" যদি ভালো একটি এড তৈরি করতে চান, তবে সবার আগে নিশ্চিত করুন একটি ভালো কপিরাইটিং" - জন ক্যাপলেস।
লেখালেখির বাপারে আমার ধৈর্য্য একেবারেই নেই। আমি অস্থির প্রকৃতির মানুষ। তবে এডভার্টাইজিং এর উপর সিরিজ পোস্ট টি কন্টিনিউ করছি বেশ কদিন ধরেই। এর পিছনে পূর্ন ক্রেডিট হচ্ছে আপনাদের, মানে পাঠকদের। অসঙ্খ্য পজেটিভ ফিডব্যাক পাচ্ছি ফোনে, ফেবুতে, মেইলে। প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাদের।
তো অনেকেই ইনবক্সে প্রশ্ন করেছেন বিজ্ঞাপনে কপিরাইটিং বিষয়টি নিয়ে। তাই আজকের আলোচনা কপিরাইটিং নিয়েই।
"কপিরাইটিং" টার্ম টি যারা জানেন না, তাদের ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। বরাবরের মতই কিতাবী ভাষায় না গিয়ে আমি উদাহরন দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করবো।
প্রথম কথা, বিজ্ঞাপনে কপিরাইটিং টা কি জিনিস ? এটা কি ফটোকপি টাইপের কিছু ? হে হে, মোটেই না.... এইটাকে আবার কেউ ইন্টেলেকচুয়াল কপিরাইটের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন। বানান টা হচ্ছে COPYWRITING...
এক্ষেত্রে কপি মানে হচ্ছে লেখা, স্ক্রিপ্ট। আপনারা বিভিন্ন এডে ছবির (ভিজুয়ালের) সাথে যে কথাগুলো পড়েন বা দেখেন তাই হচ্ছে কপি। সেটা যে কোন কিছুই হতে পারে। একেবারে ট্যাগ লাইন বা হেড লাইন থেকে শুরু করে যে কোন আকর্ষনীয় বার্তা বা ইনফরমেশন। আর যিনি এ কাজটি করেন, তিনি হচ্ছেন কপিরাইটার। সিনেমার ক্ষেত্রে অনেকটা স্ক্রিপ্ট রাইটারের মত। একটি কপি তার কাস্টোমার কে এডের ছবির সাথে রিলেট করতে সাহায্য করে। বিলবোর্ড, খবরের কাগজের এড (প্রেস এড) বা লিফলেট এ পন্যের যে ছবি দেয়া হয়, তা আপনাকে ভিজুয়ালাইজ করতে সাহায্য করবে। আর কপি আপনাকে ইনফরমেশন দিয়ে ম্যাসেজ টা মাথায় ঢুকিয়ে দিবে। এক্টি শক্তিশালি কপি, সবসময়ি ইফেক্টিভ। ইমেজ আপনাকে পন্যটির আউটলুক দেখাবে, কপি দেখাবে ইনার স্ট্রেন্থ।
আসি বাস্তব উদাহরনে।
মনে করুন আপনি একটি প্রডাক্টের এড দিবেন। প্রডাক্ট হচ্ছে "ডিজুস", গ্রামীনফোনের একটি স্পেশাল প্যাকেজ। ডিজুসের ট্যাগ লাইন টা আপনাদের মনে আছে ? মনে করিয়ে দিচ্ছি।
"বন্ধু, আড্ডা, গান, এখানেই- ডিজুস"
এই লাইন টা থেকে কি বুঝা যায় ? ডিজুস হচ্ছে এমন একটা প্রোডাক্ট যেটা ফোকাস করবে বন্ধুক্ত, আড্ডাবাজী, মিউজিক। এখান থেকেই বুঝা যায় ডিজুসের টার্গেট কাস্টোমার হচ্ছে তরুন সমাজ। যারা মিউজিক, আড্ডা, আর বন্ধুক্তের প্রতিনিধিত্ব করছে। খেয়াল করে দেখুন, ডিজুসের সকল এডেই কিন্ত এই ব্যাপারগুলাই হাইলাইট করে। যেমন- "তুমি কি সাড়া দিবে" এড টির থিম কি ? "মোরা ঝরনার মত উচ্ছল" কিংবা "লীল আকাশের নিচে আমি কি সুখ খুজে পাই ?" সবি একই থীমের উপর। ব্যপারটা বুঝা গেছে ? অর্থাৎ প্রথম কপিটার উপরেই কিন্ত পরের সমস্ত এড তৈরি হচ্ছে।
আবার মনে করুন, "যেখানে দিন বদলের চেষ্টা, সেখানেই বাংলালিঙ্ক "।
খেয়াল করার চেষ্ট করুন, বাংলালিঙ্কের সকল এডেই কিন্ত পরিবর্তন বা দিন বদল ব্যাপারটিকে হাইলাইট করা হয়।
"জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে-রবি"
কি বুঝা যায় ? বুঝা যায় রবি বিশ্বাস করে আপনার ভিতরের শক্তিকে। রবি যখন তাদের ব্যান্ড আইডেন্টিটি চেঞ্জ করে একটেল থেকে রবি এক্সিয়াটা হয়,তখনকার টিভিসি গুলার কথা খেয়াল করুন। একজন মধ্যবয়ষ্ক লোক গিটার শেখা চেষ্টা করেন। একবার, দুইবার, তিনার, একসময় তিনি সফল হল এবং স্ত্রীকে বাজিয়ে শুনান গিটার। তার মানে প্রতিভা মানেনি বয়সের বাধা। রবি বিশ্বাস করে সেই প্রতিভাকে।
