বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে —সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
হায় চিল
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
আমাকে একটি কথা দাও
আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন:
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো;
সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন-চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।
সেই দিন এই মাঠ
সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি-
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন-
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চ’লে যাব ব’লে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে ?
লক্ষ্ণীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্ণীটির তরে ?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল ;
এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
কোথাও চলিয়া যাবো একদিন
কোথাও চলিয়া যাবো একদিন;-তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি;
জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী
পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস
বুকে নিয়ে তাহাদের;-জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস
কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে- কাঁঠাল শাখার থেকে নামি
পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী
ধানী শাল পশমিনা বুকে তার -শরতের রোদের বিলাস
কতো কাল নিঙড়াবে;-আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি
কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু;
আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি
উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু
মুখে গুজে পড়ে রবে-আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি;
মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু
তুমি
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারি দিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে — গঙ্গাফড়িং সেও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।
‘মাটির অনেক নীচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছ আধারে?
ওই যে ওকানে পায়রা একা ডাকে জমিরের বনে;
মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি-তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে
আমার এমন কাছে — আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে
আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –‘
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে — প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
আকাশলীনা
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর।
কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস -
আকাশের ওপারে আকাশ।
মনে হয় একদিন
মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,
শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;
সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তার
জানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না…
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না-
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?
বাংলার মুখ আমি
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে
ভোরের দয়েলপাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম- বট- কাঁঠালের- হিজলের অশথের ক’রে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে!
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল- বট- তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিল : বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বথ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল- একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।
জীবনানন্দ দাশ আমার অনেক প্রিয় কবি তার প্রিয় কবিতার লিস্ট অনেক লম্বা এক পর্বে দেয়া সম্ভব না আরও পর্ব থাকবে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই আমার ভাল লাগে আর অন্য কাব্যগ্রন্থেরও অনেক পছন্দের কবিতা আছে অনেক কবিতা আছে মাথার উপর দিয়ে যায় তবুও পড়তে ভাল লাগে
১০ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ২:২৮