প্রথমবার তাজমহল দেখেই বিল ক্লিনটন আমেরিকান প্রেসিডেন্টসুলভ একটা বাণী দিলেন--এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে; এক, যারা তাজমহল দেখেছেন আর দুই যারা তাজমহল দেখেননি।
সেই বাণী পড়ে তখন আমি বেশ অভিভূত হয়েছিলাম। তখন আমার অভিভূত হবার বয়স। কিন্তু পরবর্তীতে বয়স খানিকটা বাড়ার সাথে সাথে যখন মুগ্ধতা কমতে লাগলো উপলদ্ধি করা শুরু করলাম ক্লিনটনের বাণীতে অতটা মুগ্ধ হবার মতো তেমন কিছু ছিল না। কেননা যে কোন পরিপ্রেক্ষিতেই, অধিকাংশ প্রশ্নেই পৃথিবীর মানুষ দুই ধরনের। হয় তারা অক্ষশক্তি কিংবা মিত্রশক্তি। হয় তারা খ্রিস্টান অথবা ইহুদি, হিন্দু বা মুসলিম। আমেরিকা বা রাশিয়া, ভারত বা পাকিস্তান। নাইকি বা অ্যাডিডাস। নৌকা বা ধানের শীষ...
এসবের সাথে চার বছর পর পর ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা। হয়তো পেলে-ম্যারাডোনা, মেসি বা নেইমার। আর সেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল এমনই যে, খোদ আর্জেন্টিনার চেয়ে বাংলাদেশে মেসির সমর্থক বেশী! বিশ্বকাপ উপলক্ষে কেবল আমাদের শাখারি বাজারে যত পতাকা ওড়ে এত পতাকা জাতিসংঘেও ওড়ে না। এমনকি আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দুপক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও বিরল নয়।
চার বছর পর পর এই বিশ্বকাপ আসতে আসতে পৃথিবীর ইতিহাস, পৃথিবীর ভূগোল, পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা অনেক কিছুই পাল্টে যায়। শেখ মুজিব পাঠ্য বইয়ের পাতা থেকে হারিয়ে যান, জিয়াউর রহমান এসে স্থান দখল করে, আবার হয়তো জিয়াউর রহমানকে হঠিয়ে শেখ মুজিবের পুন:প্রতিষ্ঠা হয়। সুদান ভেঙ্গে জন্ম হয় দক্ষিণ সুদানের, এক দিনের জন্য স্বাধীন হয় ক্রিমিয়া, ইরাক যুদ্ধ শেষ করে আমেরিকা, যুদ্ধ বাধে সিরিয়ায়, লিবিয়ার পতন ঘঠে, উত্থান ঘটে চীন-ভারত-ব্রাজিলের। ম্যারাডোনার যায়গায় আসেন মেসি, নেইমাররা বয়ে বেড়ায় পেলে-গারিঞ্চাদের পতাকা।...কিন্তু সেই ”থিওরী অব টু” ঠিকই রয়ে যায় জন্ম থেকে জন্মান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
২০১০ এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপও হয়তো বিনোদন দিয়ে গেছে নেলসন ম্যান্ডেলা, মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা বিন লাদেনদের। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদরা আমাদের মতন মাতামাতি করেছেন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে। কিন্তু সেই সব সমর্থকেরা ঠিক পরের এই বিশ্বকাপটি আসতে আসতেই হয়ে গেছেন ইতিহাস। শুন্যস্থান পূরণ করতেই যেন ”এসেছে নতুন শিশু”, পৃথিবীতে এসেছে প্রিন্স উইলিয়াম-কেট এর প্রিন্স জর্জ, শাকিরা-পিকে এর মিলান, মেসির থিয়াগো বা নিতান্ত অখ্যাত পিতা-মাতার দাইয়ান-আদিয়ান-তুরানরা।
