মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে , প্রেরণা যোগায় সামনে এগিয়ে যেতে। তাই স্বপ্ন দেখতে হবে আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম আর লেগে থাকতে হবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া অব্দি। ভাবছেন মুভি রিভিও লিখতে বসে স্বপ্ন নিয়ে লেকচার দিচ্চি কেন? তাহলে ফিরে যেতে হবে বছর তিনেক আগের ঘটনায়। যখন ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং এর ২ নাম্বার অবস্থানে থাকা আন্তর্জাতিক এনজিওর মোটামুটি ভালভাবেই লাইফ লিড করার মত সম্মানজনক চাকরি , পরিবার পরিজন, পরিচিত পরিবেশ আর নিজের দেশ ছেড়ে একদমই পুরুপুরি ভিন্ন এক দেশ, ভাষা কালচার এর মাঝে নতুন নতুন সমস্যা আর সেগুলোর সমাধানের চেষ্টায় হাঁপিয়ে উঠছিলাম আর সে সময় ভাবছিলাম কেন যে সব কিছু ছেড়ে এই অনিশ্চয়তার সাগরে ঝাঁপ দিলাম, সেই সময় সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি সাহস যুগিয়েছে, সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে তা হল স্বপ্ন। আর সেই সময় অনুপ্রেরণা আর সব বাধাকে এগিয়ে যেতে আজও সাহায্য করছে যে মুভিটি সেটা নিয়েই আজ কিছু কথা লিখব। আজও যখন বার বার মনে হয় এত কষ্ট করে কি হবে? তখনই মুভিটির কিছু অংশ দেখি আর আবার নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সাহস পাই।
হ্যা, অক্টোবর স্কাই (October Sky) যে মুভিটি আজও আমাকে সাহস যোগায়, সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা যোগায়। একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবি। নাসার বিজ্ঞানী হোমার হিকামের অটোবায়োগ্রাফী নভেল ‘রকেট বয়েজঃ একটি স্মৃতিকথা’ বইটি থেকে এই মুভিটির কাহিনি নেয়া হয়েছে। জো জন্সটন পরিচালিত মুভিটি ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়। আইএমডিবি রেটিং ৭.৮ ।
১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর সোভিয়াত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক ১। যেটি মানব ইতিহাসে একটি মাইল স্টোন হিসেবে গণ্য করা হয়।
ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ার কয়লা উৎপাদন নির্ভর কোলউড গ্রামের একজন কিশোর হোমার হিকাম ও সে গ্রামের সবাই যখন রেডিওতে ঘোষণা শুনে খালি চোখেই স্পুটনিক ১ এর উড্ডয়ন অবলোকন করল এবং সেটাই বদলে দিল তার জীবন চিন্তা চেতনাকে। সেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করল রকেট বানানোর। পরের দিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে পরিবারের সবাইকে বলার পরে সেটা নিয়ে হাস্যরসও করল তার ভাই। জন হিকমেন (হোমার হিকামের বাবা) কয়লা উত্তলন কারখানার পরিচালক। তার আশা তার মতই তার দুই ছেলে জিম এবং হোমার এক দিন তার সাথে কাজ করবে এবং তার মতই কয়লা উত্তলন কারখানার দায়িত্ব নেবে। কিন্তু হোমার ইতিমধ্যে তার রকেট বানানোর কাজ শুরু করে দেয় তার তিন বন্ধুকে নিয়ে আর সেটার শুরু হয় তার বাড়ির বেড়া উড়িয়ে দেবার মধ্য দিয়ে । সে তার তিন বন্ধুকে নিয়ে একটি দল গঠন করল এবং চালাতে লাগল নানারকম পরীক্ষা। তার পরিবার এবং ক্লাসমেটরা মনে করে সে পাগল হয়ে গেছে। তার সহপাঠী কুয়েন্টিন