অর্থাৎ একটি কপিরাইটিং আপনার প্রডাক্ট/সার্ভিস কিংবা কোম্পানির কর্পোরেট আইডেন্টিটিকে কাস্টোমারের কাছে ইস্টাব্লিশ করার জন্য বিরাট ভুমিকা রাখে। আপনার কোম্পানির মিশন, ভিশন পারপাস যা, কপিতেও ঠিক তাই ফুটে উঠবে।
অফ টপিকঃ নিজের ঢোল একটু নিজেই পিটাই , বলার লোভ সামলাতে পারছিনা, রবির জন্য আমি ছোট্ট একটা ভিডিও বানিয়েছিলাম তাদের স্লোগান "জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে" এই থীমের উপর। বেস্ট জুরি এওয়ার্ড পেয়েছিলাম। তবে রবি আইডিয়ার কপিরাইট কিনে রাখে আমার কাছ থেকে।
মজার মজার কিছু কপি রাইটিং এর ব্যাপারে বলি।
"ক্যামেল" নামে একটা সিগেরেটের বিজ্ঞাপনের কপি ছিলো এরকম- "স্মোকিং ইজ হার্মফুল, ইফ ইউ স্মোক ক্যামেল"
মজা না ? যেহেতু বিজ্ঞাপন নিতিমালা অনুযায়ী সিগেরেট হার্ম্ফুল কথাটা থাকতে হবে, তাই তারা চমৎকার ক্রিয়েটিভ এই কপিটি বিজ্ঞাপনে দেয়। তারা কিন্ত স্মোকিং হার্মফুল এটাঅ বললো, আবার ক্যামেল বেস্ট সিগেরেট এটাও ইঙ্গিতে বুঝালো।
উপরের কপি টি দেখুন, - " টু নো মোর এবাউট ল্যাং ক্যান্সার, কিপ স্মোকিং"
আবার রম্য প্রত্রিকা উন্মাদের একটা স্টিকার আছে আমার কাছে। সেখানে লেখা-
"সিগ্রেট খাইয়া মারা যান
ভাতের উপর চাপ কমান"।
এই ধরনের এড ব্যাবহার করা হয় ডিমার্কেটিং এর ক্ষেত্রে। ডি মার্কেটিং মানে লেস কঞ্জাম্পশন। মানে কোন কিছু করতে বলা বা কিনতে বলার বদলে উল্টাটা বলা। অর্থাৎ এটা কিনবেন না, এটা ব্যাবহার করবেন না ইত্যাদি। ক্যামেল সিগেরেটের কপিটা কিন্তু ডিমার্কেটিং এর মাধ্যমে মার্কেটিং এর একটা চমৎকার উদাহরন।
আর একটা ব্যাপারও কিন্ত। বুঝা যাচ্ছে, কমার্শিয়াল প্রোডাক্টের বেলায় কপি হচ্ছে অনেকটাই ইনফরমেটিভ এবং ডিরেক্ট। এটা কিনুন, ওটা ব্যাবহার করুন ইত্যাদি। তবে নন কমার্শিয়াল, সোশ্যাল বা ডিমার্কেটিং এর বেলায় আপনার কপিতে ক্রিয়েটিভিটি ঢেলে দিতে পারেন। যত সুন্দর ভাবে আপনি মানুষের চিন্তায় একটা ম্যাসেজ থ্রো করতে পারবেন, তত বেশী ইফিশিয়েন্ট হবে এড টি। আর সোশ্যাল এডে যেহেতু প্রোডাক্টের ব্যাপার নাই, ম্যাসেজটাই আসল।
ধরুন আপনি এমন ভাবে চাইল্ড লেবারের উপর একটা কপি বানালেন, যা মনে দাগ কেটে যায়। তখন কেউ একজন এড টা দেখার পর সাবকনশাসলিই শিশুদের উপর এবিউজ করতে পারবেনা।
যদি কপি সর্বস্ব এড হয়, তাহলে কপিটি হতে খুবি শক্তিশালী, আর যদি সাথে ভিজুয়াল থাকে, তাহলে কপি হতে হবে এমন তা যেন ভিজুয়ালের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ন হয়। কপিরাইটিং স্ট্রাটেজি নিয়ে বিস্তারিত পরের পোস্টে বলবো, তবে এখন অন্তত একটা জিনিস মাথায় রাখেন। কপি চেষ্টা করবেন সিম্পল, ছোট, সাবলিল, সহয করতে। চেষ্টা করবেন ইমোশনালি টার্গেট কাস্টোমার কে টাচ করতে। মনে রাখবেন, আপনার টার্গেট কাস্টোমার আপনার কাছ থেকে কিছু একটা চাচ্ছে, সে জন্যেই সে এড টা দেখে। আপনার কাজ হলো প্রপার ভিজুয়াল আর কপির মাধ্যমে তার চাওয়াতা পূর্ন করা। তার মাঝে একটা ডিমান্ড সৃষ্টি করা, যাতে সে নিজে থেকেই বলে, এই প্রোডাক্ট টা আমার লাগবেই।
আসুন তাহলে দেখে নেই চমৎকার কিছু কপিরাইটিং সমৃদ্ধ এডভার্টাইজ।
এনোনিমাস এর পোস্টার । নাড়া দেয় না বিদ্রোহী মনে ?