মাঠেও এসছে নতুন শিশু। নেইমার, হামেস রদ্রিগেজ, থিবো কর্তুয়াদের মতন এবার বিশ্বকাপের অনেক তারকাই গত বিশ্বকাপেও ছিলেন দুগ্ধপোষ্য। এবার তারা নিজ নিজ দেশের অন্যতম বড় ভরসা। এই চার বছরে তারা যে কেবল দুধ ছেড়েছেন তাই নয় উল্টো তাদের কোলে একটা করে ছানা। মাঠের পাশাপাশি ঘরও সামলাচ্ছেন, সামলাচ্ছেন কোলও।
এই একটা যায়গায় নেইমার-হামেসদের সাথে আমি-আমরাও একই কাতারে--গত বিশ্বকাপেও নেইমারদের মতন আমার মত অনেকেরই কেবল নিজেকে সামলালেই চলত; অথচ পরের বিশ্বকাপেই আমি আর শুধুই আমার নই। গত বিশ্বকাপেও আমরাই ছিলাম লেটেস্ট জেনারেশন। আর এবার নেইমার-হামেসদের মতনই কোলে ছানা-পোনা নিয়ে আমরা একটু পুরনো প্রজন্ম হয়ে গেছি। গত বিশ্বকাপের ব্যাচেলর আমরা এই বিশ্বকাপেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পুরোদস্তুর গৃহপালিত সামাজিক জীব হয়ে উঠেছি।
হুট করেই এখন আর শুভর মেসে খেলা দেখার কোন আয়োজন হয় না--শুভও এখন আর মেস নিবাসী কোন ব্যাচেলর নয়, একসন্তানের জনক এক ছাপোষা সামাজিক জীব। কিংবা ভার্সিটিতে খেলা দেখার পরিকল্পনাও খুব একটা হালে পানি পাচ্ছে না। সেই দিনতো আর নেই যে, ফুলের উপর ঘুমিয়ে যাবো ফুলের মধু খেয়ে--ভার্সিটিতে খেলা দেখে সারা রাত হৈচৈ করে শেষে হলে গিয়ে ঘুমিয়ে যাবো। এখন আমাকে একরাত হলে থাকতে দেবার মতন একজনও নেই তেত্রিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গত বিশ্বকাপেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাত কাটানোর রুমের অভাব ছিল না। তাছাড়া সকালে ওঠার চিন্তাতো আছেই--অফিসতো আর ক্লাস নয়, কৃষিশিক্ষা আর গার্হস্থ্য অর্থনীতির মতো ঐচ্ছিক বিষয়। তাও বাদ দিলাম, কোন একটা ভালো খেলা যে সবাই মিলে রাস্তায় চালানো বড় পর্দায় দেখবো সেই জো-ও নেই। যাদের নিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে খেলা দেখব অধিকাংশেরই বিয়ের বয়স দুই-তিন বছর, বিয়ের পরের প্রথম বিশ্বকাপ। রাস্তায় একসাথে খেলা দেখার চেয়ে বাসায় ’একসাথে খেলা দেখা’র একটা রোমান্টিক তাড়নাতো থাকেই।
রাস্তায় একসাথে খেলা দেখার চেয়ে বাসায় ’একসাথে খেলা দেখা’র রোমান্টিক তাড়নাই নাহয় জয়যুক্ত হোক। প্রথম চাকরী, ’প্রথম স্ত্রী (কিংবা স্বামী)’ এবং প্রথম সন্তান নিয়ে প্রথম বিশ্বকাপটা সবার স্মরণীয় হোক। অবশেষে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকুক। আমাদের সন্তানেরা থিওরী অব টু-থেকে মুক্ত হয়ে তারপর প্রয়োজনে বেছে নিক আমেরিকা বা রাশিয়া, ভারত বা পাকিস্তান। নাইকি বা অ্যাডিডাস। নৌকা বা ধানের শীষ...ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা, পেলে-ম্যারাডোনা। মুক্তি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে।