে-দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করার মতো একজনও কি নেই যে, কোথাকার কোন রবীন্দ্রনাথের গানকে আমাদের জাতীয় সংগীত করতে হয় ! যিনি গরু সম্পর্কে একটি ভালো রচনা লেখতে পারবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন কোথাকার কোন রবীন্দ্রনাথ !
আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষীকি। ফেসবুকের মত নিকৃষ্ঠতম জায়গা থেকে শুরু করে বহু খ্যাত-অখ্যাত জায়গায় কবির বন্দনায় সবাই মুখর হয়ে উঠবেন, এবং দূ্রে সরে যাবেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে । একজন আধুনিক কবি হুমায়ুন আজাদের ভাষায়----
ষাটের দশক থেকে, বাঙলাদেশ রবিস্তবে মুখর হয়ে উঠেছে, তাঁর বহু কিছুকে মূখ্য করে তুলেছে, শুধু ধীরে ধীরে ভুলে গেছে যে রবীন্দ্রনাথ কবি, ও তাঁর কবিতা পাঠের জন্যই রচিত হয়েছিল ।..... যখন তাকে মহাকবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু প্রভৃতি অভিধায় ডাকি তখনো যেনো গৌণ হয়ে পড়ে তার কবিত্ব, মুখ্য করে তুলি তাঁর মহত্ত্ব, বিশ্বজনীতা আর দেবতুল্য গুরুত্ব।
সূত্র:
আধার ও আধেয় : হুমায়ুন আজাদ
কালি ও কলম ( সপ্তম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা )
বাঙলার মনীষা : আহমদ শরীফ