বিশ্বাস করুন, পরিবর্তন আসবেই
এড ফার্মে কপিরাইটার এর কাজটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। একজন সিনিয়ার কপিরাইটার এর আন্ডারে থাকে জুনিয়র কপিরাইটার, ট্রান্সলেটর ইত্যাদি। ক্লায়েন্ট যখন একটা এড তৈরির জন্য এড এজেন্সিতে আসে, তখন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মূল প্ল্যান টা নিয়ে কপিরাইটার এবং আর্ট ডিরেক্টরের সাথে বসেন। কপি রাইটার টোটাল ব্যাপারটা লিখে ফেলেন, ইনক্লুডিং ডায়ালগ, স্ক্রিপ্ট, স্লোগান, হেডলাইন এবং ইনফো। আর আর্ট ডিরেক্টর সেটার আলোকে ডিজাইন বা ইমেজ রেডি করেন। কাজেই কপিরাইটার আর আর্ট ডিরেক্টরের আন্ডার্স্ট্যান্ডিং টা ভালো হয়া জরুরী।
যাদের গল্প, কবিতা বা লেখালেখির হাত ভালো, তারা কিন্ত সিরিয়াস লি এড ফফার্মগুলোতে কপিরাইটার হিসেবে জয়েন করতে পারে। আরেকটা ব্যাপার জানিয়ে রাখি, কপিরাইটার এবগ আর্ট ডিরেক্টরের ডেজিগনেশন কিন্ত সমান। অর্থাৎ একজন আর্ট ডিরেক্টর যদি ৫০০০০ টাকা বেতন পায়, সিনিয়ার কপিরাইটার ও তাই পাবে। সো বসে আছেন কেন ? লেগে পড়ুন এখুনি।
এখন বসে না থেকে একটা কাজ করতে পারেন। একটা ছোট্ট হোম ওয়ার্ক দেই। আপনার যেই সকল এড এর স্লোগান বা কপিরাইটিং ভালো লেগেছে, সেইগুলার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলুন। সাথে প্রোডাক্টের নামটাও লিখবেন। চিন্তা করে বের করুন, কেন এই কপিটি আপনাকে আকর্ষন করলো। অনেক কিছুই ক্লিয়ার হয়ে জাবে তখন।
আর আমি বিশ্বাস করি ব্লগার মাত্রই ক্রিয়েটিভ। তাহলে আসুন সবাই মিলে স্টপ চাইল্ড লেবার এর এডের একটি কপি তৈরির চেষ্টা করি। বাংলা ইংলিশ যেকোন ভাষাতেই হতে পারে। সবাই যদি সহোজগিতা করেন, তাহলে বেস্ট কপিগুলার সাথে ভিজুয়াল এড করে কিছু পোস্টার বানিয়ে ফেলবো আমরা সবাই মিলে। ফ্রি টাইম টা না হয় একটু চিন্তা ভাবনা করেই কাটালেন। লস কি, একটা কিছু তো শিখলেন।
কিভাবে কপিরাইটিং কে আকর্ষনীয় করবেন, বা অডিয়েন্সের এট্রাকশন কিভাবে তৈরি করবেন, এটা অনেকটাই নির্ভর করে আপনার সৃষ্টীশীলতার উপরে। তবে কিছু টেকনিক ও আছে। সেই ব্যাপারে আলোচনা করবো পরের পোস্টে।
সবাইকে ধন্যবাদ, পরবর্তি পর্বের জন্য সাথেই থাকুন
১ম পর্বঃ ব্র্যান্ডিং এবং এডভার্টাইজিং কি জিনিস
২য় পর্বঃ বিজ্ঞাপনের কিছু কমন স্ট্রাটেজি, মার্কেটিং মিক্স
৩য় পর্বঃ এড এজেন্সি- কি, কেন, কিভাবে
৪র্থ পর্বঃ সেক্স ইন এডভার্টাইজিং
--------------------------------------------
পোস্ট টি উৎসর্গ করলাম আমাদের সবার প্রিয় ব্লগার নস্টালজিক কে। রানা ভাই, আমাদের ইনসমনিয়াক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাহেব। আমার দেখা অসাধারন একজন মানুষ এবং চমৎকার লিরিসিস্ট। তবে তার যেই পরিচয় টা অনেকেই জানেন না, তা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট এড এজেন্সি "গ্রে"র কপিরাইটার ছিলেন। আশা করি তাকে উৎসর্গ করে কপিরাইটিং এর লেখাটার ভুলগুলি তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৪৩