তার সাথে যোগদান করে। চার জন নব উদ্যমে কাজ করে যেতে থাকে। বিজ্ঞান শিক্ষিকা মিস রিলে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যেহেতু লোকালয়ে তাদের রকেটের পরীক্ষমুলক উড্ডয়ন বিপজ্জনক তাই তারা গ্রামের বাইরে গিয়ে তাদের টেস্ট শুরু করে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে তাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয় কিন্তু দমে যায় না তারা। প্রতিবার টেস্টের পরে যে ভুলগুলো খুঁজে পায় সেগুলোকে ঠিক করে আবার নতুন করে নতুন রকেট বানিয়ে সেটার টেস্ট করতে থাকে। কিন্তু দিনের পর দিন তাদের নতুন নতুন রকেট বানানো আর কারিগরী সাহায্যের
প্রয়োজন হয় , আর তার জন্য যে টাকার প্রয়োজন সেটার জন্য তারা রেল লাইনের পাত খুলে বিক্রি করে আর কয়লা খনির এক কর্মচারীর হেল্প নেন।
তাদের রকেট বানানোর স্বপ্ন তাদের কে বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহনের স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলে। অনেকগুলো ব্যার্থ প্রচেস্টার পর সফলভাবে রকেট উড্ডয়ন করতে পারেন তারা । তাদের এই সফল উডডয়েন মুহুর্ত দেখতে পারেন এখানে-
অবশেষে সফল উড্ডয়নের পর সবাই খুশি হলেও তার বাবার সেই ইচ্ছা কয়লা খনিতে কাজের কথাই আবার শুরু করেন। শিক্ষিকা মিস রেলির কাছ থেকে হোমার প্রিন্সিপাল অফ গাইড অন মিসাইল ডিজাইন বইটি পুরস্কার হিসেবে পান যাতে সে তার রকেট নিয়ে কাজকে এগিয়ে নিতে পারেন সেই জন্য । যদিও কঠিন কঠিন সব ম্যাথ আর ক্যালকুলেশনে ভরা বইটির কথা মিস রেলি মনে করিয়ে দিতেই হোমার বলেন সে সব ম্যাথ শিখে নেবেন। মিস রেলির কাছ থেকে বইটি নিয়ে বের হয়ে যাবার সময় স্কুল প্রিন্সিপালের সাথে দেখা হয় হোমারের আর প্রিন্সিয়াল জানতে চান কোথা থেকে বইটি পেল। তখন মিস রেলি এগিয়ে এসে বলেন তিনি দিয়েছেন। তখন প্রিন্সিপাল মিস রেলিকে বলেন , স্কুলের স্টুডেন্টদের মধ্য থেকে মাএ একজন ফুটবল স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাবেন আর বাকীরা যাবেন কয়লা ক্ষনিতে কাজ করতে সো স্টুডেন্টদের ফলস হোপ দিয়ে কি লাভ। উওতে মিস রেলি জানান তিনি না হয় আনলাকি একজনের উপর ভরসা করলেন ।
সেই ভিডিও টি দেখে নিতে পারেন এখান-
ইতিমধ্যে তাদের রকেটের মডিফিকেশন এর কাজও এগিয়ে থাকে আর হোমারের ভাই ফুটবল স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে চলে যান , তাই হোমারের বাবার স্বপ্ন ভবিয্যতে একদিন তার মত কয়লাখনির দায়িত্ব পালন করবেন সেটা এখন একমাত্র হোমারই পূরন করতে পারেন এবং তার বাবা সেটাই ছেলেকে বুঝাতে চান ,কিন্তু হোমার চান সাইন্স ফেয়ারে যেতে , রকেট বানাতে। এ নিয়ে বাবা ছেলের মাঝে শুরু হয়ে যায় টানাপোড়ন।
সেই টানাপোড়ন আরো বেড়ে যায় যখন পুলিশ হোমার আর তার বন্ধুদের স্কুল থেকে ধরে নিয়ে যায় তাদের রকেটের কারনে। তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার সময়ও আবারও হোমারকে রকেট বানানো থেকে সরে আসতে বলেন। তার পরেই হোমার ও তার বন্ধুরা মিলে তাদের রকেট উডডয়ন পরীক্ষাস্থল পুড়িয়ে দেন আর রকেট বানোনোর স্বপ্ন এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
তার সাথে আরো যোগ হয় যখন এক্সিডেন্টে তার বাবা গুরুতর আহত হন। এখন পরিবারের দায়িত্ব নিতে হোমারের বড় ভাই কয়লাখনিতে কাজ করতে যেতে চাইলেও তার স্কলারশিপ চলে যাবে এই জন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে কয়লাক্ষণিতে কাজ করতে যেতে রাজি হন হোমার নিজেই । রকেট বানানোর স্বপ্নের সাথে স্কুলে পড়াশোনার স্বপ্নেরও পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই।
অবশেষে হোমারের বাবা সুস্থ হয়ে উঠেন আর হোমারের মা তাকে আবার স্কুলে যাবার কথা বলার পরে হোমার যেতে রাজি হন না। কিন্তু মিস রেলির সাথে দেখা হবার পর তার রকেট বানানোর সুপ্ত স্বপ্ন আবার যেগে উঠে । আবারো নতুন করে মিসাইল গাইডলাইনের ম্যাথগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেন।
সারাদিন কয়লা খনিতে কাজ করে আর রাতে মিস রেলির কাছে থেকে পাওয়া বইয়ের জটিল জটিল ইকোয়েশন আর ম্যাথের সলুইশন করে আবার পরের দিন কাজ শুরু করে সে । এমনকি কাজের ফাকে ব্রেকেও সে সেই সব ম্যাথের সলুউশেন খুজে বেড়ায়। এক রাতে কাজ শেষে তাইতো সে চলে যায় তার ক্লাসফ্রেন্ড কুয়েন্টিন এর বাসায়, আর সারা রাত দুজনে মিলে তাদের রকেটের উড্ডয়ন আর ল্যান্ডিং এর ইকোয়েশন নিয়ে কাজ করে।
ভিডিও দেখতে পারেন-
আর অবশেষে হোমার তার মাইনের কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবার জন্য কাজ শুরু করেন। আবার ও বন্ধুদের নিয়ে রকেট নিয়ে কাজ শুরু করেন। এবার শুধু রকেট উড্ডয়ন নয় ল্যান্ডিং নিয়ে ও কাজ করেন তারা ।
অবশেষে হোমার আবার ফিরে আসেন স্কুলে আর পুরোদমে তার রকেটের কাজ শুরু করেন এবং সাইন্সফেয়ারে জয়েন করা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু সে স্বপ্নের পথে আবারও তার বাবা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার বাবা চান হোমার আবার কয়লা খনিতে কাজ শুরু করবেন এবং তার দায়িত্ব নেবেন। কিন্ত এখানে হোমার তার বাবাকে বলেন- কোল মাইন আপনার লাইন , আমার না, আর আর কখন নিচে (কয়লা ক্ষনিতে ) যাব না, আমি স্পেশে যেতে চাই।
সে অংশটুকু দেখতে পারেন এখানে-
অবশেষে সাইন্স ফেয়ারে অংশগ্রহন করেন এবং ফাস্ট প্রাইজ জিতে নেন হোমার ও তার বন্ধুদের বানানো রকেট । কিন্ত সেই ফেয়ারের মাঝেও তাদের নানা প্রতিন্ধকতার সম্মুখিন হতে হয়। সেটা না হয় মুভি থেকেই দেখে নেবেন। এবার দেখে নিন প্রথম পুরস্কার পাবার মুহুর্তটুকু-
রকেট বয় অবশেষে সাইন্স ফেয়ারে প্রথম পুরস্কারা সাথে স্কলারশিপ সহ কলেজে পড়ার সুযোগ পাবার পরে সারা গ্রাম উচ্ছসিত ।
মুভিটির শেষ দৃশ্যে হোমার যখন তার রকেট উড্ডয়নের সময় তার বাবাকে থাকতে বলে তার বাবা তার অনেক কাজ আছে বলে সেদিন আসতে পারবে না জানান । কিন্ত তার পরেও তিনি একদম শেষের দিকে সেখানে উপস্থিত হন। দেখেন নিন তার রকেট উড্ডয়ণের মুহুর্তটুকু -
https://www.youtube.com/watch?v=8ZezvNWgi4M
সম্পুর্ন মুভিটি ইউটিওবে দেখতে পারেন এখানে
সবশেষে বলব, স্বপ্ন দেখতে হবে, সেই স্বপ্নকে নিজের ভেতরে লালন করতে হবে। আর সেই স্বপ্নকে সত্যিতে রুপান্তরিত করতে কাজ করে যেতে হবে, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যতক্ষন না সে স্বপ্ন সত্যিতে রুপান্তরিত হয়।
লেখাটি view this link পুর্বে প্রকাশিত ।